অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১ম পর্ব)
অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১ম পর্ব)
অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন ছিলেন একজন লোকসাহিত্যবিশারদ, লেখক ও শিক্ষাবিদ। দেহকেন্দ্রিক সাধনমার্গের বিষয়বস্তু কিংবা নিয়মকানুন এবং শারীরবৃত্তীয় ব্যবহারিক কলাকৌশলের বর্ণনা করতে গিয়ে যার বক্তব্য অনেকখানি স্বস্তি জোগায়, তিনি হলেন প্রখ্যাত গবেষক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন।
লোকগীতি সংগ্রহ, গবেষণা ও সংকলন, সমালোচনা সাহিত্য, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ ও শিশু সাহিত্যসহ বিভিন্ন শাখায় ছিল যার সদর্প পদচারণা। বাংলা, পালি, উর্দু ও ফার্সীসহ ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলাসে যিনি অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, শেরে বাংলা জাতীয় পুরস্কার ও স্বর্ণপদক, মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, স্বাধীনতা পদক এবং রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধীতে ভূষিত হন।
আরও পড়ুন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ফোকলার সাধনা
জন্ম: বাংলা লোকসাহিত্য সংগ্রহের ভোরের পাখি হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত সাগরকান্দি ইউনিয়নের মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
পারিবারিক জীবন: লোকসাহিত্য সংগ্রাহক অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের পিতার নাম জায়দার আলী এবং মাতার নাম জিউয়ারুন নেসা। পিতা জায়দার আলী ছিলেন আট ভাই এক বোনের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ। বিশাল পরিবারের দায়িত্বে থেকেও তিনি সমাজের বিভিন্ন কর্মকান্ডে প্রধান ভূমিকায় নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। স্বগ্রাম ছাড়াও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে তার যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, পরিশ্রমী, মিষ্টভাষী এবং হৃদয়বান ব্যক্তি। ১৯২৬ সালে পাবনা জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধলে তিনি সপরিবারে শিলাইদহে চলে যান। এখানে তিনি বেশকিছু জমি ক্রয় করেন। এসব জমি ছিল সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত। এখানে তিনি সপরিবারে কিছুদিন বসবাস করেন। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে তারা স্বগ্রামে ফিরে যান। মাতা জিউয়ারুন্নেসা ছিলেন স্নেহশীলা এবং সুগৃহিণী।
আরও পড়ুন সুজানগরের প্রথম এম এ পাশ মাওলানা রইচউদ্দিন
তিনি ছাত্রজীবনেই ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে বিয়ে করেছিলেন পদ্মার অপর পাড়ে ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ীর (বর্তমানে জেলা) মৌকুড়ির সাব-পোস্ট মাস্টার সফিউল্লাহ সাহেবের কন্যা শরিফুন্নেসা খানমকে। বিএ পড়তেন তখন। যতদিন পড়াশোনা করেছেন সংসারের দায়-দায়িত্ব তাকে বহন করতে হয়নি। পিতার বর্তমানে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। চাকরি জীবনে কর্মস্থলে সপরিবারে বসবাস করার পর থেকেই বলা যায় মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন গৃহী হন। পারিবারিক জীবনে সুখের চেয়ে শোক ও দুঃখের যন্ত্রণায় তাকে একাধিকবার বিদ্ধ হতে হয়েছে। দ্বাদশ সন্তানের পিতা মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা হাসির মৃত্যুতে এতো শোকাভিভূত হয়েছিলেন যে, সেই শোক সামলে উঠতে বেশ সময় লেগেছিল। হাসিকে তিনি অত্যধিক স্নেহ করতেন। প্রথম সন্তান খোকার অকাল মৃত্যু মনসুর দম্পতিকে শোকাচ্ছন্ন করেছিল। তার জীবনের আরও একটি ট্রাজেডি স্ত্রীর সুদীর্ঘ অসুস্থতা। চিররুগ্ন শরিফুন্নেসাকে নিয়েই সারাজীবন তিনি সংসার ধর্মপালন করে গেছেন।
স্বামীর সাহিত্য সাধনায় শরিফুন্নেসা প্রত্যক্ষভাবে হয়তো তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি, কিন্তু মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের সাফল্যে তার পরোক্ষ অবদানও অকিঞ্চিৎকর নয়। সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব তিনি হাসিমুখে পালন করেছেন বলেই মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল যথাক্রমে ‘হারামণি’ অথবা ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনার মতো গ্রন্থ সংকলন ও প্রণয়ন করা।
আরও পড়ুন মোহাম্মদ আবিদ আলী
বাল্য জীবন: অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের পিতা জায়দার আলী তিন বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রীর (জিউয়ারুন্নেসা) গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন। তিনি ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। আর তাই পরিবারের সবার অপরিমেয় স্নেহে লালিত পালিত হয়েছেন তিনি। পিতামহ ছাবেদ আলী তাকে আদর করে ডাকতেন ‘গ্যাদা’ বলে। তিনি বাল্যকালে ছিলেন রুগ্ন ও শীর্ণকায়। অসুখ-বিসুখ সবসময় লেগেই থাকতো। মাঝে মাঝে জীবন সংশয়ও দেখা দিতো। সারা পরিবার উদ্বেগে দুশ্চিন্তায় কণ্টাকিত থাকতো। তার প্রাণরক্ষার জন্য মানত করা হতো। একবার তিনি এত অসুস্থ হয়ে পড়লো যে, সবাই তার আশা ছেড়ে দেন। ফকির ডাকা হয়েছিল। তার নির্দেশে বাড়ি থেকে দূরে নদীর ধারে নতুন কাপড় দিয়ে তাঁবুর মতো একটি ঘর তোলা হয়। তার মা গোসল করে অভুক্ত অবস্থায় সেই ঘরে বসে এক মণ দুধ আর আতপ চাল দিয়ে ক্ষীর রান্না করে সবাইকে শিরনি পরিবেশন করেন।
তাদের ধারণা, এরপর থেকেই তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন। বাল্যে তার শিক্ষার হাতেখড়ি হয় মাধবচন্দ্র নন্দীর পাঠশালায়। সাধারণত পাঠশালার পণ্ডিত মশায় যেমন হন, তিনি তেমন ছিলেন না। প্রতিটি ছাত্রকে নিজের কাছে বসিয়ে অত্যন্ত দরদ দিয়ে পড়াতেন। পড়া না পারলে তিনি কাউকে বকতেন না, মারতেন না। বরং পাশে বসিয়ে পড়া তৈরি করে দিতেন। মনসুরউদ্দীন তার শীর্ণদেহ নিয়ে পাঠশালায় যেতে মোটেই উৎসাহ পেতেন না। সেকালে মুসলিম এবং নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা বিদ্যাশিক্ষায় অনগ্রসর ছিল। পাঠশালার পাