আমাদের দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আমাদের দ্বারিয়াপুর গ্রাম
তাহমিনা খাতুন
পাবনা জেলার তৎকালীন সুজানগর থানার দ্বারিয়াপুর গ্রামে আমার জন্ম। পাবনা তখন দুই মহকুমা বিশিষ্ট বৃহত্তর জেলা। তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের সতেরটি জেলার মধ্যে দুই মহকুমা বিশিষ্ট একটি জেলা পাবনা। পাবনা সদর ও সিরাজগঞ্জ। মূল পাবনা জেলার সদর অংশে আমার জন্ম। আমাদের গ্রামটির অবস্থান পাবনা শহর থেকে পাবনা-রাজশাহী হাইওয়ের ছাব্বিশ মাইলের মাইল ফলকের সাথেই। শহরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার অভাবকে যদি প্রত্যন্ত গ্রাম বা অজপাড়া গাঁ হিসাবে মূল্যায়ন করতে চাই, তবে দ্বারিয়াপুরকে ‘প্রত্যন্ত গ্রাম’ বা ‘অজপাড়া গাঁ’ বলা যাবে না। আবার শিক্ষা ব্যবস্থা বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার দিক থেকে বিবেচনা করলে দ্বারিয়াপুরকে গণ্ডগ্রামও বলা যাবে না। কারণ আমার জন্মের বহুকাল আগেই দ্বারিয়াপুর গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কাজেই দ্বারিয়াপুর গ্রামের বাসিন্দারা আশ-পাশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের মত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল না।
সব গ্রাম বা স্থানের পূর্বাপর কোন ইতিহাস বা কিংবদন্তী থাকে। দ্বারিয়াপুর নামটির ও এমন ইতিহাস বা কিংবদন্তী রয়েছে। দরিয়া বলতে বিশাল জলাধারকেই বুঝায়।দরিয়া থেকে উত্থিত বা জেগে ওঠার কারণে হয়তোবা এই নামকরণ।শোনা যায়, আত্রাই নদী এক সময় ছিল এক প্রমত্তা দরিয়া বা নদী! কালের পরিক্রমায় এক সময়ের প্রমত্তা আত্রাই বাংলাদেশের আরও অনেক নদীর মতই শুকিয়ে শীর্ণকায়া এক নদীতে পরিণত হয়েছে। দ্বারিয়াপুর হয়তো কখনো দরিয়াপুর ছিল। লোকের মুখে মুখেই দরিয়াপুর হয়ে গেছে দ্বারিয়াপুর!
আরও পড়ুন আত্মকথন
আমার জন্মের অনেক আগে থেকেই আমার ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই ছিলেন সরকারী চাকুরীজীবী অথবা শিক্ষক। আবার আমার বাবার কাছে শুনেছি আমার আপন ফুফা কাজী মোফাজ্জল হোসেন (যাঁকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি) ওই সময়ে একজন সমাজ সেবক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর চেষ্টায় বৃটিশ আমলেই আমাদের গ্রামে একটি পুলিশ ফাঁড়ি, একটি ডাকঘরও স্থাপিত হয়েছিল। অবশ্য ফুফার মৃত্যুর পর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পুলিশ ফাঁড়িটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং আরো কিছুদিন পর ডাকঘরটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আরো একটি কারণে আমাদের গ্রামটি ব্যতিক্রম ছিল। আর তা হল আমার জন্মের বহু বছর আগে থেকেই ‘দ্বারিয়াপুর ক্রিসেন্ট ক্লাব’ নামে একটি ক্লাব ছিল এবং ক্লাবটির সাথে একটি লাইব্রেরিও ফুফার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও ওই ক্লাবটির নিজস্ব কোন ভবন ছিল না।
ফুফার বাড়ির একটি কামরায় বড় বড় দুটি কাঠের আলমারিতে ক্লাবের জন্য কিছু বই, বৃটিশ আমলে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ইত্যাদি সংরক্ষিত ছিল। মাসিক বা ত্রৈমাসিক সেটা মনে নাই তবে সওগাত, মাসিক মোহাম্মদী, মাহে নও, মিল্লাত প্রভৃতি পত্রিকা এবং সেই আলমারি দুটিতে সংরক্ষিত বই-পত্রই ছিল ‘দ্বাড়িয়াপুর ক্রিসেন্ট ক্লাব’ এর ক্ষুদ্র পাঠাগার। লাইব্রেরিটির সংগ্রহ যত সামান্যই হোক না কেন, ওই সময়ের সামান্য সংগ্রহই ছিল রীতিমত ‘হীরের খনি’। কারণ ওই টুকু সংগ্রহের কারণে আমাদের মধ্যে পড়ার এবং জানার যে আগ্রহ শৈশবে তৈরি হয়েছিল, আমাদের মননে এবং চিন্তায় তার যে প্রতিফলন ঘটেছিল, তার সুফল আমরা আজও ভোগ করছি। শুধু আমাদের পরিবার নয়, আমাদের পাড়ায় বসবাসকারী সবাইকে ছোট্ট এই লাইব্রেরির অবদান চিরদিন মনে রাখতে হবে-সন্দেহ নাই। এবং সেই সাথে মনে রাখতে হবে আমার সমাজ হিতৈষী ফুফা মরহুম কাজী মোফাজ্জল হোসেন সাহেবের অবদানের কথা!
