অন্ধকারে-জ্বলে-দীপশিখা-শেষ-পর্ব
খলিফা আশরাফ (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

অন্ধকারে জ্বলে দ্বীপশিখা (শেষ পর্ব)

অন্ধকারে জ্বলে দ্বীপশিখা (শেষ পর্ব)

খলিফা আশরাফ

 

মেম্বারের ছেলেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে এভাবে আপোসে রাজি হয়ে গেলো। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
── ঠিক আছে, আমি একটু শুকুর আলির সাথে কথা বলে নেই। আমার মনে হয়, তার পাছেও শিক্ষিত লোক আচে। তা না হলি সে DNA টেস্ট বুঝতো না। সে জন্যে, সব গোপন ভাবেই করা লাগবি। তোমরা এখন যাও, খবর দিলি আসো।
পরদিন সকালে শুকুর আলিকে আসবার জন্য খবর দিলেন তিনি। শুকুর আলি কাজ কাম সেরে বিকালে এলো। চেয়ারম্যান সাহেব তাকে নিয়ে একা বসলেন। মেম্বারের ছেলেদের সাথে আলোচনার কথা গোপন রেখেই বললেন,
── দ্যাখো শুকুর আলি, তোমরা সগলেই আমার আপন। তুমি রাজি থাকলি আমি একটা মীমাংসা করে দিতে চাই।
শুকুর আলির গলায় আগের মতোই একগুঁয়ে সুর,
── আপোষ করতি অসুবিধ্যা নাই। তয় আমার এক কতা, আমার মা’রে মান্যা নিলি আমার কুনু আপিত্তি নাই। তা না অলি আমি কেচ করচি, কেচে যা অয় অবি।
── আমি তোমার সাথে একমত। কিন্তু মেম্বারের ছাওয়াল মিয়া কি তাদের সম্পত্তির কোন অংশীদার মান্যা নিবি?
চাল চাললেন চেয়ারম্যান।
── আমি তো তাগো কুনু সম্পত্তি চাইন্য্যা। খালি মেম্বর মানসির মদ্দি কোক, আমি তার ছাওয়াল, আমার মা অসতি না। আর কিচু লাগবিন্যা আমার।
অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললো শুকুর আলি।
চেয়ারম্যান সাহেব তার দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন,
── তাহলে তুমার কথায় বিশ্বাস করে আমি মেম্বারের ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলবো?
কষ্ট মিশ্রিত হাসি হাসলো শুকুর আলি,
── চিয়ারম্যান সাব, আমি গরীব হব্যার পারি, কিন্তুক লোবি বা মুনাফেক না। এই দ্যাহেন ( লুঙ্গির ট্যাঁক থেকে অতি জীর্ণ দলানো মোচড়ানো একটা ছবি বের করে ) এইড্যা হল আমার মা। সব সুমায় আমার সাথে থাহে। আমার শক্তি, আমার বেহেস্ত। এই মা আমার জন্যিই বাঁচ্যা ছিলো। আমারে জনম দিয়েই গলায় দড়ি দিচে। আমার যুদ্দু আমার মা’র জন্যি। মেম্বর মা’রে মান্যা নিলিই আমার আর কুনু দাবী নাই।

আরও পড়ুন গল্প লালু

শুকুর আলির চোখ বেয়ে অবিরাম অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার মাতৃভক্তি দেখে চেয়ারম্যান সাহেবের চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। একজন অশিক্ষিত কুলির মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা তাকে অভিভুত করলো। অথচ সে কোনদিন তার মাকে দেখে নাই, মায়ের স্নেহ যত্ন পায় নাই। শুধু শুনেছে মায়ের কথা। আর আমারা অকৃতজ্ঞ শিক্ষিত মানুষগুলো উপরে উঠলেই মা বাবাকে ভুলে যাই, দূরে ঠেলে দেই, কখনো কখনো অস্বীকারও করি। কিন্তু শুকুর আলি শুধু মায়ের সম্মানের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ নির্দ্বিধায় পায়ে ঠেলে দিচ্ছে। একটুও ভ্রূক্ষেপ নাই তার। কুলি শুকুর আলির মহত্বের কাছে নিজেকে খুব ছোট আর স্বার্থপর মনে হল চেয়ারম্যানের। চেয়ার থেকে উঠে ক্রন্দনরত শুকুর আলির কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। তার মাথায় হাত রেখে বললেন,
── তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছো শুকুর আলি। আমি তোমাকে সালাম জানাই। আজ থেকে আমি তোমার ভাই। দায়িত্ব আমি নিলাম, যা করার আমিই করবো।
শুকুর আলিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন চেয়ারম্যান। তাঁর বুকে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শুকুর আলি।
এরপরে মেম্বার এবং তাঁর সন্তানদের সাথে যা আলোচনা তা চেয়ারম্যান সাহেবই করেছেন, শুধু শুকুর আলিকে জানিয়েছেন, সব ঠিকঠাক মতোই এগুচ্ছে। শুকুর আলি সব ঘটনা হেড স্যারকে জানিয়েছেন। সব শুনে তিনি শুধু শুকুর আলিকে একটি প্রশ্নই করেছিলেন,
── তুমি কি তোমার ন্যায্য অংশও ছেড়ে দিয়েছ?
── হ স্যার, মা’র ইজ্জতের সাতে কোন শর্ত থাহা ঠিক না।
খুব সহজ উত্তর শুকুর আলির। ওর উত্তর শুনে একেবারে থ বনে গিয়েছিলেন হেড স্যার। সারাজীবন তিনি নৈতিকতার পাঠ দিয়েছেন, আজকে নতুন পাঠ নিলেন ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া কুলি শুকুর আলির কাছ থেকে। আনন্দে উদ্ভাসিত হল তাঁর মুখ। তিনি মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন শুকুর আলিকে।

