গল্প,  শাহানাজ মিজান,  সাহিত্য

আলতা বানু (শেষ পর্ব)

আলতা বানু (শেষ পর্ব)

শাহানাজ মিজান

এক এক করে জীবন থেকে প্রিয়জনেরা সবাই হারিয়ে গেল। প্রচণ্ড ঝড়ে ডালপালা ভাঙা এক বিধ্বস্ত বট গাছ যেমন করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, তেমন করে শুধু আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। এত বড়ো শূন্য ঘরে একা একা কি করে থাকব আমি। সমাজপতিরা পরামর্শ করে আমাকে খোকনের ঘাড়ের বোঝা করে দিয়ে গেল। এখন থেকে আমার সমস্ত দায়িত্ব খোকনের।
শরিফুলকে ওরা লেখাপড়া করতে ঢাকায় পাঠিয়ে দিল। আমি আরও একা হয়ে গেলাম। ওরা খাওয়ার সময় আমাকে ডাকে না। ওদের খাওয়া হয়ে গেলে আমার ঘরে খাবার দিয়ে যায়।

ইদানীং নিজের প্রতি নিজেরই খুব রাগ হয়। কেন এত ক্ষিধে পায় আমার। যা দেখি তাই খেতে ইচ্ছে করে, এমনকি বাচ্চাদের কিছু খেতে দেখলে সেটাও খেতে ইচ্ছে করে।
বড়ো বুবু কত আদর করে, কত রকম খাবার আমার মুখের সামনে ধরে রেখে বলেছেন খেতে। তখন তার কাছে সন্তানের মতো আহ্লাদ করেছি, খেতে চাইনি। আর এখন এতো অবহেলার খাবার আমি এমনভাবে হাপুস হুপুস করে খাই যেন কোনো দিনও এমন খাবার খাইনি।
কী করে, কীভাবে, কাকে বলব আমি-কুসুম সাত ঝাকি দিয়ে যে খাবার আমাকে দেয়, তাতে আমার পেট ভরে না।
বয়স্ক মানুষ বলে প্রতিবেশিরা ভালো কিছু রান্না করে যদি আমাকে একটু দিতে আসে; কুসুম তাদেরও অনেক কথা শোনায়, ঝগড়া বাঁধিয়ে নেয়। আমার কাছে এখন আর তেমন কেউ আসে না। লুকিয়ে চুকিয়ে কেউ কেউ আসে একটু আধটু কথা বলে চলে রায়। আর আসে রায়হান সবার নজর এড়িয়ে। সন্ধ্যার পরে এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসে খাইয়ে দিয়ে তারপর চলে যায়।

আরও পড়ুন গল্প কপিশ নয়ন

শরিফুল বিদেশ চলে গেছে। মাঝে মাঝে ফোনে আমার সাথে কথা বলে। ফোন কানে ধরে এপাশ থেকে কথা বললে ওপাশের মানুষের কথা কত কাছে মনে হয়। ভেবে অবাক হলাম, পৃথিবী কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছে। তার সাথে সাথে পৃথিবীর মানুষের মন মানসিকতারও কত পরিবর্তন হয়েছে। কিছুদিন পরে শুনতে পেলাম শরিফুল নাকি সেখানেই বিয়ে করেছে। আর বলেছে, সে নাকি আর কখনও দেশে ফিরে আসবে না।
কুসুম চেচামেচি করছে, আর ছেলেকেসহ আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। আমি নাকি তার ছেলেকে এই কটুবুদ্ধি দিয়েছি।
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে নিশ্বাস নিলাম। আর আল্লাহর কাছে শরিফুলের সুখী জীবন প্রার্থনা করলাম। একটু আফসোসও করলাম এই বলে যে, আমি একটা মানুষ অথচ আমার ভালোবাসা, মায়া, মমতা দিয়ে কাউকে ধরে রাখতে পারলাম না।

