আতু
গল্প,  শাহানাজ মিজান

আতু // ছোটোগল্প // শাহানাজ মিজান

আতু 
• শাহানাজ মিজান

বাড়ি থেকে অফিস বেশ দূরে, প্রতিদিন গ্রামের কাঁচা রাস্তায় তিন মাইল পথ হেঁটে এসে তবেই গাড়ি ধরতে হয়। আর আতুও প্রতিদিন একজন সচেতন অভিভাবকের মতো আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে তারপর বাড়িতে ফিরে যায়।
বারণ করলেও শোনে না, ধমক দিলে অসহায় চোখে আমার দিকে এমনভাবে তাকায়; মায়া লাগে, তখন আর কিছুই বলতে পারি না। কিছুদিন আগেও, ও আমাকে এগিয়ে দিয়ে একা একা বাড়িতে ফেরার পথে ভিন গাঁয়ের একদল হিংস্র কুকুর ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আঁচর আর কামড়ের যন্ত্রণায়, দশ-বারো দিন খুব অসুস্থ ছিল।
অফিস থেকে ফেরার সময় হলে ও ঠিক সময়ে বড়ো গাছটার নিচে বসে অপেক্ষা করে। ওকে আদর করলে আমার পায়ের কাছে লেজ নাড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, মুখে উঁ উঁ শব্দ করে। আমি একজন ভেটেরিনারি ডাক্তার সফিক, আতু আমার পোষা কুকুর।

বাড়ির কাছেই আমার একটা ওষুধের ডিস্পেনসারি আছে, আজ রোগীদের মালিকদের খুব ভিড়। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আমার ছোট্ট মেয়ে রুশা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আসছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম, ও হেঁচকি তুলে বলছে,
“বড় চাচি আতুর গায়ে গরম ভাতের ফ‍্যান ঢেলে দিয়েছে, আতু যন্ত্রণায় ভেউ ভেউ করে কাঁদছে।”
আমি দৌড়ে চলে গেলাম। গ্রামের বাড়িতে ছেড়ে রাখা পোষাপ্রাণীকে সব সময় চোখে চোখে রাখা সম্ভব হয় না; ওরাও থাকে না। কোথায় কোথায় ঘুড়ে বেড়ায়, আবার ফিরে আসে।
আমার স্ত্রী সুফিয়া আতুর গায়ে ঠাণ্ডা পানি ঢালছে। আমাকে দেখেই কেমন অসহায় চোখে তাকাল।
আমি ওর গায়ে ওষুধ লাগিয়ে দিতে দিতে বড়ো ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
“আতু, আজ যদি তুই বাঘ-সিংহ হতিস, মানুষ তোকে দেখে ঘরের সিটকিনি আটতো। কুকুর হয়ে জন্মেছিস, বোবা প্রাণী, তোর সাথে যা ইচ্ছে তাই করা যায়। কতবার বলেছি, সাবধানে থাকবি, আমার কোনো কথা তুই শুনিস না। আর যদি কখনো আমার কথার অবাধ‍্য হোস, তবে তোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেব।”
আতু মুখে উঁ উঁ শব্দ করে আমার কোলো মাথা গুজে আরামে চোখ বন্ধ করে রইল।
বড়ো ভাবি মুখে ভেঙচি কেটে বলে গেল, সে ইচ্ছে করে এটা করেনি।

আরও পড়ুন গল্প লালু

পোড়া চামড়া উঠে দগদগে ঘা হয়ে গেল, শরীরটা বেশ দূর্বল হয়ে গেছে। ওর গা থেকে বিদঘুটে একটা গন্ধও বের হয়। রুশা ছোটো বাচ্চা, আতুর গলা জড়িয়ে ধরে খেলে, ওর মুখে চুমু দেয়। পাছে ওর থেকে রুশার কোনো ইনফেকশন না হয়ে যায়, এই ভেবে সুফিয়া আমাকে বলল,
“আতুকে ফেলে দিয়ে আসতে।”
আমি রক্ত চক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আজ যদি ও তোমার সন্তান হতো, একথা বলতে পারতে?”
অবশ‍্য সুফিয়াও এতটা নিষ্ঠুর নয়। আমি যে রুশার কথা ভাবছি না, তাতো নয়। কিন্তু কী করব। অফিসের পরে এসে যতটা পারি ওকে যত্ন করে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করি।

আমার আতু খুবই বুদ্ধিমান। গ্রামের ছেড়ে রাখা কুকুরদের সাথে মিশে ঠিকই, কিন্তু কখনো কারো রান্নাঘরে ঢোকে না। ওর সামনে কোনো খাবার আলগা থাকলেও কখনো তাতে মুখ দেয় না। ওর নিজের খাবার দিলে ও খেতে বললে তবেই খায়।

এখন ওর শরীর এতটা খারাপ, রুশা ওর কাছে যেতে চাইলেও দৌড়ে দূরে সরে যায়, দূর থেকেই খেলে। ও আদর ভালোবাসা খুব বোঝে। এবার ওর সুস্থ হতে অনেক সময় লেগে গেল।

আজ ছুটির দিন, জুম্মার নামাজ পড়ে বাড়িতে ফিরে খেতে বসব, আতুকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। সুফিয়া-রুশা ওরাও নাকি অনেকক্ষণ ধরে ওকে খুঁজছে।
আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। একবার আতু বলে ডাকলে যেখানেই থাকুক না কেন, দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। অথচ এত ডাকছি ও সাড়া দিচ্ছে না, তাহলে আজ কোথায় গেল!

আরও পড়ুন গল্প মিষ্টি স্বপ্ন

এমন সময় বড়ো ভাবি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো, তার চোখে পানি। বলল,
“আতু নাকি কলা বাগানে শুয়ে গোঙারাচ্ছে, আর ওর মুখ দিয়ে লালা ঝড়ছে।”
দৌড়ে গেলাম, ওর গায়ে হাত দিতেই চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। ও খুব কাঁদছে, চোখের পানি ঝড়ছে। ওর সামনের পা দুটো আমার সামনে ওঠাতে চেষ্টা করল। বুঝতে পারলাম ওর আর সময় নেই। প্রতিবেশীরা অনেকেই এখানে উপস্থিত, একটা ছেলে বলল,
“ওই পাড়ার বিশ্বাসদের বাড়িতে নাকি কুকুরের উৎপাত বন্ধ করতে খাবারের সাথে বিষ দিয়ে খেতে দিয়েছে। আদর করে ডেকেছে, সবগুলো কুকুরই ওই খাবার খেয়েছে, তার মধ্যে আমার আতুও ছিল।

কথাটা শুনে কষ্টে আমার বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। আমি আতুর পা দুটো ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। বললাম, “তুই আদর বুঝিস, ভালোবাসা বুঝিস, অথচ এই পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষের বেঈমানি বুঝলি না আতু। আমি যার বান্দা, তুইও তো তারই সৃষ্টি। তোর প্রতি এই নিষ্ঠুরতার বিচার তার কাছেই বলিস। তুই আমাকে কী বলতে চাইছিস, আমি তোর ভাষা বুঝতে পারছি না। কিন্তু তুই তো আমার সব কথা বুঝতে পারছিস। আমাকে ক্ষমা করে দিস আতু, আমি তোকে রক্ষা করতে পারলাম না।
আতুর শেষ নিশ্বাস ফুরিয়ে গেল। ওর নিথর দেহটা আমার সামনে। ওর খোলা চোখ দুটো এখনো আমার দিকে তাকিয়ে জ্বলজ্বল করছে। যেন আমার কাছে ওর অনেক কথা বলার ছিল।

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!