অধ্যাপক-মোহাম্মদ-আব্দুল-জব্বার-শেষ-পর্ব
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  গবেষক,  গোপালপুর (ভায়না),  পড়াশোনা,  বই পর্যালোচনা,  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,  বিজ্ঞানী,  ভায়না,  লেখক পরিচিতি,  শিক্ষকবৃন্দ,  শিক্ষাবিদ,  সাহিত্য

অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (শেষ পর্ব)

অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (শেষ পর্ব)

মোহাম্মদ আব্দুল মতিন

 

প্রকাশনা (৩য় অংশ):

১০। বিশ্ব ও সৌরজগৎ (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৬ খ্রি.)
অধ্যাপক-মোহাম্মদ-আব্দুল-জব্বার
                 বিশ্ব ও সৌরজগৎ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আব্দুল মতিন পাটোয়ারী লিখেছেন (১৬ জুন, ১৯৮৬), “ড. রশীদ চেয়ারে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন প্রফেসর আব্দুল জব্বার এই মূল্যবান গ্রন্থখানি রচনা করে ইপ্সিত উদ্দেশ্য সাধনে যে বহুলাংশে সফল হয়েছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে পৃথিবীর তথা মহাবিশ্বের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে নানা ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে কি ভাবে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। সৌরজগতের সৃষ্টি রহস্য মানব জাতির কাছে এখনও বিরাট কৌতূহলের বিষয়। গণিত ও জোতির্বিজ্ঞানের গবেষকদের কাছে এই বই যেমন সহায়ক হবে তেমনি সৃষ্টিরহস্য কৌতূহলী পাঠকদের হৃদয়েও ইহা দৃঢ়ভাবে রেখাপাত করবে বলে আমি মনে করি।

জোতির্বিদ্যার মতো বিশাল, পরিবর্তনশীল ও জটিল বিষয়টিকে নিয়ে ড. রশীদ প্রফেসর এবং দেশের বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ ও জোতির্বিজ্ঞানী প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার লিখেছেন বিশ্ব ও সৌরজগত বইটি। বইটি সম্পূর্ণরূপে পড়ে দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরিতে তিনি যে আন্তরিকতা ও মেধার পরিচয় দিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

প্রফেসর জব্বার একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান লেখক। ইতিমধ্যে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় তাঁর লেখা সর্বজন সমাদৃত। বইটির বিষয়বস্তু হয়েছে বিশ্লেষণধর্মী এবং যুগোপযোগী। আধুনিক জোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ব ও সৌরজগত একটি মূল্যবান দলিলরূপে প্রতিভাত হবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।”

আরও পড়ুন আমাদের সুজানগর সাহিত্য সংকলন রিভিউ

জোতির্বিদ্যা একটা বিরাট ব্যাপার। এর যে কোন শাখায় বিরাট বিরাট বই আছে। সমস্ত শাখার সমস্ত বিষয় দিয়ে জোতির্বিদ্যার একখানা বই লেখা অসম্ভব ব্যাপার। সে জন্য তিনি কয়েকটা মাত্র বিষয় নিয়েই এ বইখানা রচনা করেছেন। বিশ্ব সম্বন্ধে মানুষের ধারণার বিরাট পরিবর্তন সবচেয়ে চমকপ্রদ। সৌরজগত সম্বন্ধে কয়েক বৎসরে নানাবিধ আশ্চর্যজনক তথ্য পাওয়া গেছে। সে জন্য এ বইতে প্রধানত, বিশ্ব ও সৌরজগত সম্বন্ধেই আলোচনা করা হয়েছে। সৌরজগত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে পৃথিবী ও মানুষ সম্বন্ধে বিশেষ ভাবে কিছু বলা হয়েছে।

আরিস্টটল ও টলেমীর মতে পৃথিবীই ছিল বিশ্বের কেন্দ্র। এরপর কোপারনিকাস পৃথিবীকে বিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে সূর্যকে বিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করলেন। ১৯১৯ সালে হার্লে শেপালী প্রমাণ করেন যে, সৌরজগত সমেত সূর্য, বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত তো নয়ই, এমন কি আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রেও অবস্থিত নয়। ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে সূর্য ৩৩০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।

এই বইতে তিনি বিশ্ব ও বিশ্বে সীমা, বিশ্বের প্রকৃতি, বহির্বিশ্বে জীবনের সম্ভাব্যতা ও অসম্ভাব্যতা, বিশ্বে সৃষ্টি, মহাবিশ্বে বিস্ময়সমূহ, বিশ্বে পরিণতি, সৌরজগত, মানুষের আবির্ভাব ইত্যাদি বিষয়ে সরল ও সহজে বোধগম্য ভাষায় লিখে গেছেন।

