উচ্চশিক্ষা পরিকল্পনায় গ্রন্থাগার
উচ্চশিক্ষা পরিকল্পনায় গ্রন্থাগার
স্বাধীনতাকামী বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ফসল স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠালাভ করে ১৯৭১ সালে। বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালির অমিত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায়। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে মাত্র এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ স্বশাসনের সংবিধান জাতীয় সংসদের মাধ্যমে অর্জন করে। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে জারি হয় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন আইন (১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতি আদেশ নং ১০ Presidential Order No.10 of 1973)। ১৯৭৩ সালে দেশের উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে পাঁচটি আইন জারি হয় তার মধ্যে প্রথমটিই বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন আইন এবং বাকী চারটি দেশের সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় যথাক্রমে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন। স্বাধীন বাংলাদেশে পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত উচ্চশিক্ষার অবাধ বিকাশের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার নতুন উদ্দীপনায় এই ১৯৭৩ সালের বিশবিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন আইনটি রচিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ক্ষেত্রে এটিই সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম আইন।
দ্বিতীয় আইনটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অর্থাৎ President Order No. 11 of 1973 এর পরে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশগুলো যথাক্রমে Rajshahi University Act 1973, Chittagong University Act 1973, Jahangirnagar University Act 1973 আইন হিসেবে পাস হয়। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনামলের শেষ দিকে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন ও জ্ঞানের স্বাধীন বিকাশের জন্য যে আকাঙ্ক্ষাটি দেশের বুদ্ধিজীবি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজে ধুমায়িত ছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই তার বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রতিষ্ঠা ।
জ্ঞান বিকাশের স্বাধীনতা ও পারস্পরিক আস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিতে দেখলে ১৯৭৩ এর উল্লিখিত পাঁচটি আইনই পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক ও সম্পূরক একটি চমৎকার গণতান্ত্রিক আইন বলে প্রতিভাত হবে এবং আজও প্রাসঙ্গিক ও গতিশীল বলেই প্রতীয়মান হবে। যদিও সময়ের বিবর্তনে ও কালের চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান ও জ্ঞানীর নেতৃত্ব (Freedom of Knowledge & Academic Leadership) এ আইনগুলো আরও সৃজনশীল করার জন্য সংশোধিত হতে পারে ।
আরও পড়ুন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা
ধারণাগত দিকটি বৃটিশ বা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের কাছাকাছি হলেও কাঠামোগতভাবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন আরও গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের গঠনে তৎকালীন ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিববৃন্দের প্রতিনিধিত্ব ছিল এবং এখনও আছে। অর্থাৎ সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় এই উভয় পক্ষের সরাসরি অংশগ্রহণে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন গঠিত। এদিক থেকে আমাদের এই উচ্চশিক্ষা কমিশন আরও অগ্রগামী ও গণতান্ত্রিক। তদুপরি এই কমিশন দেশের নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে আইন বিভাগ বা জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ।
