আলতা বানু (২য় পর্ব)
আলতা বানু (২য় পর্ব)
শাহানাজ মিজান
আমাদের বাড়িতে উঠোনে বসে নতুন জামাই সমাজের কিছু গণ্যমান্য লোকজনের সাথে কথা বলছিলেন। আর ঘরের মধ্যে আমি আমার পরিবারের সবাইকে ডেকে নিয়ে এলাম কথা বলার জন্য। আব্বার সাথে কথা বলার সাহস আমার আজো হলো না। কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। কাঁদতে কাঁদতে মেজো চাচার পা জড়িয়ে ধরে বললাম,
— চাচা, আমি তোমাদের কাছে এত বড়ো বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম, আগে কেন বলোনি? তাহলে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরে যেতাম। একজন বিবাহিত পুরুষ যার ঘরে বউ আছে, তার সাথে কেন আমার বিয়ে দিলে? লোকে তো তোমাদের বড়োলোক বলে, তাহলে কীসের এত অভাব পরেছিল যে আমাকে এভাবে ভাসিয়ে দিলে…?
আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আমি আর কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। আমার কান্না দেখে চাচা, ঘরের মধ্যে থাকা মা-চাচিরা সবাই কাঁদছে। দাদি একটু জোরেই কেদে ফেললেন।
আব্বা চাপা স্বরে ধমক দিলেন,
— এত মরা কান্নার কিছু হয়নি। আমি যা করেছি সবদিক ভেবে চিন্তেই করেছি। আমি সবদিকে খোঁজখবর নিয়েই এ কাজ করেছি। আর তোমাকে সাগরে ভাসিয়ে দেইনি। আমজাদ হোসেন, তার গ্রামের প্রভাবশালীদের মধ্যে একজন। তারা খুবই ভালো মানুষ। তার প্রথম স্ত্রী বন্ধ্যা। কিন্তু সেও সম্ভ্রান্ত ঘরের শিক্ষিত মেয়ে। আট বছরের সংসার জীবনে তাদের কোনো সন্তানাদি নেই। এত সহায় সম্পত্তি খাবে কে? তুমি বুঝতে পারছ, তোমার সন্তানেরা এসব কিছুর মালিক হবে? আর তোমাকে তারা মাথায় করে রাখবে। একটা কথা মনে রাখবে, বাপ-মা সন্তানের মঙ্গলের জন্য সবকিছু করতে পারে।
আরও পড়ুন গল্প রক্তে জ্বলে একাত্তর
জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, বাবার কথার উপরে কথা বলে কোনো লাভ হবে না। ভাগ্যে যা ছিল তা হয়ে গেছে। এখন এসব মেনে নেওয়াই ভালো। তবুও মনে এতটুকু শান্তি পাচ্ছি না। উনি ঘরে ঢুকলেন, আমি ঘোমটা টেনে খাটের এক কোণায় বসলাম।
উনি বললেন,
— সেদিন এ গ্রামে এসেছিলাম অন্য একটি মেয়ে দেখতে। কিন্তু পথে তোমাকে দেখেই খুব পছন্দ করেছিলাম। তোমার পরিবারকে জানিয়েছিলাম কেন আমি দ্বিতীয় বিবাহ করতে চাইছি। আমি জানতাম না তোমাকে সবকিছু না জানিয়ে, তোমার মতের বিরুদ্ধে এ বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন যেহেতু বিয়েটা হয়েই গেছে, কিছু করার নেই। নিয়ম মতো তোমাদের বাড়িতে তিনদিন থাকার কথা আমার। কিন্তু আমি আর এ বাড়িতে থাকতে পারব না। কালই বাড়ি ফিরতে চাই। তুমি কাল আমার সাথে গেলে ভালো, আর না গেলে বুঝব আর যেতে চাও না।
উনি বালিশ টেনে পাশ ঘুরে শুয়ে পড়লেন। আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। ঘুম আসছে না, এপাশ ওপাশ করছি। বুঝতে পারছি, উনিও ঘুমাননি। আমি আলতো করে উনার হাতের উপর হাত রেখে লজ্জাজড়িত গলায় ঢোক চিপে বললাম,
— নিয়ম মতো তিনদিন পরেই আমরা বাড়িতে ফিরব।
আমার কথা শুনে উনি হাতটা শক্ত করে ধরে আমাকে তার বুকে টেনে নিলেন। আমি নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলাম না।
এ বাড়িতে শাশুড়ি আম্মা ও বড়ো বুবু আমাকে খুব ভালোবাসেন, যত্ন করেন। একেকবার মনে হয়, মায়ের পেটের বড়ো বোন হলেও হয়তো এতটা যত্ন করতেন না। বড়ো বুবু আমার মুখে তুলে খাইয়ে দেন, চুল বেঁধে দেন, সুন্দর করে গুছিয়ে শাড়ি পরিয়ে দেন, আমার কিছুই করতে হয় না। বড়ো বুবুর কাছে অনেক বই, নবী রাসূলের জীবনী, সাহাবাদের জীবনী, হাদিস-কোরআন, আরো অনেক বই। আমি আর বুবু সেসব বই পড়ি, দিন কোন দিক দিয়ে কেটে যায় বুঝতেই পারি না।
আরও পড়ুন গল্প সে আমার কেউ না
আমাদের উনি, সপ্তাহের চারদিন আমার ঘরে আর তিনদিন বড়ো বুবুর ঘরে থাকেন। অবশ্য বড়ো বুবুই এভাবে থাকতে বলেছেন। আমার দেবর, জা, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশি সবাই খুব ভালো। পুরুষেরা বাহির বাড়িতে কাজ আর মেয়েদের কাজ বাড়ির ভেতরে, মানে কাজের লোকেরা- তারাও সবাই খুব ভালো। সবাইকে আমার খুব ভালো লাগে।
