অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (১ম পর্ব)
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (১ম পর্ব)
~ মোহাম্মদ আব্দুল মতিন
বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার অগ্রপথিক ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বহুপূর্ব থেকে, প্রকৃতপক্ষে ভারত বিভক্তির পর থেকেই তিনি একাকী জোতির্বিজ্ঞান চর্চা শুরু করেছিলেন। তিনি অবিভক্ত ভারতে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া অবস্থায়, অর্থাৎ ছাত্র অবস্থায় জোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেন।
তাঁরা ৫ ভাইবোন, ৩ ভাই আর দুই বোন। অধ্যাপক আব্দুল জব্বার ভাইদের ভেতর সবার ছোট আর ভাইবোনদের মধ্যে চতুর্থ। তাঁর পিতার নাম ছিল মুন্সী মিয়াজান মল্লিক, মা বুলুবেগম। তাঁদের পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে, উনার মেজ ভাই জনাব মোহাম্মদ আকবর আলী লিখেছিলেন,
“আমাদের বাপ মা ছিলেন খুবই গরীব। জমিজমা কিছুই ছিল না। আমাদের পিতা বলতেন যে তিনি প্রথম জীবনে পদ্মার ওপারে অর্থাৎ বর্তমান ফরিদপুর জেলার পাংশা অন্তর্গত হাবাশপুর বাহাদুরপুর অঞ্চলে বাস করতেন। তাঁদের পরিবারটি ছিল বিরাট এবং ঐ অঞ্চলের বিরাট ভূখণ্ডের মালিক। এখনও এই পরিবারের কিছু লোক বাহাদুরপুরে বাস করছে। পদ্মার ভাঙ্গনে তাঁদের সমস্ত জমিজমা নষ্ট হয়ে যায়। এই ভাঙ্গনের ফলে বিরাট পরিবারটি ছন্নছাড়া হয়ে যায় এবং বর্তমান ফরিদপুর, নদীয়া ও পদ্মার পূর্বপাড় পাবনা জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের পিতা বলতেন তিনি তাঁর বিবাহপূর্ব জীবনেই ওপারেই ২৬ বার পুরান বাড়ি ভেঙ্গে নূতন বাড়ি করেছেন। এটা হয়তো অতিশয়োক্তি, তবে অসম্ভব নয়। সাধারণত ভাঙ্গনে নদীর চরের লোকেরা, বাড়ির কাছে নদী আসলে, বেশি দূরে সরে যায় না। বাড়ি ভেঙ্গে একটু দূরে বাড়ি বানায়। নিজেদের ২/৪ বিঘা জমি থাকা পর্যন্ত অন্য কোথাও যাবে না। এর কারণও আছে।
আরও পড়ুন সুজানগরের প্রথম এম এ পাশ মাওলানা রইচউদ্দিন
অন্যখানে গেলে জমি কিনতে হবে। কিন্তু নগদ টাকা কোথায় ? তাঁদের নদীর ধারের জমি তাঁরা বিক্রি করতে পারেন না। কে এ জমি কিনবে ? যা হোক শেষ পর্যন্ত তাঁরা পদ্মার এপারে এসে কিছুটা জমি সংগ্রহ করে একটা বাড়ি করেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হন। এপারে এসে তিনি বিবাহ করেন। আমাদের পিতা ছিলেন অত্যন্ত তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং আত্মাভিমানী। শ্বশুর সম্পদশালী হলেও তিনি তাঁর কোন সাহায্যই নেন নি। নিজের জমিজমা নেই পরের জমি চাষ করার মনোবৃত্তি নেই। তিনি নৌকার মাঝি হয়ে ব্যবসায়ী মহাজনদের এ ঘাট এ বন্দর ও ঘাট ও বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন।”
(মোহাম্মদ আবদুল জব্বার আমার ছোট ভাই, এম আকবর আলী, পৃষ্ঠা-৪, মহাকাশ বার্তা, দ্বিতীয় বর্ষ, একাদশ সংখ্যা, নভেম্বর, ১৯৯৩)।