একটি অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হয়েও কাজের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন দেশ ও জাতির উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পরিপালন ও সুফলপ্রসু করে তুলতে পারছে না। দেশের দক্ষ ও ধীমান জনসম্পদ কেবল মাত্র উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমেই সৃষ্টি করা সম্ভব। দক্ষ ও ধীশক্তি সম্পন্ন মানব সম্পদ ছাড়া দেশের নেতৃত্বদান ও উন্নয়ন একেবারেই সম্ভব নয়। তবে এও সত্য যে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে বিরাজমান সমস্যা ও নৈরাজ্যমূলক অবস্থা উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেই সর্বাধিক। উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনাহীনতা এবং আর্থরাজ নৈতিক হস্তক্ষেপ এই সমস্যা ও নৈরাজ্যমূলক অবস্থা সৃষ্টির পশ্চাতে ক্রিয়াশীল। এমতাবস্থায় মঞ্জুরী কমিশনের অধ্যাদেশে যে ক্ষমতা ও স্বাধীনতা দেয়া আছে তা বাস্তবায়ন অত্যন্ত দূরূহ।
সাধারণভাবে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা এবং বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দান করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তা বাস্তবায়ন করার জন্য অর্থায়ন করা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব ।
আরও পড়ুন সমকালীন ভাবনা
স্বাধীন দেশ ও জাতির জন্য যেটুকু পরিকল্পিত উচ্চশিক্ষার রূপরেখা ডক্টর কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে প্রণীত হয়েছিল, তাও বাস্তবায়ন হয়নি। এখন দেশ ও জাতির জন্য অষ্টম শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রদান করা হয়েছে। বার্ষিক পরিকল্পনায় বা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সেই রিপোর্টের ক্রম বাস্তবায়ন হবে এমন নিশ্চয়তা নেই, তবে বাস্তবায়ন হলে দেশ ও জাতি হয়ত পাঁচ দশ বছর পর তার সুফল দেখতে পারে।
উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা হলো দেশের জন্য নেতৃত্বদানকারী এমন দক্ষ ও বিবেকবান মানব সম্পদ তৈরি করা যারা দেশ ও জাতিকে পরিচালনা করবে। সেই লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষার অর্থনৈতিক, সামাজিক বা নৈতিক পরিকল্পনা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সরকারকে দিয়ে করিয়ে নিতে সক্ষম হয়নি। এ ক্ষেত্রে অন্তরায় অনেক এবং অন্তরায়গুলোর স্বরূপ চিহ্নিত করাও হয়ত খুব কঠিন নয়। কিন্তু অন্তরায় থেকে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাও যখন অবসিত হয়ে যায় তখনই আসে ভয়ঙ্কর নৈরাশ্য। সেই নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যে নিপতিত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ।
জ্ঞান ও চিন্তার ক্ষেত্রে মননের সূতিকাগর হিসেবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সাথে সম্পৃক্ত করে দেশের উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে ধারণ করা আবশ্যক। উচ্চশিক্ষার প্রকৃতি ও মানের উপরই নির্ভর করে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি ও অগ্রগতি। জ্ঞানের পুরোনো ভিতের উপর নতুন চাহিদা মোতাবেক সকল শাখায় শিক্ষাদান ছাড়াও উচ্চশিক্ষার প্রধানতম দায়িত্ব হলো সমাজে দক্ষ, সৎ, উদ্যোগী, চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল কর্মপরায়ণ নেতৃত্বদানকারী নাগরিক তৈরি করা। মানব সভ্যতার সঞ্চিত জ্ঞান লাভ করে নতুন নতুন গবেষণা ও উদ্ভাবনার মধ্য দিয়ে সেই আগ্রাভিযানের দিগন্তকে আরও সম্প্রসারিত করবে। এজন্য উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতে পরিকল্পনা মাফিক বিনিয়োগ সত্যিকার অর্থে জাতির অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতির জন্যই বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ এবং পরিকল্পনা মাফিক বিনিয়োগ যখন সত্যিকার অর্থে জাতির অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করে, তখনই জাতি টেকসই প্রবৃদ্ধি লাভ করে। পরিকল্পনা মাফিক এই বিনিয়োগ হলে দেশের দক্ষ জনশক্তির গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয়।
আরও পড়ুন শানশি লাইব্রেরি ও মোরগের ডাক