আরও পড়ুন ভাষা নিয়ে ভাবনা
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যখন দ্বারিয়াপুর গ্রাম সহ পাবনা-নগরবাড়ি হাইওয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি ভস্মীভূত করে তখন আমাদের জ্ঞানের বর্তিকা ক্ষুদ্র লাইব্রেরিটিও ভস্মীভূত হয়।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পাবনা-নগরবাড়ি হাইওয়ের ছাব্বিশ মাইলের ফলকটির পাশেই ছিল এবং এখনও সেখানেই আছে। আমরা যখন এই স্কুলটিতে লেখাপড়া করতাম, তখন স্কুল ঘরটির বেহাল দশা। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আমার শ্রদ্ধেয় চাচা মরহুম আবুল হাশেম সাহেবের দান কৃত জমির উপরে শুধুমাত্র টিনের একটি দোচালা ঘরে বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়ে ছিল। তবে স্কুলটির সামনে ছিল বেশ বড় একটি খেলার মাঠ। খেলার মাঠটিও ছিল ফুফার দান করা জমির উপরেই। এই মাঠটিতে প্রতিবছর স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। এছাড়া দ্বারিয়াপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য কোনো গ্রামের বিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হত এই মাঠটিতে। স্কুলের খেলাধূলা ছাড়াও প্রায় দিনই বিকেলে ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হত। আশে-পাশের লোকজনও ভিড় করত এইসব খেলা উপভোগের জন্য।
আমাদের শৈশবে প্রযুক্তির সর্বনাশা ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়নি। কাজেই প্রকৃতির খোলা প্রান্তরে, অবারিত মাঠে নিষ্কলুষ আনন্দের মাঝে প্রকৃতির সন্তান হিসেবেই বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা! কাজেই দ্বারিয়াপুর বিদ্যালয়ের খেলার মাঠটির অবদানও আমরা ভুলতে পারব না কোনদিনই। আজ যখন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের শহর কেন্দ্রিক ছেলে-মেয়েদের খেলার মাঠ বিহীন, খেলাধূলা, শরীরচর্চার সুযোগ বিহীন, প্রাকৃতিক বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা বিহীন চার দেয়ালের ঘেরাটোপে বন্দি শ্রেণি কক্ষে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়, তাদের কাছ থেকে মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ আচরণের প্রত্যাশা করা অন্যায়। প্রাচুর্য আর বিলাসিতার হাতছানিতে দিশেহারা মানুষ অর্থ-বিত্ত আর আরাম-আয়েশের সন্ধানে আজ নিজের সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের চিন্তা করতেও যেন ভুলে গেছে। নিষ্পাপ, অবোধ শিশুর হাতেও তুলে দিচ্ছে মোবাইল, কম্পিউটারের মতো সর্বনাশা সব প্রযুক্তি!
আরও পড়ুন সমকালীন ভাবনা
গ্রামের স্কুল ঘরটির কোন পাকা দেয়াল তো দূরের কথা, কোন বেড়াও ছিল না। শ্রেণি কক্ষগুলোর মধ্যে কোন পার্টিশনও ছিল না। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষকেরা যার যার ক্লাস নিতেন। প্রতি শ্রেণির জন্য দুই বা তিনটি বেঞ্চ ছিল। পঞ্চম শ্রেণির জন্য নির্ধারিত দুটি বেঞ্চের সাথে হাই বেঞ্চ ছিল। আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, সেই সময় বিদ্যালয়টির জন্য পাকা ভবন তৈরি হল। কিন্ত দুর্ভাগ্য! আমার বা আমার সহপাঠিদের আর ক্লাস করা হয়নি পাকা বিদ্যালয় ভবনটিতে! শুধু মনে আছে একদিন টিফিন পিরিয়ডে খুব যত্ন করে নতুন পাকা ভবনটি ঝাঁট দিয়েছিলাম। এত প্রতিকূলতা সত্বে ও আমাদের শিক্ষকেরা যেভাবে আমাদের পড়াতেন, তাঁদের জ্ঞানের পরিধি এবং শেখানোর পদ্ধতি এ সময়ে বিরল। এ সময়ে শিক্ষাকে যেভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে, আমাদের আদর্শবান শিক্ষকগণ সেটা কল্পনাতেও আনতেন না।
বর্তমান প্রাথমিক বিদ্যালয়টির পাশেই আমার তৃতীয় ভাই মরহুম খোন্দকার আবুল খায়ের, চাচাতো ভাই খোন্দকার মকবুল হোসেন এবং আত্রাই নদীর ওপারের গ্রামের বাসিন্দা মরহুম আবু বক্কর সাহেবের চেষ্টায় ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মূলত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা যাতে সহজে গ্রামের বিদ্যালয় থেকেই মাধ্যমিক লেখাপড়া শেষ করে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়, সে লক্ষ্য নিয়েই আমার ভাই সরকারী চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন এবং উল্লেখিত দুই মহৎ হৃদয়ের অধিকারী মানুষকে সহযোগী হিসেবে পেয়েছিলেন। তাঁরা তিন জন স্কুলের অনুমোদন সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে বেশ কয়েক বার ঢাকায় এলে আমার ঢাকার বাসায় অবস্থান করতেন। সে কারণে তাঁদের সেই মহতী উদ্যোগের আমিও স্বাক্ষী হয়ে আছি। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে শুধু দ্বারিয়াপুরের ছেলে-মেয়েরাই নয়, আশে পাশের গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও ছোট ভাইয়ের অক্লান্ত চেষ্টায় গড়া স্কুলটি থেকে স্কুল সমাপনী পরীক্ষায় পাশ করে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে!
আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-
আত্রাই নদী
আমার বাবা
আমার মা
ভাই-বোনদের কথা
আমার শিক্ষাজীবন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো
যেভাবে আইনজীবী হলাম
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
সংসার ও আইনজীবী জীবন
পাশের বাড়ির আপনজন
আমার নানী
প্রথম শহর দেখা ও প্রথম বিদেশ ভ্রমণ
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু
মধুর স্মৃতি
স্নেহশীল কজন
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
আমাদের দ্বারিয়াপুর গ্রাম