আলতা-বানু-১ম-পর্ব
গল্প,  শাহানাজ মিজান,  সাহিত্য

আলতা বানু (১ম পর্ব)

আলতা বানু (১ম পর্ব)

শাহানাজ মিজান

১৯৬৫ সাল, তখন আমার বয়স প্রায় সতের। কয়েক বছর আগেই বাংলা লেখাপড়ার পাট চুকে গিয়েছিল। পঞ্চম শ্রেণি পযর্ন্ত পড়ার পর আমার আব্বা বাড়িতে একজন হুজুর রেখে দিয়েছিলেন;আরবি পড়ানোর জন্য। লেখাপড়ায় একেবারেই খারাপ ছিলাম না। তাই খুব তাড়াতাড়িই কোরআন এবং নামাজ পড়া শিখে গেলাম। আব্বা বলতেন, মেয়েদের এত বেশি বাংলা লেখাপড়া করার দরকার নাই। মেয়েরা ঘরে থাকবে; পর্দার মধ্যে।তবে বাংলা বই পড়তে আমার খুব ভালো লাগত, ছোটো ভাইদের বই নিয়ে গল্প পড়তাম। আমার বাপ-চাচারা ছিলেন তিন ভাই। আব্বা ছিলেন সবার বড়ো। তার রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে কোনো কথা বলার সাহস কারো ছিল না। তিন ভাইয়ের এক সংসার। এত বড়ো যৌথ পরিবারে সবার আদর-যত্ন-ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা আমরা দশ ভাই-বোন। তার মধ্যে আমি সবার বড়ো এবং একমাত্র মেয়ে। দুধে আলতা গায়ের রঙ নিয়ে জন্মেছিলাম, তাই দাদি আমার নাম রেখেছিলেন ‘আলতা বানু’।
মা, দাদি, চাচিরা আমাকে এত বেশি ভালোবাসতো যে সংসারের কোনো কাজ করতে হতো না আমার। তবু আমার মনে হতো সবার থেকে মেজো চাচা আমাকে বেশি ভালোবাসতেন। তিনি হাট-বাজারে গেলে আমার জন্য তিলের মটকা আর কদমা খাজা এনে দিতেন। আমি এগুলো খেতে খুবই পছন্দ করতাম। আর নাজিরগঞ্জের হাট থেকে এনে দিতেন চওড়া পাড়ের লাল শাড়ি, লাল চুড়ি, লাল ফিতা আর আলতা। সেই ফিতা দিয়ে দাদি আমার চুল বেঁধে দিতেন। কখনো লম্বা বেণী করে বেণীর আগায় ফুল বানিয়ে দিতেন। আবার কখনো কলাবেণী করে দিতেন। আর আমি আলতা পরা পায়ে নূপুর পরে সারা পাড়া ঘুরে বেড়াতাম। আব্বা আর ছোটো চাচা ছিলেন খুব রাগী মানুষ। তাদেরকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেতাম। তারা মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া পছন্দ করতেন না। কিন্তু আমার যে বাড়িতে মন বসত না তেমন একটা।

আরও পড়ুন গল্প কালো কঙ্কাল

আব্বা আর ছোটো চাচার চোখ ফাঁকি দিয়ে সারাদিন কেটে যেত দুরন্তপনায়। সই-সখীদের সাথে হেসে খেলে, বিলে ও পুকুরে সাঁতার কেটে, শাড়ির আচল দিয়ে মাছ ধরে, চড়ুই ভাতি করতাম। বউচি, কানামাছি, গোল্লাছুট, বদনদাড়ি, কুতকুত, পাঁচকড়ি, চোখপলান্টি কত খেলা ছিল আমাদের সময়। মাঝে মাঝে আব্বার কাছে ধরা পরে খুব বকুনি খেয়ে দাদির আচলের তলায় লুকাতাম।
জোছনা রাতে বড়ো উঠোনে সখিদের নিয়ে ‘দুধভাত’ খেলতাম। এটা খেলার সময় আর কেউ কিছু বলত না। খুব মজার এই খেলাটায় দুটো দল থাকত। দু’দলের দুজন রাজা, তাদের নিজ নিজ প্রজাদের একেক জনের একেক নাম রাখত; ফুল ও পাখিদের নামে। নামগুলো তাদের কানে কানে বলে দেওয়া হতো। একদলের রাজা অন্য দলের প্রজাদের চোখ ধরে, একেক জনকে একেক নামে ডাকত। সে এসে এর কপালে টিপ দিয়ে যেত। চোখ খোলার পরে কে টিপ দিল এটা সঠিক বলতে পারলে, এক লাফ দিয়ে এগিয়ে যেতে হতো সামনে, এমন করেই খেলা চলত।
আরো যে কত কিছু খেলতাম। আর পাড়ার যত ছোটো ছোটো ছেলেরা ডাংগুলি খেলত, আমি হতাম ওদের রাজা।