তিনি নিজে লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু নৌকায় করে মহাজনদের মালপত্র আনা-নেওয়া করার সুবাদে, তিনি ঘাটে বন্দরে নান লোকের সংস্রবে আসেন। এ সময়ে ঘাটে বন্দরে মুসলমান মহাজনদের মিলাদ মহফিল, হিন্দু মহাজনদের রামায়ণ মহাভারতের গান, কবি গান, জারিসারি শুনে মুসলিম ধর্মশাস্ত্র, কুরআন হাদীস, হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের অনেক কিছু শিখে ফেলেন। মুন্সী মিয়াজান মল্লিক নিজে নিরক্ষর হলেও অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। বন্দরে বন্দরে মুন্সি, মোল্লা, ঠাকুর পুরুহিতদের কেতাব, বই পড়া দেখে শিক্ষার প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মে। তখনই তিনি নিজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাবেন বলে মনস্থির করেন।
মাঝিগিরির অল্প আয়ে বেশিদিন তাঁর পোষাল না। এবার তিনি স্বাধীনভাবে ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করলেন। এক গ্রামের সস্তা জিনিস পায়ে হেঁটে অন্য আরেক গ্রামে বিক্রি শুরু করলেন। তাঁর আয়ে অতি কষ্টে তাঁদের পরিবার প্রতিপালিত হতে লাগল । মুন্সী মিয়াজান মল্লিক নৌকায় মালপত্র নিয়ে এখানে ওখানে যাওয়ার সুবাদে কিছু বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। নানা লোকের সঙ্গে চরাফেরা করতে করতে এই মাঝিগিরি করার সময়ে তিনি জ্বরজারিতে নাড়ী দেখা, সাপের বিষ নামানর ওঝাগিরি ইত্যাদি শিখে ফেলেন। পরবর্তী জীবনে তাঁর এই জ্ঞানের সাহায্যে তিনি গ্রামের লোকদের সাধারণ জ্বরজারির চিকিৎসাও করতেন এবং এই জন্যে গ্রামে তাঁর বেশ সমাদর ও সম্মান ছিল।
আরও পড়ুন লোকসাহিত্য বিশারদ অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন
১৯০৪ সালে তাঁর প্রথম পুত্র মোহাম্মদ আবিদ আলীর জন্ম হয়। দ্বিতীয় সন্তান কন্যা-আবিজান। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মোহাম্মদ আকবর আলীর জন্ম ১৯১১ সালে। চতুর্থ সন্তান-কন্যা-মহিউন। তৃতীয় পুত্র মোহাম্মাদ আব্দুল জব্বারের জন্ম ১৯১৫ সালে।
এই অবস্থাতেই মুন্সী মিয়াজান মল্লিকের চিন্তাচেতনা ছিল গ্রামের অন্যদের তুলনায় বেশ অগ্রসর। সেই অজপাড়াগাঁয়ে থেকেও তাঁর সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর কথা ভেবেছিলেন এবং সেজন্যে যথাসাধ্য চেষ্টাও করেছিলেন। গ্রামে কোনো পাঠশালা বা বিদ্যালয় কিছুই ছিল না। মিয়াজান মল্লিকের বাড়ির কাছেই ছিলেন কিছু লেখাপড়া জানা এক মুচি, নাম নীলমনি ঋষি। তাঁর বড় ছেলেকে পড়ানো শুরু করালেন। মিয়াজান মল্লিক, বড় ছেলে (মোহাম্মদ আবিদ আলী) নীলমনি ঋষির কাছে নিয়ে বর্ণপরিচয় শিক্ষা দেওয়া শুরু করালেন।
ছেলের লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে বসে থাকতেন এবং গল্পগুজব করতেন। মুসলমানের ছেলে হিন্দুর, তাও আবার মুচির কাছে লেখাপড়া শিখবে, বিষয়টি তৎকালীন মুসলিম সমাজে বৈরী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তখন মুসলমান সমাজ, মাদ্রাসা শিক্ষা ছাড়া, অন্য যে কোন শিক্ষার ঘোর বিরোধী ছিল। বর্ণপরিচয় শেষে তিনি তাঁকে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। পাঠশালার মাসিক বেতন ছিল চার আনা। কিন্তু এই চার আনা দেবার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না দেখে পাঠশালায় তাঁকে টিউশন ফ্রী করে দেওয়া হয়েছিল। পাঠশালার হেড পণ্ডিত ছিলেন নিম্নবর্ণের এক হিন্দু। শশী ভূষণ দাস। তাঁর উৎসাহে এখান থেকে মোহাম্মদ আবিদ আলী প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দিলেন।