আরও পড়ুন গল্প রাজামারা

দিন সাতেকের মধ্যেই সভা ডাকলেন চেয়ারম্যান সাহেব । সকল মেম্বার ছাড়াও এলাকার গন্যমান্য লোকদের ডাকা হল। আনুমানিক ৫০/৬০ জন। বিকাল ৪ টায় ইউনিয়ন পরিষদে। কিন্তু ৩টা থেকেই লোক আসা শুরু হয়ে গেলো। সবই অনাহুত উৎসুক লোক। চারিদিকে চাউর হয়েছে, মতিন মেম্বারের অবৈধ সন্তান শুকুর আলি ২৭/২৮ বছর পরে বৈধতা পাচ্ছে। দেখতে দেখতে ৪ টার মধ্যে প্রায় হাজার লোকের সমাগম হয়ে গেলো। স্থানাভাবে চেয়ারম্যান সভা নিয়ে গেলেন পাশের স্কুলের মাঠে। স্কুলের বারান্দায় টেবিল পেতে চেয়ারম্যান আর গন্যমান্য কিছু লোক বসলেন, নিচেও বেঞ্চ দেয়া হল। কিন্তু বেশিরভাগ লোককেই দাঁড়িয়ে থাকতে হল। শোনার সুবিধার্থে মাইকের ব্যবস্থা করেছেন চেয়ারম্যান।
চেয়ারম্যান সার্বিক বিবেচনায় সভাকে সংক্ষিপ্ত করতে চাইলেন। শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট মেম্বার, তাঁর বড় ছেলে আর শুকুর আলি কথা বলবেন।
সূচনা বক্তব্যে চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
── আপনারা শুনেছেন, শুকুর আলি আমাদের শ্রদ্ধেয় মেম্বার মতিন সাহেবের বিরুদ্ধে তার মা’র স্বামীত্ব এবং তার পিতৃত্ব অস্বীকারের মামলা করেছে। আমরা উভয় পক্ষকে নিয়ে আলোচনা করে তাদের সন্মতিতে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। যেহেতু বিষয়টা খুব জটিল এবং প্রায় ২৭/২৮ পরে উত্থাপিত, তাই শুকুর আলি সকলের সামনে ফয়সালা চায়। সেজন্যেই এই সভা ডাকা। তাদের ফয়সালা তাদের মুখ থেকেই আপনারা শুনবেন। আমি প্রথমে মেম্বর সাহেবের বড় ছেলেকে এ ব্যাপারে তার বক্তব্য দেবার জন্য অনুরোধ করছি।
মেম্বারের বড় ছেলে কাসেম বলেলো,
── ব্যাপারটা আমাগের জন্যি খুব লজ্জার। কিন্তু যেহেতু আমার বাপ বলচেন, তিনি শুকুর আলির মারে আল্লাহ সাক্ষী রাখ্যা বিয়্যা করচিলেন, তাই আমরা শুকুর আলিরে বড় ভাই হিসেবে মান্যা নিলাম।
চারিদিকে মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত হল। করতালি থামলে সে আবার বললো,
── তয় শুকুর আলি আমার বাপের সয়সম্পত্তির কুনু ভাগ পাবিন্যা। এই শর্তেই আমরা তারে ভাই মান্যা নিচি।
বসে পড়লো সে। আনন্দে উদ্বেলিত মানুষের মধ্যে হঠাৎ চাঞ্চল্য দেখা গেলো। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। কেউ কেউ প্রতিবাদ করলো, এটা অন্যায় বিচার, আমরা মানি না। চেয়ারম্যান সাহেব শুকুর আলিকে মাইকে তুলে দিলেন।

