অন্ধকারে-জ্বলে-দীপশিখা-২য়-পর্ব
খলিফা আশরাফ (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

অন্ধকারে জ্বলে দ্বীপশিখা (২য় পর্ব)

অন্ধকারে জ্বলে দ্বীপশিখা (২য় পর্ব)

খলিফা আশরাফ

 

পরদিন সকালেই জজ কোর্টে ছুটলো শকুর আলি। মাস দেড়েক পরে কোর্ট থেকে মতিন মেম্বারের নামে DNA টেস্টের জন্য সমন জারি হল, সিভিল সার্জনকে দুই মাসে মধ্যে DNA টেস্টের রিপোর্ট দাখিল করতে নির্দেশ দিলো কোর্ট।
কোর্টের সমন এলাকায় একেবারে হৈচৈ ফেলে দিলো। অনেক দিনের পুরনো প্রায় মৃত বিষয় আবার আলোচনার প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ালো। মতিন মিয়া মুখে এটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইলেও মনের কছে সঙ্কিত হয়ে উঠলেন। তিনি চেয়ারম্যানকে সাথে নিয়ে শহরের সবচেয়ে বড় উকিলের কাছে গেলেন। তাঁর পরামর্শেই urgent fee দিয়ে আর্জির নকল তুললেন। উকিল সাহেব মনোযোগ দিয়ে আর্জিটা পড়লেন। তারপর মতিন মেম্বারকে বললেন,
── বাদী শুকুর আলি নিজেকে আপনার ছেলে বলে দাবী করেছেন। পুরো ঘটনাই আর্জিতে বিবৃত করা আছে। এর সত্যাসত্য আপনি ভালো জানেন। তবে ঘটনা সত্য হলে DNA টেস্টে ধরা পড়বে। আপনি বলুন, শুকুর আলির দাবী কি সত্যি?
মেম্বার চেয়্যারম্যান মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে, কথা বলছে না কেউ। যা বোঝার বুঝে ফেলেছেন উকিল সাহেব। তিনি বললেন,
── DNA টেস্ট নিশ্চিত প্রমাণ করে দেবে শুকুর আলি আপনার ছেলে। এই দালিলিক প্রমাণ মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে খণ্ডন করা যাবে না। আপনি হেরে যাবেন। আদালত শুকুর আলির পক্ষে রায় দেবে। দেখুন, আমি ইচ্ছে করলে আপনাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিস্তর টাকা আয় করতে পারতাম, কিন্তু আমি সেটা কখনো করি না। যে কেসের merit নেই, সেই কেস আমি হাতে নেই না। অনেক উকিল পাবেন, আপনার কেস লুফে নেবে, আপনার টাকার শ্রাদ্ধ হবে, কিন্তু ফলাফল আমি যা বললাম, তাই হবে। আপনি আমাকে ফিস দিয়েছেন, তাই Legal advice দেয়া আমার কর্তব্য মনে করেই কথাগুলো আপনাকে বললাম। আমি মনে করি, শুকুর আলির সাথে একটা মীমাংসা করে নেয়াই ভালো। এখন আপনার মর্জি।

আরও পড়ুন গল্প একজন কিশোরীর প্রেম

আর্জি ফিরিয়ে দিলেন উকিল সাহেব। তাঁর চেম্বার থেকে বেড়িয়ে এসে একটা খোলা জায়গায় বসলেন দু’জন। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর চেয়ারম্যান সাহেব তাকে বললেন,
── চাচা, ঘটনা তো আপনিও জানেন, আমরাও জানি। এইডা নিয়্যা টানাটানি না করাই ভালো। মীমাংসা কর‍্যা নিলি কেমন হয়?
চেয়ারম্যান মতিন মেম্বারের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। এম, এ পাশ। এবারই প্রথম চেয়্যারম্যান। তবে বেশ বুদ্ধিমান। আগে তার বাবা ছিলেন চেয়ারম্যান। তখন থেকেই মতিন সাহেব মেম্বার। সে জন্যেই মেম্বারকে সে চাচা ডাকে, সম্মান করে। বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকলো মতিন মিয়া। তারপর আর্দ্র কণ্ঠে উদাসীন ভাবে বললেন,
── পরথম জেবনের ভুল যে শ্যাষ বয়াসে গলায় ফাঁসি হয়া যাবি বুজব্যার পারি নাই বাবা। কিন্তু শুকুরকে ছাওয়াল মান্যা নিলি নিজির সন্তানের কাচে মুখ দেহাবো ক্যামন কর‍্যা।
বুদ্ধিমান চেয়ারম্যান মেম্বারের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললো,
── চাচা, শুকুর আলিও তো আপনার নিজের ছাওয়াল।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো মতিন মেম্বার। চেয়ারম্যান তাঁর হাতটাকে আরও শক্ত করে ধরলো।
── হ, তুমি ঠিকই কইচো, শুকুর আলিও আমার ছাওয়াল। কিন্তু এই বয়াসে ছাওয়াল পলের কছে ক্যামন কর‍্যা কবো সে কতা। আমার গলায় দড়ি দিয়া ছাড়া আর কুনু পত নাই বাবা।
মাথা নিচুঙ্করে কাঁদছে মেম্বার। মাঝেমাঝে হেঁচকি উঠছে তাঁর। চেয়ারম্যান তাঁকে সান্তনা দিয়ে বললো,
── ঠিক আছে চাচা। আমি দেহি কিছু জমিজমা দিয়ে শুকুরের সাথে আপোষ করা যায় কিনা? চলেন বাড়ি যায়্যা বুদ্ধি করি।
── ঠিক আচে বাবা, জমিটমি দিয়্যা তুমি আপোষ কর‍্যা দ্যাও।
বাড়ি চলে এলো দু’জন।

