আলতা বানু (৩য় পর্ব)
আলতা বানু (৩য় পর্ব)
শাহানাজ মিজান
আমাদের সংসারে একের পর এক দূর্যোগ নেমে আসতে লাগল। শাশুড়ি আম্মা তার ছেলের বউদের খুব ভালোবাসতেন। বিশেষ করে বড়ো বুবুকে তিনি নিজে পছন্দ করে বড়ো ছেলের বউ করে ঘরে এনেছিলেন। তার ছেলের সমস্যা, আমাদের দুজনের কষ্ট এসব তিনি সহ্য করতে পারলেন না। ভালো মানুষ রাতে শুয়েছিলেন, ফজরের ওয়াক্তে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য।
শাশুড়ি আম্মার মৃত্যুর খবরে আমার বাপের বাড়ির সবাই দেখতে এল। আব্বা আমার মুখের দিকে তাকাতে পারলেন না। সবাই সবটা জেনে গেছে। সবার অপরাধবোধ চোখ আমার দিকে। দাদি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।
শাশুড়ি আম্মার চল্লিশা হয়ে গেল। পরের দিন আমার দেবর এসে উনাকে বলল,
— আমরা আর এ বাড়িতে থাকতে চাই না। এ বাড়িটা একটু ছোটো, বাচ্চা কাচ্চারা বড়ো হলে আলাদা আলাদা ঘর লাগবে। তাই রাস্তার ওপারে বড়ো বাগান বাড়ি, সেখানে বাড়ি করতে চাই।
উনি জোরে একটা নিশ্বাস ফেলে ছোটো ভাইয়ের কথায় রাজি হয়ে গেলেন। ঐ বাড়িতে বড়ো বড়ো গাছ, দুটো পুকুর এসব বাদ দিয়েও সমস্ত সম্পত্তি অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে দিলেন।
এর মধ্যে আমাদের দেশের উপর দূর্যোগ শুরু হলো। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি মিলিটারিরা সারাদেশে হত্যা, লুণ্ঠন, অমানবিক অত্যাচার ও তান্ডব চালাতে লাগল। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। আমরা বড়ো বুবুর বাপের বাড়ি পাবনার সুজানগরের চরদুলাই গ্রামে আশ্রয় নিলাম।
আরও পড়ুন গল্প একশত ছিদ্রযুক্ত জামা
দীর্ঘ নয় মাস পরে যুদ্ধ থামল। নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেলাম। আমার জা আবার সন্তান সম্ভাবা। সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না, বসতে পারে না। এ বাড়িতে থাকতে ওর ছেলেমেয়েদের আমরাই দেখাশোনা করতাম। এখনো ছেলেমেয়েরা আমাদের কাছেই থাকে বেশি, খেলাধুলা করে সন্ধ্যায় ও বাড়িতে চলে যায়।
জায়ের শারীরিক পরিস্থিতি আস্তে আস্তে খারাপ হতে লাগল।
একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হলো। আমার জা মরতে মরতে বেঁচে গেল ঠিকই, কিন্তু শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ। ওকে বাচ্চাসহ আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম। আমি আর বড়ো বুবু দিনরাত বাচ্চা আর মায়ের খুব যত্ন করি।
পাশের বাড়ির এক বয়স্ক চাচি শাশুড়ি একদিন আমার দেবর আর জা কে বললেন,
— ও ছোটো মিয়া, আল্লাহ তোমার ঘরে দুইটা ছেলে আর দুইটা মেয়ে দিছে। ছোটো বউমার শরীর এই রকম খারাপ, সুস্থ হইতেও তো সময় লাগবে। এই ছোটো ছেলেটাকে ওদের দিয়ে দাও। তোমাদের ছেলে তোমাদেরই থাকবে, মাঝখানে বড়ো মিয়া আর তার বউয়েরা বাপ মা ডাক শুনবে।
আমার দেবর আর জা তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না।
আমি বড়ো বুবুর দিকে তাকালাম, আমরাও কিছু বললাম না।
কয়েকদিন পরে, সকালে খাওয়া দাওয়ার পর উনি কাজের উদ্দেশ্যে বাইরে চলে গেল। আমি বড়ো বুবুকে বললাম,
— বড়ো বুবু, চাচি আম্মা যে কথাটা ছোটো মিয়াকে বলল, এই বুদ্ধিটা আমাদের আগে আসে নাই কেন?
বড়ো বুবু বললেন,
— কী বুদ্ধি?
