আমার নানি
আমার নানি
~তাহমিনা খাতুন
‘মিতব্যয়িতার’ শিক্ষা পেয়েছিলাম আমার নানির কাছ থেকে। আমার নানি মারা গেছেন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে নানির একমাত্র সন্তান আমার মায়ের কাছে ছিলেন। সেই সময় একদিন নানিকে দেখলাম গোসলের পর নিজের পরনের বাসী ধুতি খানা বালতির অল্প পানিতে ধুয়ে নিচ্ছেন। নানি যতদিন বেঁচে ছিলেন আর সুস্থ ছিলেন সব সময় নিজের কাজ নিজেই করতেন।আমি নানির ধুতিটা ধুয়ে দিতে চাইলে তিনি কোনোভাবেই রাজি হলেন না। আমি নানিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “নানি এতো অল্প পানি দিয়ে কাপড় ধুচ্ছ কেন?” নানি জবাব দিলেন, “আল্লাহ্ তায়ালার কাছে তো একদিন এই পানির জন্যও হিসাব দিতে হবে।” সেদিনই একটা বড় শিক্ষা হয়েছিল আমার, আর তা হল ‘অপচয়কে’ ঘৃণা করা। আজ যখন চারদিকে প্রাকৃতিক অথবা কৃত্রিম সম্পদ অপচয়ের ‘অপোৎসব’ দেখি তখন মনে মনে ভাবি এতো এতো অপচয় দেখে নিশ্চয়ই আমার নানির আত্মা অনেক কষ্ট পাচ্ছে।
বর্তমান দুনিয়ায় আধুনিকতার নামে, জীবন-যাত্রা সহজ করার নামে, বিলাসী জীবন যাপনের নামে যেভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করা হচ্ছে,তার ভয়ঙ্কর পরিণতি আমরা খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছি। সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপনের আনন্দ মনে হয় ভুলে গেছে মানুষ! কৃত্রিম, জাঁকজমকপূর্ণ, মেকি জীবনের পিছনে আজকের পৃথিবীর ছুটে চলার প্রাণান্তকর প্রয়াস দেখে আমার নানির মত একজন নিরক্ষর মানুষের ভাবনার জগতের বিস্তৃতির কথা ভেবে সত্যিই খুব অবাক হই।
আরও পড়ুন গল্প রোদেলা দুপুর কাঁদে
আমার নানি নিরক্ষর হলেও ছিলেন একজন অসাধারণ আত্মমর্যাদাশীল, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ! আমার মায়ের যখন মাত্র এক বছর বয়স তখন আমার নানা মারা যান। আমার নানি বয়স তখন খুব বেশি হলে ১৫/১৬ বছর। এক বছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে সমাজের সমস্ত ভ্রকুটি, সমস্ত চোখরাঙানি, সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে আত্মমর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেছেন। কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি, কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি!
আজ থেকে প্রায় একশত বিশ বছর আগের একটি কিশোরী কতটা সাহসী, স্বাধীনচেতা এবং দৃঢ় মানসিক শক্তির অধিকারী হলে একটি শিশুকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার মত সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারে! আমার অকুতোভয় নানি সেই কাজটিই করে গেছেন। মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সের একজন কিশোরী, বছর খানেক বয়সের একটি শিশুকে নিয়ে মৃত স্বামীর ঘর ছেড়ে পিতার বাড়িতে আশ্রয় নেননি।
শ্বশুর-শাশুড়ি ছিলেন না, একজন ননদ ছিলেন যিনি সব সময়ই অসহযোগিতা করে গেছেন। আমার আত্মপ্রত্যয়ী নানি সব বাধাকে উপেক্ষা করে গেছেন নির্ভয়ে।
এমনকি একমাত্র কন্যা অর্থাৎ আমার মাকে বিয়ে দেওয়ার পরেও কন্যা-জামাতাকে (আমার পিতা-মাতা) নিজের বাড়িতে থাকতে বলেননি বা নিজে কন্যার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে থাকেননি। সারা জীবন একা, নিঃসঙ্গ থেকেছেন, কিন্তু কখনো কারো মুখাপেক্ষী হননি।
আরও পড়ুন গল্প পথভোলা এক পথিক