আরও পড়ুন গল্প  স্বপ্ন জল

পরদিন শুকুর আলিকে ডাকালো চেয়ারম্যান। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে একা বসলো তারা। চেয়ারম্যান এম, এ পাশ হলেও রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় এলাকার মানুষের সাথে গ্রাম্য ভাষাতেই কথা বলেন। তিনি বললেন,
── শুকুর আলি, তোমরা তো সগলেই আমার নিজির লোক। মিল্যামিস্যা থাকাই ভালো। শুনলাম, তুমি একটা কেস করচো মতিন মেম্বারের নামে। আমি তোমাদের মদ্যি আপোষ মীমাংসা করে দিব্যার চাই। তুমি কি কও?
শুকুর আলি নির্লিপ্ত উত্তর দিলো।
── ঠিক আচে, কর‍্যা দ্যান।
চেয়ারম্যান আশান্বিত হয়ে উঠলেন। ভাবতেই পারেন নাই একগুঁয়ে শুকুর আলি এতো সহজে আপোষ করায় রাজি হবে। তিনি সোৎসাহে বললেন,
── তাহলি আমি মেম্বার সাহেবকে তুমার নামে বিঘা তিনেক জমি লিখে দিতে বলি। কি কও তুমি?
শুকুর আলি জানে গতকাল মেম্বারকে নিয়ে চেয়ারম্যান জেলা সদরে গিয়েছিলো। নিশ্চয়ই উকিলের সাথে আলাপ আলোচনাও করেছে। ভাবগতিক খারাপ দেখেই এখন আপোসের প্রস্তাব দিচ্ছে। মনে মনে সে হেড স্যারের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালো। মুখে কোন অভিব্যক্তি না এনেই শুকুর আলি বললো,
── চিয়ারম্যান সাব, সত্যি যদি কিচু দিব্যার চান, দয়া করে আমার মরা মার ইজ্জত্টা ফিরায়্যা দ্যান।
জবাব শুনে হতবাক হয়ে গেলো চেয়ারম্যান। বুঝলো শুকুর আলি এ পথে রাজি হবে না। তবুও শেষ চেষ্টা করলেন তিনি,
── ঠিক আছে, কতোটুক জমি তুমি চাও, বলো?
── আমি জমির লোবে কেস করি নাই। মা’র ইজ্জতের জন্যি করচি। হেইড্যা চাই। মেম্বার সাবরে কন, যে পাপ হ্যায় করচে, তার পায়াসচিত্তির করুক, আমার মায়েরে বউ হিসেবে মান্যা নিক।
হনহন করে বেড়িয়ে গেলো শুকুর আলি।

আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

মতিন মেম্বারকে সব জানালো চেয়ারম্যান। এও জানালো, জমি টাকা দিয়ে শুকুর আলিকে রাজি করানো যাবে না। শেষে যুক্তি করে দুইজন রাতের বেলা শুকুর আলির বাড়িতে গেলো। ঘরে ঢুকেই মেম্বার সাহেব শুকুর আলির হাত চেপে ধরলো। কাকুতি মিনতি করে বললো,
── বাবা এই বয়াসে আমারে আর বেইজ্জতি করিসন্যা। মাফ কর‍্যা দে।
── আমি আমার কতা চিয়ারম্যান সাবরে কয়া দিছি।
শুকুর আলির কণ্ঠস্বর কঠিন। মেম্বার সাহেব জলচোখে বললেন,
── আমার গলায় দড়ি দিয়া ছাড়া আর কুনু উপায় নাই বাবা।
তাঁর দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিরাসক্ত গলায় শুকুর আলি বললো,
── আপনার জন্যি আমার মাও গলায় দড়ি দিয়্যা মরচে মেম্বর সাব।
এতোক্ষণ চেয়ারম্যান সাহেব তাদের কথোপকথন শুনছিলেন। বুঝলেন, এ চেষ্টাও ব্যর্থ হোল। ক্রন্দনরত মেম্বারকে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন তিনি। সাহস দিয়ে বললেন,
── চিন্তা করবেননা চাচা, আমি একটা ব্যবস্তা করবোই।
মেম্বার চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