রায়হান বিএ পাশ করল। চাকুরির জন্য খুব চেষ্টা করছে। সন্ধ্যার পরে আমার কাছে এসে বলল,
— দাদি, কাল সকালে আমি ঢাকায় যাব। আমার চাকুরির পরীক্ষা দিতে। আমাকে দোয়া করো।
আমি মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলাম।
— ভালো করে পরীক্ষা দিস।
— তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে করে? আমাকে বলো, আমি নিয়ে আসব।
—  (মৃদু হেসে) পাগল কোথাকার! তুই চাকুরি পেয়ে নে, তারপর বলব।
খাবার দিতে এসে কুসুম এ কথা শুনে ফেলেছে। অমনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে মুখে যা এল তাই বলল। খাবারের প্লেটটা অতদূর থেকে ছুড়ে দিতে দিতে বলল,
— উনার স্বভাবই এমন। সবসময় শুধু খাই খাই করে। নতুন করে আর কী খেতে ইচ্ছে করবে। উনার মুখ আর কুত্তার মুখ, দুই-ই সমান। সামনে যা দেওয়া যায় তাই খায়, কোনো বাছবিচার নাই।
কুসুম এত দিন অনেক কথা বলেছে কিন্তু আজকের এই কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এই কথা শোনার আগে যদি মাটি দু’ভাগ হয়ে যেত আর আমি তার ভেতরে ঢুকে যেতে পারতাম, তাহলে হয়তো ভালো হতো। রায়হানও মাথা নিচু করে থ হয়ে বসে রইল।

আরও পড়ুন গল্প গৃহবন্দি বিড়াল

রায়হান চলে যাওয়ার পরে আমার মুখে আর  ওই খাবার ঢুকল না। সারারাত খুব কাঁদলাম, আর নামাজে বসে আল্লাহর কাছে
বললাম,
— ও রিজিকের মালিক, আমার কপালে একথাও লেখা ছিল? এই পৃথিবীতে আমার খাবারই এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে আজ এমন কথা শুনতে হলো? এই হাতে কত মানুষের সামনে যে খাবার দিয়েছি, তার হিসেব নেই। আল্লাহ তুমি যদি আমাকে এতটুকু ভালোবেসে থাক, তো এদের কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দাও।

সকালে প্রতিবেশির এক বাচ্চা ছেলেকে দোকানে পাঠিয়ে একটা কলা আর পাউরুটি কিনে নিয়ে এলাম। পাউরুটিটা একটা পেপারে মোড়ানো ছিল। পেপারটা পড়ে দেখলাম, সেখান একটা বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা দেওয়া আছে। সুজানগর উপজেলার ছেলে; গাজীপুরে একটা বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলেছেন।
আমি তক্ষুনি সিদ্ধান্ত নিলাম, আর এখানে থাকব না।
রায়হানকে ডেকে বললাম কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হয় না। শেষে ওকে বললাম,
— তুই যদি আমাকে ওখানে না নিয়ে যাস তো আজ রাতেই আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব।
রায়হান আমার মুখ চেপে ধরল।
— দাদি, চলো তোমার বাপের বাড়িতে রেখে আসি। তবুও তুমি ওতো দূরে যেও না। তুমি সেখানে থাকতে পারবে না।
— না রে দাদু, আমি আর কারও বোঝা হতে চাই না। পৃথিবীতে একজন মানুষের কাছে সর্বোচ্চ অপমান হলো তার খাওয়া নিয়ে কথা বলা।
ততক্ষণে প্রতিবেশিরা অনেকেই এসে বাড়িতে ভিড় জমিয়েছে। তাদের কেউ কেউ চোখে পানি নিয়ে, আমার হাত ধরে বলল,
— আজ থেকে তুমি আমাদের কাছে থাক, খাওয়া দাওয়া করো, তোমার কোনো অযত্ন হবে না।
আমিও কাঁদতে কাঁদতে সবার হাত ফিরিয়ে দিলাম।
খোকন আর কুসুম অদূরে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনল কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্য করল না।