বস্তুগত সত্য যে, দেশের প্রথম তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের বিশেষ কোন সুযোগ ছিল না। চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ফলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এই তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হয় তখন নয়টি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষা সম্প্রসারণ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারকে আইটেম করে বা উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি একক খাত ধরে কোন যুযোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিশ্ব জ্ঞানের ও জ্ঞানসাধকদের জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটানোর স্থান এবং এর আধার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাখাতে, উন্নয়ন পরিকল্পনা উপখাতে প্রতি বছরই দশবারটা উদয়ন পরিকল্পনা (এডিপি) থাকে। কিন্তু গ্রন্থাগার উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতার ত্রিশ বছরে মাত্র একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল; কিন্তু তাও বাস্তবায়ন করা হয়নি। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী অবশ্য Central Reference Library গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার হিসেবে তিনি একটি একক বাড়ি ভাড়াও করেছিলেন । কিন্তু আর্থিক বরাদ্দের অপ্রতুলতার জন্য তা আর বাস্তবায়ন হয়নি।
এক দশক পরে ১৯৮৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগার উন্নয়নের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৮৩ সালের ২৫ মে কমিশন দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ানদের নিয়ে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার সহযোগিতা কার্যক্রম আওতায় ইউনিয়ন ক্যাটালগ কার্যক্রম প্রস্তুত করার পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি সভা করে। সে সভায় তখনকার সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন গ্রন্থাগারিক উপস্থিত ছিলেন। গ্রন্থাগার উন্নয়নের এই পরিকল্পনা প্রস্তাবনায় উচ্চশিক্ষার মান সমুন্নত করার লক্ষ্যে-
১. ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠান
২. বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারিকদের সমন্বয়ে একটি পরিচালনা কমিটি গঠন
৩. বৈদেশিক মুদ্রা অবমুক্তির ব্যাপারে একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণ
৪. গ্রন্থাগারের পুস্তক/জার্নাল ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ইউনেস্কো কুপন ক্রয়ের ব্যবস্থা
৫. লাইব্রেরির সংগ্রহের সংরক্ষণ ও stock taking এর বিষয়ে গ্রন্থাগারিকদের তত্ত্বাবধান আরও বৃদ্ধি করা ইত্যাদি বিষয়ে সুপারিশ গৃহীত হয়।
আরও পড়ুন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬-৮৭ অর্থ বছরে ডেভেলপমেন্ট অভ্ ইউনিয়ন ক্যাটালগ বিবলিওগ্রাফিক্যাল সার্ভিসেস ইনফরমেশন রিট্রিভ্যাল প্রজেক্ট নামে ৪৭.৭৮ লক্ষ টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প (ADP) গ্রহণ করা হয়েছিল। এই প্রকল্পে তখন দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়গ গ্রন্থাগারের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনা বিদেশী অর্থ সহায়তায় গ্রহণ করার জন্য পরিকল্পনা কমিশন ও এশিয়া ফাউন্ডেশনকে মঞ্জুরী কমিশনের উদ্যোগে সম্মত করানো হয়েছিল এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এশিয়া ফাউন্ডেশন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ত্রিশ হাজার মার্কিন ডলার প্রকল্প সাহায্য হিসেবে দেয়ার আশ্বাসও দিয়েছিল। ১৯৮৪-৮৮ অর্থ বছরের মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে উচ্চশিক্ষা খাতে ১৩টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৮৬৫.১৭ লক্ষ টাকা। তন্মধ্যে সর্বোচ্চ ৪১৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এবং আগের বছরের বরাদ্দ কমিয়ে এনে ডেভেলপমেন্ট অভ্ ইউনিয়ন ক্যাটালগ বিবলিওগ্রাফিক্যাল সার্ভিসেস এ্যান্ড ইনফরমেশন রিট্রিভাল প্রজেক্টে সর্বনিম্ন ১১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগার উন্নয়নের এই একটিমাত্র উন্নয়ন প্রকল্পে ১৯৮৭ সালে এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় আমেরিকান লাইব্রেরি অভ্ কংগ্রেসের একজন বিশেষজ্ঞ মিস জেনি লিন্ডলে প্রকল্পের কনসাল্টটেন্ট হিসেবে এসে কমিশনকে পরামর্শ প্রদান করেন। তার পরামর্শের ভিত্তিতে এশিয়া ফাইন্ডেশনের সহযোগিতায় তিন সদস্যের একটি গ্রন্থাগারিক দলকে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারাইজড লাইব্রেরিতে শিক্ষা সফরে পাঠানো হয়। শিক্ষা সফর শেষে কমিশনের নিকট একটি প্রতিবেদনে বলা হয় “All universities libraries of Bangladesh should be established on sound footing. One of the first things of a university is its library:” সুপারিশে ছিল “In order to have such system, Bangladesh should immediately establish a ‘Bangladesh Integrated Libray Automation System (BILAS)” বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারসমূহের যাবতীয় সংগ্রহের ইউনিয়ন ক্যাটালগ তৈরির লক্ষ্যে সাড়ে দশ কোটি টাকার একটি পরিকল্পনা মঞ্জুরী কমিশন সরকারের নিকট দাখিল করে । এই পরিকল্পনার সারপত্রে লাইব্রেরিগুলোতে অটোমেশন করার প্রস্তাবও ছিল। সাড়ে দশ কোটি টাকার বিরাট অঙ্কের কারণ দেখিয়ে অঙ্কুরেই এই প্রকল্পটি শেষ করে দেয় পরিকল্পনা কমিশন।