আমগাছের ছায়ায় বসে পায়ে আলতা দিচ্ছিলাম, আর নিজের পা দুটো নিজেই পরখ করে দেখছিলাম। ইস! আমার পা দুটো দেখতে কি সুন্দর লাগছে।
সখীরা সব অন্য আমগাছের ডালে রশি বাঁধছে। কেউ গাছে ওঠেছে আবার কেউ নিচে দাঁড়িয়ে ঠিক করছে ঝুলনের উচ্চতা কতটুকু হবে। একজনের হাতে একটা পাটের বড়ো বস্তা। রশির উপর বস্তাটা ভাজ করে দিলে ঝুলন খাওয়ার সময় পাছায় ব্যথা লাগবে না।
আমার সই হাসি চেঁচিয়ে ডাকল,
— সই ঝুলন বাঁধা হয়ে গেছে, আয় তাড়াতাড়ি।
আমিও আলতার বোতলের মুখ আটকাতে আটকাতে চেঁচিয়ে জবাব দিলাম,
— আসতেছি…

আরও পড়ুন গল্প মাধবী নিশীথিনী

এমন সময় পাড়ার সব ছোটো ছোটো ছেলেরা এসে আমাকে ঘিরে ধরল,
— আলতা বু, আগে আমাদের সাথে একপাট ডাংগুলি খেল।
কি আর করা। সখীদের ঝুলনে দোল খেতে বলে আমি ওদের সাথে ডাংগুলি খেলতে শুরু করলাম।
খেলতে খেলতে, ওদের বলছি,
— এবার গুলতে চলে যা পদ্মার ওপার…
গুলতেটা চলে গেল রাস্তার উপর। গেল তো গেল, রাস্তা দিয়ে কয়েকজন লোক যাচ্ছিল, তাদের একজনের কপালে গিয়ে লাগল।
কপাল ফেঁটে রক্ত পড়ছে শুনে; সব ছেলেরা হৈ-হৈ করতে করতে রাস্তায় চলে গেল। আমি ঝাড়মনি লতার পাতা ছিড়ে হাতের তালুতে ঘষতে-ঘষতে এসে উনার কপালে লাগিয়ে দিতে-দিতে উল্টো রাগ দেখিয়ে বললাম,
— রাস্তায় চলাফেরা করার সময় একটু দেখে শুনে চলতে হয়, জানেন না…না?
এক মূহুর্তে দেখে নিলাম, লোকটি দেখতে খুব সুন্দর, সুদর্শন, সুপুরুষ। সত্যি কথা বলতে এত সুন্দর পুরুষ মানুষ আমি আগে কখনো দেখিনি।
একজন মুরুব্বী জিজ্ঞেস করলেন,
—  গুলতেটা কে মেরেছে?
ছেলেগুলো আঙুলের ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিল। আমি লজ্জা পেয়ে জিভে কামড় দিয়ে বড়ো আমগাছটার পেছনে লুকালাম।
সন্ধ্যায়, খুব ভয়ে-ভয়ে পা টিপে-টিপে বাড়িতে ঢুকলাম। কেউ এসে নালিশ দিয়েছে বলে মনে হলো না। রাতে দাদির কাছে শুয়ে বারবার ঐ লোকটির মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।

সেই ঘটনার সাত-আটদিন পরে দাদি এসে আমাকে বললেন,
—  আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে দেখতে শুনতে খুব সুন্দর, উঁচু বংশ। বসতবাড়ি, বাগান, পুকুর, মাঠ সব মিলিয়ে প্রায় দুইশ বিঘা সম্পত্তি। বাপ নাই, মা আর দুই ভাই।
দাদিকে জিজ্ঞাসা করলাম,
— কোন গ্রামের ছেলে?
দাদি বললেন,
— নাজিরগঞ্জ। ছেলের নাম আমজাদ হোসেন।