মায়ের মুখে নানির অসীম সাহসিকতার কত গল্প শুনেছি। আমার মায়ের তখন খুবই অল্প বয়স। নানির বাড়িটি ছিল মূল পাড়া থেকে একটু দূরে। একদিন গভীর রাতে কোন শব্দে নানীর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল দেখতে পেলেন বিশাল দুটি গোখড়ো সাপ ঘরের মেঝের উপর ফনা তুলে বসে আছে! আমার বুদ্ধিমতী নানি কোন শব্দ না করে শিশু কন্যাকে নিয়ে ধৈর্য্য ধরে চুপচাপ বিছানার উপর বসে থাকলেন। গোখড়ো দুটি কিছুক্ষণ পরে একটা গর্তের ভিতর ভিতরে ঢুকে গেল! শিশু কন্যাকে নিয়ে সারা রাত জেগে বসে থাকার পর সকালে প্রতিবেশীদের ঘটনাটি জানালে তাঁরা নানির ঘরের মাটির মেঝে খুঁড়ে বিশালাকৃতির দুটি গোখড়ো সাপ মেরেছিলেন।
পরবর্তীতে নানি তাঁর পুরনো বাড়ি ছেড়ে নতুন একটা বাড়ি তৈরি করে সেই বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। আমাদের বাড়ি আর নানির বাড়ি ছিল একই গ্রামের এপাড়া আর ওপাড়া। আমরা ভাই বোনেরাই ছিলাম নানির এক মাত্র কন্যার সন্তান। একমাত্র কন্যার সন্তান হওয়ার কারণে আমরা ছিলাম নানির স্নেহ সুধায় ভরপুর! নানির বাড়িতে যাওয়া আসার জন্য আমাদের বাধা-ধরা কোন সময় ছিল না। প্রায় প্রতিদিন নানির বাড়িতে একবার ‘ঢু’ দেওয়া ছিল আমাদের কাজ। আমার ছেলেবেলায় যখন নানির বাড়িতে যেতাম, বেশ ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু পায়ে চলা রাস্তা ধরে যেতে হত। তখন বাড়ি ঘরও ছিল খুব কম। প্রায় প্রতিদিনই বিকাল হলেই যেতাম নানির বাড়িতে। কিছুক্ষণ নানীর সাথে কাটিয়ে সন্ধার আগেই সেই বুনো পথ ধরেই বাড়ির পথ ধরতাম। আমার স্নেহশীল নানি খানিকটা পথ এগিয়ে দিতেন এবং আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না দৃষ্টির আড়ালে যেতাম, ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতেন! কত বছর পার হয়ে গেছে, আজও নানির স্নেহ সুধা ভরা দৃষ্টি যেন আমাকে অনুসরণ করে চলেছে!
আরও পড়ুন গল্প পক্ষিরাজের ডানা
নানি ছিলেন খুবই পর্দাশীল। মাথার ঘোমটা কপালের উপরে উঠতে দেখিনি কখনও। আমাদের বাড়িতে কৃষি কাজ ছিল। কাজের প্রয়োজনে আমাদের বাড়িতে কৃষি শ্রমিকদের আসা-যাওয়া করতে হতো। এ কারণে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা বা অতিথি হয়ে থাকা নানির জন্য একেবারেই অসম্ভব ছিল। এলেও কিছু সময়ের জন্য থেকেই নিজের একা গৃহে ফিরে যেতেন।
প্রকৃত ধার্মিক বলতে যা বুঝায়, নানি ছিলেন তাই। শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ধর্মচর্চা নয়, গভীর ধর্ম বিশ্বাস এবং আন্তরিকতা ছিল তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তি! শূকুর একটি প্রাণী। ইসলাম ধর্মে শূকুর একটা নিষিদ্ধ প্রাণী। নানি বিশ্বাস করতেন শূকরের নাম উচ্চারণ করলে একজন মুসলমানের মুখ চল্লিশ দিন পর্যন্ত অপবিত্র থাকে! এ কারণে নানিকে কোনোদিনও শূকুর শব্দটি উচ্চারণ করতে শুনিনি! প্রয়োজন হলে বলতেন ‘জংলা প্রাণী’।
আমার ধর্মপ্রাণ নানিকে সব সময় বলতে শুনেছি, “আল্লাহ পাক তুমি আমাকে ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু দিও। আমাকে যেন কারও মুখাপেক্ষী হয়ে বাঁচতে না হয়।” পরম করুণাময় হয়তো নানির সব সময়ের চাওয়া, সেই প্রার্থনাই কবুল করেছিলেন। আর সে কারণেই তিন/চার দিনের সামান্য জ্বরে ভুগে আমার স্নেহশীল নানি ইহজগতের মায়া কাটিয়ে পরজগতের বাসিন্দা হয়েছেন।
আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-
দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আত্রাই নদী
আমার বাবা
আমার মা
ভাই-বোনদের কথা
আমার শিক্ষাজীবন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো
যেভাবে আইনজীবী হলাম
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
সংসার ও আইনজীবী জীবন
পাশের বাড়ির আপনজন
প্রথম শহর দেখা ও প্রথম বিদেশ ভ্রমণ
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু
মধুর স্মৃতি
স্নেহশীল কজন
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
আমার নানি