— এতদিন আমরা একটা বাচ্চা দত্তক নিলেও তো পারতাম…
বড়ো বুবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছলছল চোখে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু হেসে বললেন,
— দুঃখ করিস না আলতা। আল্লাহ যা নিজের করে দেয় নাই, পরেরটা দিয়ে কী করব বল? এক গাছের বাকল কি আর অন্য গাছে লাগেরে বোন, লাগলেও বেমানান হয়। তাতে হয়তো মনে শান্তনা পাওয়া যায়, কিন্তু শান্তি বা স্বস্তি কোনোটাই পাওয়া যায় না। ধৈর্য ধর, হয়তো আল্লাহ আমাদের কল্যাণ এভাবেই রেখেছেন।
আরও পড়ুন গল্প প্রথম প্রভাত
সেদিন রাতে, আমার দেবর ও বাড়িতে আমাদের সবাইকে ডেকে পাঠাল। ছোটো ছেলেটাকে উনার কোলে তুলে দিয়ে বলল,
— ভাইজান, আজ থেকে এ তোমাদের ছেলে।
উনি ছলছল চোখে বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বুকে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু দিলেন। বড়ো বুবুর চোখ দেখে খুশি বা অখুশি কিছু বোঝা গেল না। কিন্তু আমার মনে মনে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।
আমরা দুই মা, পরম আদরে যত্নে এক খোকনকে মানুষ করতে শুরু করলাম।
প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার মশাই খোকনের মায়ের নাম কী দিবেন, তা জানতে চাইলেন। বড়ো বুবু বললেন,
— এক ছেলের মায়ের নাম তো আর দুইজনের দেওয়া যায় না। মায়ের নামের জায়গায় আলতা বানু দেন।
আমি বড়ো বুবুর কথা শুনে খুব খুশি হলাম।
খোকনের খুশির জন্য আমরা সবকিছু করি। যে কোনো জিনিস খোকনের মুখ ফুটে চাইতে দেরি, তার সামনে আসতে দেরি হয় না। খোকন কৈশোরে পা দিল। ও পাড়ায় সেখদের বাড়িতে প্রথম টেলিভিশন এনেছে। আমাদের খোকন নাকি প্রতিবেশি খেলার সাথিদের নিয়ে সেই বাড়িতে টেলিভিশন দেখতে যায়। একদিন তারা টেলিভিশন দেখতে দেয়নি, খোকন মন খারাপ করে এসে বলল। পরের দিনই উনি একটা টেলিভিশন কিনে নিয়ে এলেন। এমনিতেই বাড়িতে সব সময় লোকজনে গম গম করত, এখন সন্ধ্যে হলে বাড়িতে যেন মানুষ আর ধরে না। আমাদের খোকন তো মহাখুশি, সন্ধ্যার পরপরই টেলিভিশনটা বারান্দায় এনে চালু করে দেয়। আর পাটি বিছিয়ে সবাই উঠোনে বসে যায়। কেউ কেউ তো আবার পাটিতে জায়গা না পেলে খড় বিছিয়ে বসে যেত।
আরও পড়ুন গল্প সাদা মেঘের তুলো
আমাদের খোকন মেট্টিক পাশ করল, সেকেন্ড ডিভিশনে। আমরা তাতেই খুশি। খোকনের আব্বা বললেন,
— যাহোক, পাশ তো করেছে। আমাদের খোকন তো আর চাকুরি করবে না। নিজেদের জমিজমাগুলো দেখেশুনে খেতে পারলেই হলো।
সাতবাড়িয়া কলেজে ভর্তি হলো খোকন। আমরা সারাদিন তার আসার পথ চেয়ে থাকি। কলেজ থেকে ফিরলে বড়ো বুবু তার মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দেয় তো আমি আচল দিয়ে তার মুখ মুছে দিই।
একদিন খোকনের আব্বা তিনটা দলিল বড়ো বুবুর হাতে দিলেন। বড়ো বুবু আমার দিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, কীসের দলিল? আমিও ইশারায় জানালাম, জানি না।
উনি বললেন,
— তোমাদের নামে দু’বিঘা করে চার বিঘা জমি লিখে দিয়েছি। আর যা ছিল সবই খোকনের নামে লিখে দিয়েছি; এগুলো তার দলিল। যত্ন করে রেখে দিও।
অজানা আশংকায় আমার বুকটা কেমন কেঁপে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে বড়ো বুবুর কপালেও চিন্তার ভাজ পরল। বড়ো বুবু উনাকে বললেন,
— আপনার সিদ্ধান্তের উপরে কোনোদিন কোনো কথা আমরা বলিনি। কিন্তু আজ এত বড়ো একটা কাজ করার আগে একবার পরামর্শ করলেন না? আমাদের অবর্তমানে সবকিছুই তো খোকনই পেত, এখনই তার নামে সবকিছু দলিল করে দেওয়াটা কি ঠিক হলো? নিজের নামেও কিছু রাখলেন না?