১৯৫৭ সালে প্রথম স্পুটনিক উৎক্ষেপনের সঙ্গে মহাশূন্য যুগের সূচনা হয়। এর মধ্যে মহাশূন্য যানের সাহায্যে সৌর জগতের অনেক তথ্য জানা গেছে। এক প্লুটো ছাড়া আর সব কয়টি গ্রহের উদ্দেশ্যে মহাশূন্যযান পাঠানো হয়েছে। ভয়েজার ইউরেনাসের নিকট পৌঁছেছে ১৯৮৬ সালে এবং নেপচুনে পৌঁছেছে ১৯৮৯ সালে। প্রায় ২৬ বৎসর আগে এই দুটি ঘটনাই ঘটে গেছে। ইন্টারনেট ঘাঁটলে এর ফলাফল জানা যাবে ঠিকই, তবে আমাদের মাতৃভাষায়, সবার বোধগম্য ভাষায় লেখক কি আমরা পেয়েছি ? এখানেই জব্বার সাহেবের অভাব প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে।

১১। আকাশ পট

(বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন, প্রথম প্রকশ ১৯৮৮ খ্রি., দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০২ খ্রি., তৃতীয় প্রকাশ ২০০৪ খ্রি. এবং  চতুর্থ প্রকাশ ২০০৯ খ্রি.)

অধ্যাপক-মোহাম্মদ-আব্দুল-জব্বার
আকাশ পট

বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিকাল এসোসিয়েশনের সভাপতি, ইনাম আল হক লিখেছেন, “মাথার উপর আদিগন্ত এই আকাশ। সেখানে তারায় তারায় বন্ধুত্ব, প্রেম, বিরহ, ঈর্ষা, সংঘাত কতনা কাহিনী লেখা। জানলে যে কারো রোমাঞ্চ হবে। কিন্তু জানবে কি করে ? এসবের কাহিনী এখন তো আর কেউ শোনায় না আমাদের। মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার করেছিলেন অসাধারণ এই কাজটি। লিখেছিলেন আকাশ পটে আঁকা পৌরাণিক সব প্রেমোপাখ্যান। সেই ১৯৭৫ সালের কথা। তাঁর শেষ লেখা। লেখাটি ছাপাখানা হয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছতে এক যুগ পার হয়ে গেল। প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮ সালে।

আকাশ পট বিরাট বিশাল। এখানে অজস্র তারা নানান ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মানুষের শিল্পী মন এই সমস্ত ছড়ানো ছিটানো তারা দিয়ে নানা প্রকার ছবির কল্পনা করে থাকে। এই ভাবে সৃষ্টি করে বিভিন্ন তারামণ্ডলী, এবং এই সমস্ত তারামণ্ডলীকে শিল্পী বিভিন্ন প্রকার নামকরণ করে। কে যে কবে এই নামকরণ করেছিলো, সে ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গেছে। অনেকের ধারণা অতি প্রাচীন মধ্য এশিয়ার চারণ ভূমিতে মানুষ গরু, ঘোড়া ইত্যাদি চরিয়ে বেড়াতো, এবং রাত্রিতে মুক্ত আকাশের নীচে শুয়ে হয়তো কোন ভালবাসার কিংবা কোন বীরপুরুষের কাহিনীর চিত্র তারার রাজ্যে খুঁজে বের করতো। আবার অনেকের ধারণা, তারা নিয়ে চিত্রের কল্পনা প্রথম হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাতে কাহিনী সংযোগ করা হয়। এ ছাড়া যে সমস্ত পশু-পক্ষির সাথে মানুষের অহরহ মোকাবেলা করতে হতো, তাদের চিত্রই আকাশ পটে খুঁজে বের করতো। এভাবে মেষ, বৃষ, বৃশ্চিক, কর্কট, তিমি ইত্যাদি প্রাণী চিত্রের তারামণ্ডল আকাশ পটে পাওয়া যায় ।

আরও পড়ুন অধরা চাঁদ উপন্যাস রিভিউ

জব্বার সাহেবের জোতির্বিদ্যা সম্বন্ধে চার খণ্ডের বই লেখার ইচ্ছা ছিল। এর তিন খণ্ড বই মহাকাশ গ্রন্থমালা সিরিজ হিসাবে বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। চতুর্থ খণ্ড “তারা কাহিনী” নামের পাণ্ডুলিপি ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমীতে জমা দেন। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে এ বইখানি ছাপাখানা পর্যন্ত যেতে সক্ষম হয়নি । জোতির্বিদ্যায় উৎসাহী কয়েকজন তরুণ তাঁর লেখা একটা বই প্রকাশের আগ্রহ ব্যক্ত করলে, “তারা কাহিনী”র কিছু অংশ দিয়ে তাদের উৎসাহে সাড়া দেন ।

বইখানা প্রকাশের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিকাল এসোসিয়েশনের মহাপরিচালক এম. আমিনের। তাঁর নিরলস পরিশ্রমে এবং গভীর উৎসাহে এই বইখানা এভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। আমি শ্ৰীমান আমিনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।”

