অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (৪র্থ পর্ব)
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (৪র্থ পর্ব)
~ মোহাম্মদ আব্দুল মতিন
১৯৮৫ সালে হ্যালির ধূমকেতুর পুনরাবির্ভাবের সময় যখন এগিয়ে এলো, তখন সারা দুনিয়াতেই বেশ উৎসাহের সৃষ্টি হতে লাগল। তার জোয়ার সংবাদ মাধ্যমগুলির কল্যাণে আমাদের দেশেও এসে পৌঁছলো। ধূমকেতু কি করে দেখা যায় এবং জনসাধারণকে দেখানো যায় তার উপায় খুঁজতে গিয়ে, উদ্যোক্তাগণ লক্ষ্য করলেন, দেশে ধূমকেতু সম্পর্কে সাধারণ তথ্যের অনেক বই পুস্তক আছে। তবে হ্যালির ধূমকেতু দেখতে হলে যে সমস্ত বিশেষ তথ্যের প্রয়োজন তা কোথাও নেই। যেমন হ্যালির ধূমকেতু কবে আকাশের কোন অঞ্চলে দেখা যাবে, তার উজ্জ্বলতা কেমন থাকবে, তার গতিপথ কি হবে, এসব তথ্য দেশের কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। অতএব, উদ্যোক্তাগণ তখনকার জোতির্বিজ্ঞানের সমসাময়িক তথ্যের একমাত্র উৎস অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার সাহেবের স্মরণাপন্ন হলেন। তাঁর কাছ থেকে যাবতীয় তথ্য নিয়ে, ১৯৮৫ সালের ২৮শে অক্টোবর উদ্যোক্তাগণ নিজেরা দেখতে এবং জনসাধারণকে হ্যালির ধূমকেতু দেখাতে সক্ষম হলেন ।
এ কথা ঠিকই যে, অধ্যাপক আব্দুল জব্বার এককভাবে বাংলাদেশে এবং বাংলা ভাষায় জোতির্বিজ্ঞান চর্চায় যে বিরাট ভূমিকা রেখেছেন, তাঁর জীবদ্দশায় তার উপযুক্ত স্বীকৃতি পান নাই। তাঁর বইগুলি যিনি পড়েছেন, তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারবেন যে, তিনি কতটা শ্রম, প্রয়াস ও মেধা এই রচনার পেছনে ব্যয় করেছেন। বাংলা ভাষায় রচিত এই বইগুলি বেশ উঁচু মানের। সুখের বিষয় যে, বহু বছর পর এই বইগুলির পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে, আবার ছাপিয়ে নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া যাচ্ছে এবং জোতির্বিজ্ঞান চর্চায় নতুন গতির সঞ্চার হয়েছে।
আরও পড়ুন কৃষি বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন
বুয়েটে ড. রশিদ অধ্যাপক থাকা অবস্থায় অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার দেশে জোতির্বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার স্বার্থে দুইটি কঠিন কাজ হাতে নিয়েছিলেন। একটা হলো জোতির্বিজ্ঞানের উপর একটা বই লেখা আর একটা হলো বড় আকারের একটা ‘খ-গোলক’ তৈরি করা। আকাশের বিভিন্ন নক্ষত্রের অবস্থান জানতে পারা এবং রাশি, নক্ষত্রমণ্ডল এগুলি সহজভাবে বুঝতে পারা এবং চিনতে পারার জন্য তিনি এই ‘খ-গোলক’ তৈরি করেছিলেন। প্রত্যেকটা নক্ষত্র যাতে তার সঠিক অবস্থানে আঁকা হয়, তার ঔজ্জ্বল্য ও বর্ণ যাতে ঠিকঠাক ভাবে নির্দেশ করা হয় তার জন্য তিনি কঠোর নিষ্ঠা ও শ্রম ব্যয় করেন। ৪৫ ইঞ্চি ব্যাসের এই গোলকটিতে সর্বমোট ১ হাজার ৯ শত ৯০টি তারার অবস্থান দেখান হয়েছে। এছাড়া এতে আরো রয়েছে ৮৮টি তারামণ্ডলের সরল রৈখিক চিত্র, পিকটোরিয়াল চিত্র আর ১২টি রাশির অবস্থান। বর্তমানে এই ‘খ-গোলক’টি বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনোমিকাল এসোসিয়েশনের হেফাজতে আছে।
আরেকটি হল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত তাঁর একটি অসাধারণ গ্রন্থ। গবেষণাধর্মী এই বইটির নাম বিশ্ব ও সৌরজগৎ। জোতির্বিজ্ঞান চর্চায় এই বইটির প্রয়োজনীয়তা সংশ্লিষ্ট সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন।