আরও পড়ুন গল্প কবর

সে খুব শান্ত ভাবে বললো,
── এইড্যা ছোডভাই কাসেমের কুনু দুষ নাই। ইডাই আমাগের ফয়সালা। আমি পরমান করব্যার চাইচিলাম, আমার মা অসতি না, মতিন মেম্বার তারে আল্লাহ সাক্ষী রাখ্যা বিয়্যা করচিলো, আমি তার ছাওয়াল। সেইড্যা মেম্বার সা’ব মান্যা নিচে। আমি আমার মার ইজ্জত ফির‍্যা পাইচি। আপনারা সগলে সাক্ষী। আমার আর কিচু দাবী নাই। মা’র কাচে সম্পত্তির কুনু দাম নাই।
মাইক ছেড়ে শুকুর আলি মতিন মেম্বারকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই মেম্বার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। পিতা পুত্রের মিলন হল ২৭/২৮ বছর পর। সে এক অভুতপূর্ব দৃশ্য! কান্নার ফোঁস ফোঁস শব্দ। অশ্রুজলে ভিজে যাচ্ছে তারা। হাজার করতালিতে বরিত হল পিতা পুত্র।
হাতের তালুতে চোখ মুছে মাইক হাতে নিলেন মেম্বার সাহেব,
── আমি আপনাগের কাচে মাপ চাই। সব দুষ আমার। আমি আল্লারে সাক্ষী রাহ্যা বিয়ে কর‍্যাই শুকুর আলির মা’র সাতে মিলামিশা করচি। শুকুর আলি আমার বড় ছাওয়াল। আমি তারে বুকি টান্যা নিলাম।
চোখ মুছে তিনি আবার বললেন,
── আমার বড় ছাওয়াল শুকুর আলি কইচে, মা’র ইজ্জত পাইচে সে, আর কিচু চায় না। আমার মাঝ্যা ছাওয়াল কাশেম আর অন্য ছাওয়াল মিয়াও তাই কয়। আপনেরা কি কন? আপনাগের মতামত কি?
শত শত কণ্ঠে আওয়াজ এলো,
── শুকুর আলির হিস্যা দ্যান।
── হ, এইড্যাই ইমানের কতা। সগল ছাওয়াল মিয়ার মতো হেও সম্পত্তির অংশীদার। আমি তারে অনেক ঠগাইচি,অনেক কষ্ট দিচি। শ্যাষ বয়াসে প্রায়চিত্তির করা দরকার।
তার এই বক্তব্যে কাশেম আর শুকুর আলি দুইজনেই অবাক করেছে। অবাক হয়েছেন হেড স্যারও। শুধু চেয়াম্যান সাহেব মুচকি মুচকি হাসছেন। উপস্থিত জনগনের মধ্যে উৎফুল্লতা। মেম্বার সাহেব পকেট থেকে একটা কাগজ বেড় করলেন। বললেন,
── এইডা এটা দলিল, রেস্ট্রিরি করা। আমার সগল সয়সম্পত্তির দুই আনা বাদ দিয়্যা সাড়ে চার ভাগের এক ভাগে মালিক শুকুর আলি। আমি তারে এই দলিলি সব লিহ্যা দিচি। আপনাগের সগলের সামনি দলিলডা তার হাতে তুল্যা দিলাম।
মেম্বার সাহের শুকুর আলিকে ডেকে এনে দলিলটা হাতে দিলেন। চারিদিকে তখন করতালির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন অন্ধকারে জ্বলে দ্বীপশিখা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

অন্ধকারে জ্বলে দ্বীপশিখা (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

খলিফা আশরাফ জীবন ঘনিষ্ঠ একজন কবি ও গল্পকার। তাঁর লেখায় মূর্ত হয়ে ওঠে সমসাময়িক কাল, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার বিপর্যয় এবং মানুষের অভাবিত সার্থলোলুপতার ক্লিষ্ট চিত্র। তিনি বৈরী সময়কে গভীর ব্যঞ্জনায় অনুপম রূপায়ন করেন তাঁর লেখায়, সামাজিক অন্যায় অসঙ্গতি এবং নির্মমতার কারুণ্য ফুটিয়ে তোলেন অন্তর্গত তীক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: বিপরীত করতলে, কালানলে অহর্নিশ, অস্তিত্বে লোবানের ঘ্রাণ; গল্পগ্রন্থ: বিল্লা রাজাকার ও সেই ছেলেটি, অগ্নিঝড়া একাত্তুর, একাত্তরের মোমেনা, পাথরে শৈবাল খেলে; ছড়াগ্ৰন্থ: ভুতুড়ে হাওয়া, কাটুশ-কুটুশ। তিনি  ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। 

error: Content is protected !!