— আরে তোমরা কোনো চিন্তা করো না। তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে, বলো? আমি যা করেছি সব ভেবেচিন্তেই করেছি। সমাজের দশজনের সাথে পরামর্শ করেই করেছি।
বড়ো বুবু বা আমি কেউ আর কোনো কথা বাড়ালাম না। বড়ো বুবু দলিলগুলো আলমারিতে রেখে দিলেন।
আরও পড়ুন গল্প মৃত বৃক্ষ
আমাদের খোকন বিএ পাশ করল। ওর আব্বাকে বললাম, এখন ঘরে একটা বউ দরকার।
আমরা দশ বারোজন সাতবাড়িয়া গ্রামে মেয়ে দেখতে গেলাম। ঘটক ও প্রতিবেশিদের কাছে শুনলাম, মধ্যবিত্ত ঘরের হলেও মেয়ে খুব নরম স্বভাবের আর দেখতেও ফুটফুটে সুন্দরস। মেয়ের নাম কুসুম, আমরা সবাই দেখলামও তাই, মেয়ে পছন্দ হলো। অনেক ধুমধাম করে খোকনকে বিয়ে করিয়ে বউ ঘরে নিয়ে এলাম।
দু’তিন মাস বেশ ভালোই দেখলাম। তারপর দেখি, বউ মুখে মুখে কথা বলে। একটা ভালো কথা বললে, তার উল্টো মানে করে। মাঝেমাঝে আমি রেগে গেলেও, বড়ো বুবু তাকে বুঝিয়ে কথা বলেন। আর আমাকে বলেন,
— ছোটো মানুষ, কিছুদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে।
একদিন খোকন বেশ রাত করে ঘরে ফিরল।
খোকন তো কখনো এমন করেনি। আমাদের চোখে ঘুম নাই। উনাকে ঘুমাতে বলে আমি আর বুবু বারান্দায় পায়চারি করছি। আজ কী হলো জানার জন্য দৌড়ে গেলাম ওদের ঘরে। দেখি বউয়ের উপর চোটপাট করছে। ভাং খেয়ে নেশা করেছে, আমাদের চোখ তো কপালে। বড়ো বুবু ভীষণ রেগে গিয়ে খোকনের গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। খোকন টাল সামলাতে না পেরে বিছানার উপর পরে গেল।
টলতে টলতে উঠে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বড়ো বুবু জিজ্ঞেস করলেন,
— খোকন হঠাৎ তোমার কী হলো যে ভাং খেয়ে নেশা করতে হলো?
খোকন কিছু না বলে দাঁড়িয়েই রইল। বড়ো বুবু আরেকটা চড় দেওয়ার জন্য হাত তুলতে গেলে, কুসুম তার হাত ধরে ফেলে, ঝাঁঝালো গলায় বলল,
— খবরদার বলছি, আমার স্বামীকে মারবেন না। আমার স্বামীর গায়ে হাত তোলার কোনো অধিকার আপনার নাই।
বড়ো বুবু কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হলেন, কিন্তু আমার প্রচন্ড রাগ হলো।
আরও পড়ুন গল্প শিকড়ের সন্ধানে
আমি বললাম,
— বউ মা, ঠিক করে কথা বলো। কীভাবে কার সাথে কথা বলতে হয় জানা নেই, না? উনি তোমার শাশুড়ি আম্মা এবং তোমার গুরুজন।
কুসুম মুখে মুখে তর্ক করতে শুরু করল। বলল,
— কীসের শাশুড়ি আম্মা! ছেলেকে পেটে ধরছেন…
আমি একটু চেঁচিয়ে উঠলাম।
— ওই বেয়াদব মেয়ে, কথা ঠিক করে বলো। তোমার স্বামী টুপ করে আকাশ থেকে পড়েছে আর তোমার স্বামী হয়ে গেছে…
আরো কিছু বলতাম কিন্তু বড়ো বুবু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
— আলতা, এখান থেকে চলে আয়। ওর উল্টাপাল্টা কথার জবাব তুই দিতে পারবি না। ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে নিজের সম্মান নষ্ট করিস না। মনে রাখিস, নিজের সম্মান নিজে না রাখলে কেউ রেখে দেয় না।
(বুক ভেঙ্গে কান্না করছেন) ভুল যা করার তা আমরা করে ফেলেছি রে। এ ভুলের মাশুল আমাদেরই দিতে হবে। আমি সব বুঝতে পেরেছি। তিল তিল করে গড়া আমাদের এই সোনার সংসার। বড়ো স্বাধ করে কখন যে বানের জলে ভাসিয়ে দিয়েছি, নিজেরাই বুঝতে পারিনি। (চোখের পানি মুছে) পৃথিবীতে এদের মতো কিছু স্বার্থপর বেয়াদব মেয়ে আছে, যারা সুন্দর চেহারা আর নামের আড়ালে নিজের কুৎসিত চরিত্র লুকিয়ে রাখে। যারা সংসারে ঢুকেই সংসারের শান্তি নষ্ট করে। এদের অশালীন আচরণ আর ঝগড়ায় জেতার জন্য মুখের অশ্লীল ভাষা, যুক্তি তর্কের কাছে আমাদের মতো মানুষদের চিরদিন অসহায় হয়ে থাকতে হয়েছে, হবেও। নিজেদের সম্মান রক্ষা করতে, আমরা কিছু বলতেও পারব না, সইতেও পারব না। চল এখান থেকে…
আরও পড়ুন আলতা বানু-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
আলতা বানু (৩য় পর্ব)