আরও পড়ুন অধ্যাপক ড. রুহুল আবিদ
নব্য প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেজিস্ট্রার ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার। প্রশাসনিক পদসমূহে অধিষ্ঠিত থেকেও তিনি সব সময়েই একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে শিক্ষক ছিলেন। সারা জীবন শিক্ষক হিসাবেই কাটিয়ে গেছেন। শিক্ষার পথে তিনি জীবনকে নিঃসম্বল করে উৎসর্গ করেছেন। তাই ১৯৮৫ সালে, শিক্ষা ক্ষেত্রে তার গৌরবময় অবদান ও কীর্তির স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ২১শে পদকে ভূষিত করেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার সংসারজীবন শুরু করেছিলেন উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাওয়ার আগেই। বাংলা একাডেমির প্রথম পরিচালক, ব্রিটিশ শাসন আমলের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, সুসাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ সাহেবের বড় মেয়ে নূরজাহান বেগমের সাথে। বরকতুল্লাহ সাহেব ছিলেন অত্যন্ত উদার মনা ও প্রগতিশীল। তিনি একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হয়েও, একজন নিরক্ষর নৌকার মাঝির ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে দ্বিধা করেন নাই।
আরও পড়ুন কবি জিন্নাত আরা রোজী
বড় মেয়ে নূরজাহান বেগমের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৩৯ সালের ৮ জুন। স্বামীর সুযোগ্য সহধর্মিনী এবং সুগৃহিণী নূরজাহান বেগম সাহিত্যচর্চায় বিশেষ আগ্রহী ও পারদর্শী ছিলেন। তিনি স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এর লস্ট ওয়ার্ল্ড অবলম্বনে রচনা করেছিলেন হারিয়ে যাওয়া জগৎ এবং শিশু-কিশোরদের জন্য সোনার কাঠি। আবদুল জব্বার-নূরজাহান দম্পতির ৫ পুত্র ও ২ কন্যা।
জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন প্রবর্তিত “ব্রুনো পদক ৯০” লাভ করেন। এছাড়া বিজ্ঞান চর্চায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৮০ সালে কুদরাত-এ-খুদা স্মৃতি পুরস্কার এবং ১৯৮৫ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একুশে পদক লাভ করেন। প্রবন্ধ-গবেষণা ক্ষেত্রে, একজন লেখক হিসেবে ১৯৮৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে উনি ছিলেন অসম্ভব শৃংখলাবদ্ধ। কোন কিছুরই অনিয়ম করেননি। গত পঞ্চাশ বছর রাতে হাতে গড়া রুটি খেয়েছেন। খাওয়া দাওয়া একদম পরিমিত, একদম ঘড়ি ধরে। এর অন্যথা হত না। একমাত্র মিষ্টি কুমড়া আর শুঁটকী মাছ ছাড়া সবই খেতেন। শাক কচুও অপছন্দ ছিল না। খাবার পর ফল খেতে পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন ভীষণ মিতব্যয়ী। অপব্যবহার করেননি কখনও। যতটুকু না হলেই নয় ঠিক ততটুকুই করতেন।
আরও পড়ুন কবি মো. নুরুজ্জামান
সাধারণ সুতির জামা কাপড় পরতে পছন্দ করতেন। খুব পরিষ্কার পরিছন্ন থাকতেন। ঘর বাড়ি ছিমছাম রাখতে পছন্দ করতেন। কিছু দিন পর পর অপ্রয়োজনীয় কাগজ পত্র, কাপড় চোপড় বের করে দিতেন। তিনি সব সময়ে হেঁটে চলা ফেরা করতেন। সেই মতিঝিল থেকে তিনি হেঁটে হেঁটে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করতেন।
আরও পড়ুন অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (৪র্থ পর্ব)