আরও পড়ুন গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার
পরিবর্তীকালে ১৯৯০ সালে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গ্রন্থাগারগুলোতে অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দের কারণে মূল্যবান জার্নাল ক্রয়ে ক্রমাগতভাবে সংগ্রহের দৈন্যদশা ঘুচাতে পরিশেষে কেন্দ্রীয় জার্নাল লাইব্রেরি গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দ দিয়ে গ্রন্থাগারের মূল্যবান বিদেশী জার্নালের অধিকসংখ্যক সংগ্রহ গড়ে তুলতে সেন্ট্রাল জার্নাল লাইব্রেরি গড়ে তোলার প্রয়াস নেয়া হয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গ্রন্থাগারে সংগৃহীত মূল্যবান বিদেশী জার্নাল সংগ্রহের নিমিত্তে একটি কেন্দ্রীয় একুইজিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন পদ্ধতি সংবলিত একটি সেন্ট্রাল জার্নাল লাইব্রেরি গড়ে তোলার পরিকল্পনাও দেয়া হয়। কিন্তু সেন্ট্রাল জার্নাল লাইব্রেরি গড়ে তোলার এই পরিকল্পনাও ১৯৯০ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার জের ধরে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রথমে University Resource Cesntre (URC) গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়।
পরে সকল বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে ইন্টারনেট ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য গ্রন্থাগার ভিত্তিক Bangladesh Education and Research Network (BERNET) প্রকল্প প্রণয়ন করে। এতে e-Journal এর জন্য Consortia গঠনের প্রক্রিয়ায় হাত দেয়া হয়। কিন্তু বিদেশী অর্থায়নে এগুলো TAPP আকারে পেশ করার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শ ছিল। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ঋণদান কর্মসূচি নিয়ে ঢুকে পড়ে। দেশের উচ্চশিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থায়নে একটি Strategic Plan ২০০৬-২৬ মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক গৃহীত হয়। এর আওতায় বর্তমানে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নর প্রকল্প (Higher Education Quality Enhancement Project) বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলছে। এক্ষেত্রে পূর্বের সকল ধারণা পরিহার করে Future of e-Library in the Universities শীর্ষক সেমিনারে e- Library-র Consortia গড়ে তোলার বিষয় ভাবা হয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারগুলোর নিজস্ব সম্পদ Digitized করে Resource Sharing গড়ে তোলার নিজস্ব উদ্যোগ এখন আর নেই ।
আরও পড়ুন কামাল লোহানীর বিপ্লব মন্ত্রের প্রথম পাঠশালা
দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান ও অগ্রগতির উপর জাতির উন্নতি ও অগ্রগতি নির্ভরশীল। বর্তমান এই তথ্যপ্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের যুগে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের বর্তমানে ৮২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৫ লক্ষ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য মানসম্পন্ন গ্রন্থাগার ব্যবস্থার বিকল্প নেই। কিন্তু এর জন্য কোনো সমন্বিত পরিকল্পনাও নেই ।
মান নিশ্চিত করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সম্প্রসারণ করতে হলে গ্রন্থাগার ছাড়া তা কখনই করা সম্ভব নয়। যখন গ্রন্থাগার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে বিবেচিত হবে, কেবল তখনি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মান নিশ্চিত হবে এবং প্রকৃত দক্ষ ও ধীমান জনশক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে বেরিয়ে আসবে যারা শুধু দেশের নয় বিশ্বের দায়িত্ব নেয়ার উপযোগী মানব সম্পদ হতে পারে।
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
উচ্চশিক্ষা পরিকল্পনায় গ্রন্থাগার