এখন আর বাপের বাড়িতে যেতেই ইচ্ছে করে না, গেলেও থাকতে পারি না। উনাকে ছাড়া তো বটেই, বড়ো বুবুকে ছেড়ে কোথাও গেলে মনে হয় মাকে ছেড়ে এসেছি। বলা যায় আমরা তিনজন, কেউ কাউকে ছেড়ে কোথাও যাই না। গেলেও থাকতে পারি না।
পরম সুখে শান্তিতে কেটে যাচ্ছে দিন। কিন্তু যে কারণে আমি উনার দ্বিতীয় স্ত্রী হলাম, চার বছর কেটে গেল অথচ তার কোনো খবর নেই। যে যেখানে বলে আমরা সেখানেই যাই। অমুক কবিরাজ, তমুক তাবিজ-কবজ, পানি পরা, তেল পরা, অমুক মাজারে বটগাছে লাল সুতো বাঁধা কত কি! কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
বেশ কিছুদিন ধরে খেয়াল করছি, উনি রাত করে বাড়িতে ফেরেন। ঠিকমত কথা বলেন না, খাওয়া দাওয়া করেন না। এ, ও কানাকানি করে, উনি নাকি আবারও বিয়ে করার চিন্তাভাবনা করছেন। আমরা শাশুড়ি আম্মার কাছে বিষয়টা জানতে চাইলাম। কিন্তু তিনিও কিছু জানেন না। বললেন,
— বাড়িতে ফিরলে জিজ্ঞেস করব।
এর মধ্যে আমাদের ছোটো জায়ের চারটা ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে।
সকালে উনি বের হয়ে যাচ্ছেন, এমন সময় শাশুড়ি আম্মা পেছন থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
— কী হয়েছে তোমার? আজকাল বাড়িতে ফিরতে, উঠতে বসতে খুব অনিয়ম করছ। লোকমুখে যা শুনছি তা কি সত্যি?
আমি আর বড়ো বুবু বারান্দায় দাঁড়ান। উনি একবার আমাদের মুখের দিকে তাকালেন।
আরও পড়ুন গল্প রৌদ্রডোবা চাঁদ
তারপর সোজাসুজিই উত্তর দিলেন,
— হ্যাঁ, এছাড়া উপায় কী? আমার বংশ রক্ষা করতে হবে তো।
শাশুড়ি আম্মা ঝাঝাল কণ্ঠে বললেন,
— আর এই দুজনের কী হবে?
— কী আর হবে, যেমন আছে তেমনই থাকবে।
একথা শুনে আমার খুব রাগ হলো আর কষ্টও পেলাম। এর প্রতিবাদ করা দরকার। বড়ো বুবুর চোখে পানি দেখে উনাকে কিছু বলব, বড়ো বুবু আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি তার হাত ছুটিয়ে, উনার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
— শুনেছিলাম আপনি বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। কিন্তু বারবার বিয়ে করার মধ্যে কোনো বুদ্ধিমত্তা নেই, বিচক্ষণতা নেই। এতদিন অনেকেই অনেক কথা বলেছে, কান দেইনি। বড়ো বুবু না হয় বন্ধ্যা কিন্তু আমি…? আমিও বন্ধ্যা? আমি এসব মানবো না, কিছুতেই না। আর এভাবে এতদিন চলতেও পারে না। চলুন, আমরা কালই ঢাকায় যাব, বড়ো ডাক্তার দেখাব। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, যদি আমার কোনো দোষ ধরা পরে, আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
শাশুড়ি আম্মা, বড়ো বুবু দুজনেই আমার কথার সাথে একমত হলেন।
আরও পড়ুন গল্প অন্ধকারে জ্বলে দীপশিখা
আমরা ঢাকা থেকে ডাক্তার দেখিয়ে চারদিন পর সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে ফিরতে ফিরতে এশার আজানের পরে বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। বড়ো বুবু, শাশুড়ি আম্মা সহ সবাই আমাদের পথ চেয়েছিলেন। সবার প্রশ্নাতুর চোখ আমার উপর।
উনি ঘরে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। আমার থমথমে মুখটা দেখে বড়ো বুবু চোখের পানি আটকে রাখতে পারছেন না।
সবাই যা বোঝার বুঝে গেল।
ঘরের মধ্যে আমরা তিনজন প্রাণী। তিনজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদলাম, খুব কাঁদলাম। শাশুড়ি আম্মা এলেন, আমার আর বড়ো বুবুর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিলেন। তিনি তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— আল্লাহর কি খেলা! দোষ কার আর শাস্তি পায় কে।
উনি চোখের পানি মুছে বললেন,
— মা, তোমার বউমাদের চলে যেতে বলো। আমার জন্য তাদের জীবন নষ্ট হবে কেন?
আমি আর বড়ো বুবু উনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। বললাম,
— আমরা আপনাকে ছেড়ে কোথায় যাব? আল্লাহ ভাগ্যে যা লিখেছেন তাই হবে। মা ডাক শোনার ভাগ্য আল্লাহ আমাদের কপালে লেখেননি।
আরও পড়ুন আলতা বানু-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
আলতা বানু (২য় পর্ব)