পাঠশালার পাঠ শেষে তিনি সুজানগর এম ই স্কুলে ভর্তি হলেন। এখানে বেতন ছিল মাসিক এক টাকা তবে তিনি বৃত্তিপ্রাপ্ত বলে তাঁর টিউশন ফি লাগত না।সমগ্র পাবনা জেলা থেকে তিনি প্রথম বৃত্তিপ্রাপ্ত হলেন। বৃত্তি ছিল মাসিক দুই টাকা। এই বৃত্তি প্রাপ্তিই তাঁদের তিন ভাইয়ের লেখাপড়ার পথ খুলে দিল। এর পর তিনি তাঁর মেজ ছেলে (মোহাম্মদ আকবর আলী) ও ছোট ছেলেকে (অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার) গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন এবং তারা দুজনাই যথারীতি ফ্রী ছাত্র হিসাবে।
আরও পড়ুন বাংলাদেশে বইমেলার প্রবর্তক সরদার জয়েনউদ্দীন
এতে কিন্তু পিতামাতার, বিশেষ করে মাতার শুভানুধ্যায়ীরা সন্তুষ্ট হতে পারেন নাই। তাদের কথা-‘তোমরা নিজেরা খেতে পাও না তবে ছেলেদের পড়াও কেন। বড়জনকে না হয় পড়াও আর দুটোকে কোনো গেরস্ত বাড়ির কাজে লাগিয়ে দাও। ওরাও খেয়ে পরে বড় হবে, তোমাদেরও সাশ্রয় হবে।’ কিন্তু তাঁদের পিতামাতা হাজার কষ্ট স্বীকার করেও তাঁদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন । মুন্সী মিয়াজান মল্লিকের শ্বশুরপক্ষের এক হাজী সাহেব, তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় ছোট ছেলেকে ভর্তি করে দেবার জন্য তাঁকে পীড়াপীড়ি শুরু করলেন। মাদ্রাসাতে বেতন লাগবে না। তার উপর আবার জায়গির থাকার ব্যবস্থাও করে দিতে পারবেন
কিন্তু মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার, মাদ্রাসায় না পড়ে ভাইদের মত স্কুলে পড়ার জেদ করলে, তাঁকে আর মাদ্রাসায় যেতে হয় নাই। মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার গোপালপুর পাঠশালা থেকে বৃত্তি নিয়ে পাশ করে নিশ্চিন্তপুর উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাঠশালা থেকে বৃত্তি পাওয়া যেত এক বৎসরের জন্য মাসিক দুই টাকা করে আর উচ্চ প্রাথমিক থেকে বৃত্তি পাওয়া যেত তিন বৎসরের জন্য মাসিক তিন টাকা করে। উচ্চ প্রাথমিক থেকে বৃত্তি পেলে পুরো এম ই ক্লাস পর্যন্ত পড়া চালান যেতো। তাঁদের তিন ভাইয়ের লেখাপড়া একই ধারায় ছিল। প্রথমে পাঠশালা, তারপর এম ই স্কুল, তারপর এইচ ই স্কুল, তারপর কলেজ ও ইউনিভার্সিটি। ছাত্র অবস্থায় তাঁরা তিন ভাইই স্কলারশিপ নিয়ে লেখাপড়া চালিয়েছেন। তাঁদের এই স্কলারশিপের টাকায় শুধু তাঁদের জামাকাপড়, কাগজ কলমের খরচই চলতো না, তাঁদের সংসারের খরচেরও সাহায্য হত । তাঁরা কোনদিন নতুন বই কিনতে পারেননি, সব সময় পুরান বই সংগ্রহ করে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন।
আরও পড়ুন অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (১ম পর্ব)