১২। Scientific Indications in the Holy Quran

(প্রকাশক: ইসলামিক ফাউন্ডেশন; অধ্যাপক শমসের আলী, অধ্যাপক মো. আব্দুল জব্বার, জনাব এম আকবর আলী প্রমুখ ৯ জনার এডিটোরিয়াল বোর্ড কর্তৃক সম্পাদিত)

উনার অগ্রজ, এডিটোরিয়াল বোর্ডের সদস্য এম আকবর আলী লিখেছেন, “আব্দুল জব্বারের ছিল বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রগাঢ় জ্ঞান। সে Mathematics এর প্রফেসর হোলেও Physics, Chemistry ইত্যাদি বিষয়েও ছিল প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী। এটা প্রকাশ পায় Scientific Indications in the Holy Quran গ্রন্থখানা প্রণয়নের সময়। অধ্যাপক শমসের আলী, আব্দুল জব্বার ও আমি সহ সব সমেত ৯ জন মিলে গ্রন্থখানি প্রণীত হয়েছে। এতে কোরানের আয়াতের বিভিন্ন বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়গুলো এক এক জন মিলে লিখতেন, আর সবাই মিলে সমালোচনা করা হতো। সেই সমালোচনা অনুসারে সেটা আবার নতুন করে লিখতে হতো। যখন সবাই ওকে করতো তখনই সেটা ছাপার জন্য গৃহীত হতো। এই সমালোচনার সময় বোঝা যেত, আব্দুল জব্বারের জ্ঞানের পরিধি। তার মতই প্রায় সময়ই টিকে যেত। সে হিসেবে সে ছিল সবার শ্রদ্ধাই।”

পাঠ্য বই

১। এ টেকস্ট বুক অন ইন্টারমিডিয়েট স্ট্যাটিক্স (মালিক লাইব্রেরি, ১৯৫২ খ্রি.)
২। এ টেকস্ট বুক অন ইন্টারমিডিয়েট ডাইনামিক্স (মালিক লাইব্রেরি, ১৯৫২ খ্রি.)
৩। প্রাথমিক গতিবিদ্যা (মালিক লাইব্রেরি, ১৯৭৪ খ্রি.)
৪। প্রাথমিক স্থিতিবিদ্যা (মালিক লাইব্রেরি, ১৯৭৪ খ্রি.)
৫। ইন্টিগ্র্যাল ক্যালকুলাস ও ডিফারেন্সিয়াল সমীকরণ (বাংলা একাডেমী, ১৯৭৯ খ্রি.) (স্নাতক পর্যয়ের)

অধ্যাপক-মোহাম্মদ-আব্দুল-জব্বার
           Intermediate Statics
Intermediate-Dynamics
        Intermediate Dynamics

তিনি মাত্র ২৭ বৎসর বয়স থেকেই মাতৃভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক বই লেখা শুরু করেন। বিজ্ঞানের উচ্চতর বিষয়গুলি তিনি সর্বসাধারণের বোধগম্য ভাষায়, অত্যন্ত সাবলীলভাবে লিখে গেছেন। তিনি স্ট্যাটিক্স ও ডাইনামিক্স এর উপর যে দুটি অসামান্য বই লিখেছিলেন, সমগ্র পাকিস্তানে, সেটি সুদীর্ঘ এক যুগ ধরে আবশ্যকীয় পাঠ্য পুস্তক হিসাবে বিবেচিত হত। বাংলাদেশে তিনি ছিলেন মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অগ্রদূত, তিনি ছিলেন জোতির্বিজ্ঞান চর্চারও অগ্রদূত। তিনি দীর্ঘ ৭৩ বৎসর পর্যন্ত লেখালেখি করে গেছেন। শেষের ৫ বৎসর, চোখের অসুবিধার জন্য লেখালেখি করতে পারেন নাই এবং সেই জন্য তাঁর আপসোসের শেষ ছিল না।

তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, “আমার অজ্ঞানতার সীমা নাই, অসাবধানতাও আকাশচুম্বি ; সুতরাং আশা করা যায় যে, ভুলত্রুটিও সেইভাবেই হয়েছে। সাধ্যের অতীত এই ধৃষ্টতাপূর্ণ সাধের জন্য পাঠকবর্গের নিকট ভিক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নাই ।”

অন্য জায়গায় লিখেছেন, “আমার মনের আনন্দে এ বই লিখেছি, মনের আনন্দেই এর মাল- মশলা সংগ্রহ করেছি। অন্য কারো মনে এই আনন্দ সঞ্চারিত হলে নিজেকে ধন্য মনে করব।”

তাঁর কৃতিত্ব শুধুমাত্র নিজের জ্ঞান অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না।। অন্যদেরকে সে জ্ঞান অর্জন করতে সাহায্য করার বিষয়েও যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করতেন।

আরও পড়ুন অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন “আমাদের সুজানগর” এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের দ্বিতীয় পুত্র। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি) একজন সদস্য এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৪৫ সালের ১১ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!