আরও পড়ুন গল্প সোনালী সকাল

চেয়ারম্যান সমস্যাটা নিয়ে অনেক ভাবলেন। তিনি যে এটার সাথে জড়িয়ে পড়েছেন, তা এখন অনেকেরই জানা। একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান না হলে তাঁর সুনাম ক্ষুন্ন হবে, বিরোধীদল এটাকে পুঁজি করবে। নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্যই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান খুব জরুরী। কিন্তু কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। মেম্বার সাহেবের সন্তানরা সম্পত্তির অংশীদারকে মেনে নেবে না কখনোই। আবার শুকুর আলি ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি না পেলে কেস তুলবে না। এ ক্ষেত্রে শুকুর আলি সুবিধাজনক অবস্থানে। কেসে নিশিত জয় তার। মেম্বার সাহেব নিজেও বুঝতে পেরেছেন সেটা। আর শুকুর আলি যে তারই সন্তান সেটাও সে স্বীকার করেছে, মেনেও নিতে চায়। তাঁর কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত সে। কিন্তু সংসার, সমাজ আর সম্মানের ভয় তাঁকে এগুতে দিচ্ছে না।

অনেক চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বেড় করলেন চেয়ারম্যান। যদি মেম্বারের ছেলে মেয়েদের সম্পত্তির ভাগ দিতে না হয়, তাহলে হয়তো বাবার এ সঙ্কটে তারা এগিয়ে আসতে পারে। আর শুকুর আলি তো বলেই দিয়েছে, সে তার মায়ের স্বীকৃতি চায়, মেম্বারের জমির প্রতি তার লোভ নেই। একবার চেষ্টা করে দেখা যাক। তিনি মেম্বারের ছেলে দুটোকে খবর দিলেন। একটা মেয়ে, বিয়ে হয়েছে, তাকে আর জড়ালেন না। ছেলে দুটো এস এস সি পাশ করে বাবার জমিজমা, ব্যবসাপাতি দেখাশুনা করে। তাদেরকে চেয়ারম্যান সাহেব সমস্ত ঘটনা আদ্যোপান্ত জানালেন। কেসের নিশ্চিত পরিনতিও বললেন। শুকুর আলি যে তার বাবার ছেলে, সেটাও তিনি স্বীকার করেছেন। মেম্বার সাহেব ভীষণভাবে অনুতপ্ত এবং ভেঙ্গে পড়েছেন। মান সম্মানের ভয়ে যে কোন কিছু করে ফেলতে পারেন।

আরও পড়ুন ভৌতিক গল্প অশরীরী আত্মা

তাঁর কথা শুনে ছেলেরা আঁতকে উঠলো। বাবাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়লো তারা। কিন্তু শুকুর আলি হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসবে, জমির অংশীদার হবে, সেটা তারা মেনে নিতে চাইলো না। চেয়ারম্যান শিক্ষিত বুদ্ধিমান লোক। তিনি বললেন,
── দ্যাখো, শুকুর আলি কেসে জিতবেই, আমাদের উকিলও তাই বলেছে। তখন কোর্টের আদেশে জমিসহ সব সম্পত্তির মালিকানাও পাবে। তার চেয়ে তোমরা যদি সম্পত্তির ভাগ না দিয়ে একটা আপোষ করো, কেমন হয়।
মেম্বারের ছেলেরা আগ্রহী হয়ে উঠলো,
── হেইড্যা কেমনে?
── শুকুর আলির সাথে আমি কথা বলছি। সে তাঁর মা’র স্বীকৃতি পাইলেই খুশি, সম্পত্তিতে তার লোভ নাই। এখন এইভাবে একটা আপোষ করা যায়। কিন্তু কেসে রায় হয়ে গেলে সেটা আর সম্ভব হবে না। তখন আমও যাবি, ছালাও যাবি।

আরও পড়ুন অন্ধকারে জ্বলে দ্বীপশিখা-
১ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

অন্ধকারে জ্বলে দ্বীপশিখা (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

খলিফা আশরাফ জীবন ঘনিষ্ঠ একজন কবি ও গল্পকার। তাঁর লেখায় মূর্ত হয়ে ওঠে সমসাময়িক কাল, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার বিপর্যয় এবং মানুষের অভাবিত সার্থলোলুপতার ক্লিষ্ট চিত্র। তিনি বৈরী সময়কে গভীর ব্যঞ্জনায় অনুপম রূপায়ন করেন তাঁর লেখায়, সামাজিক অন্যায় অসঙ্গতি এবং নির্মমতার কারুণ্য ফুটিয়ে তোলেন অন্তর্গত তীক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: বিপরীত করতলে, কালানলে অহর্নিশ, অস্তিত্বে লোবানের ঘ্রাণ; গল্পগ্রন্থ: বিল্লা রাজাকার ও সেই ছেলেটি, অগ্নিঝড়া একাত্তুর, একাত্তরের মোমেনা, পাথরে শৈবাল খেলে; ছড়াগ্ৰন্থ: ভুতুড়ে হাওয়া, কাটুশ-কুটুশ। তিনি  ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। 

error: Content is protected !!