আরও পড়ুন গল্প জোছনা মাখা আলো

আজ তিন বছর হলো এই বৃদ্ধাশ্রমে আছি। এখানে যারা দেখাশোনা করে, ওরা বেশ ভালো। এখানে অনেকেই আছে, যাদের জীবনের গল্প শুনলে নিজের কষ্টটাকে কষ্ট মনে হয় না। তবুও মাঝে মাঝে মন ছুটে যেতে চায় সেই চিরচেনা সবুজ শ‍্যামল প্রাণপ্রিয় গ্রামের মাটিতে।
আমার এই রুমের জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। এখানে বসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে নিশ্বাস নিই আর এই ডায়রি লেখি, আমার জীবনের ডায়রি।
রায়হান নিয়ম করে প্রতি শুক্রবার আমাকে দেখতে আসে। আগামী শুক্রবারে আসবে না, চাকুরির পরীক্ষা আছে। আমি সব সময় ওর জন্য দোয়া করি। ও এখনও ভালো কোনো চাকুরি পায়নি, কাছেই একটা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করে আর টিউশনি করে। আমি কিছু খেতে চাই না, তবুও অনেক কিছু নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে গ্রামে যায়। ওর কাছে সবার খবর শুনতে পাই। খোকনের কথাও জিজ্ঞেস করি, কী করব, মাত‍ৃ হৃদয়কে প্রবোধ দিতে পারি না কিছুতেই। আমার খোকনেরও বেশ বয়স হলো কিন্তু নেশা আর জুয়ার ফোড়ে জমি বিক্রি করতে করতে প্রায় শেষ করে ফেলেছে। ভাগ্য ভালো, ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি আর ভাবি, খোকনকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারিনি। আমাদের আদর ভালোবাসায় এত ভুল ছিল?

আজ রায়হানের মুখটা উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করছে। দেখেই বুঝেছি চাকুরিটা হয়ে গেছে।
ও আমার কাছে বসে হাত ধরে বলল,
— দাদি, আমি এখানে পরিচালকের সাথে কথা বলে, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ব‍্যবস্থা করব।
আমি ওর মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলাম আর বললাম,
— দাদু রে, তুই ভালো চাকুরি পেয়েছিস। এখন বিয়ে করে সুখে সংসার কর। তোর জীবন সুন্দর হোক, আমি এই দোয়াই করি।
আমাকে নিয়ে ভাবিস না। জীবনের বাকি সময়টা আমি এখানে এভাবেই কাটিয়ে দিতে চাই।
রায়হানের চোখে পানি। ও কিছু বলতে চাইছিল, আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে ওর হাত দুটো ধরে বললাম,
— দাদু রে, তুই আমাকে যেভাবে দেখতে আসিস, সেভাবেই আসিস। তবে আজ একটা কথা দে ভাই, আমার মৃত্যুর প আমাকে নিয়ে তোর দাদা আর বড়ো বুবুর পাশে কবর দিবি।
রায়হান ফুপিয়ে কেঁদে উঠল।
— দেব দাদি…

আরও পড়ুন গল্প পেতনি

আমি নিজের কান্না আটকে রাখলাম। রায়হান আরো কিছুক্ষণ আমার কাছে বসে রইল। তারপর মন খারাপ করে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।
মাগরিবের আজান হলো। আমি নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে আকুল ফরিয়াদ জানালাম,
— হে আল্লাহ্, তোমার সৃষ্টির প্রতি উত্তম পরিকল্পনাকারী এবং উত্তম সাহায্যকারী একমাত্র তুমিই। তাই এই নশ্বর পৃথিবীতে, জীবনে কী পেয়েছি আর কী পাইনি, তা নিয়ে আজ আর কোনো আফসোস নেই। কারো প্রতি কোনো অভিযোগও নেই। আজ তোমার কাছে এই আচল পেতে একটা দয়াই ভিক্ষে চাই, এই পৃথিবীতে তুমি আমাদের তিনজনকে এক করে যেমন সুখে শান্তিতে রেখেছিলে, পরকালেও আমাদের তিনজনকে এক সাথেই রেখ।

আরও পড়ুন আলতা বানু-  
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

আলতা বানু (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!