আরও পড়ুন গল্প সুকৃতি এবং বৈরীকাল

বিয়ে উপলক্ষে সাত দিন ধরে ধুমধাম চলছে। মাইক বাজছে, ছেলে-মেয়েরা আনন্দ করছে। সারারাত সারাদিন ধরে পাড়ার নানি- দাদি-চাচি, সই-সখীরা দল বেঁধে, গলায় গলা মিলিয়ে গ্রামীণ গীত গাইছে। এখন আমার গায়ে হলুদ হচ্ছে, রাতে বিয়ে। যার সাথে বিয়ে তাকে দেখিনি আমি। বারবার শুধু ঐ লোকটির চেহারা চোখে ভাসছে।
সই-সখীরা আমাকে কনে সাজিয়ে দিচ্ছে। বাইরে গুঞ্জন, বর এসেছে, বর এসেছে। সবাই ছুটে গেল বর দেখতে। কিছুক্ষণ পরে আমার সই হাসি, হাসতে হাসতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
— সই, তোর বর দেখতে খুব সুন্দর। গুলতে দিয়ে যার কপাল ফাটিয়েছিলি, তোর কপালে আল্লাহ্ তার নাম লিখে দিছেন রে।
আমি লজ্জায় এবং খুশিতে হাসিকে জড়িয়ে ধরলাম।
জন্ম থেকে চিরচেনা গ্রাম বোনকোলা, আম বাগানের ঝুলন, গুলতে কাঠি, পুকুর, আমার আপনজনেরা সবকিছু ছেড়ে চলে যাচ্ছি এক অজানা অচেনা গ্রামে। মেজো চাচাকে ছেড়ে আসতে বেশি কষ্ট হচ্ছিল। মেজো চাচা বারবার বলেছেন,
— বেশি দূরে নয়, আমি তোমাকে প্রতিদিন দেখতে যাব।

বড়ো একটি সাজানো গোছানো ঘরে খুব সুন্দর করে বাসর ঘর সাজানো। আমি খাটের উপর বসে আছি। কত মানুষ আমাকে দেখতে আসছে আর যাচ্ছে। আমার দেবরের বউ, মানে আমার জা সে শাশুড়ি মাকে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। তিনি আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। আমার গা ভর্তি গহনা, তবুও তিনি এক জোড়া সোনার কাকন আমার হাতে পরিয়ে দিলেন।
অনেক রাত হয়েছে, স্বামী এখনো আসছেন না। মনে মনে ভাবছি, আমার দেবর আগে বিয়ে করেছে, জায়ের কোলে একটা বাচ্চাও দেখলাম। আর উনি এত পরে বিয়ে করলেন, ব্যাপারটা কী।
সবাই চলে যাওয়ার পরে তিনি এলেন, তবে একা নয়। তার সাথে একজন সুন্দরী রূপবতী মহিলা। তারও গা ভর্তি গহনা, রুচিশীল পরিপাটি সাজ। কিছু কিছু মানুষ আছে, পুরুষ হোক বা মহিলা, প্রথম এক নজর দেখলেই ভালো লাগে, তিনিও তেমন একজন।

আরও পড়ুন গল্প তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা

তিনি স্বামীর হাত ধরে খাটে বসিয়ে দিলেন। তারপর আমার পাশে বসে উনার হাতে আমার হাত দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— আল্লাহর কাছে প্রাণভরে দোয়া করি। যার জন্য তুমি এ বাড়িতে এলে, আল্লাহ যেন তোমার এবং আমাদের সবার মনোবাসনা পূর্ণ করেন। আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, তবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চোখ ছলছল করছে কিন্তু মুখে হাসি। তিনি দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
তিনি কে, কৌতূহলী চোখে স্বামীর দিকে তাকালাম। স্বামীর মুখে যা শুনলাম তাতে মুহুর্তের মধ্যে আমার স্বপ্নেঘেরা সমস্ত পৃথিবী উলট পালট হয়ে গেল। কালোবৈশাখী ঝড়ের মতো বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেল। সারাটা রাত কেটে গেল কাঁদতে কাঁদতে।
পরের দিন বৌভাতের এত আয়োজন, এত হৈচৈ আমার কাছে মরণ যন্ত্রণা মনে হচ্ছিল।

আরও পড়ুন আলতা বানু-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

আলতা বানু (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!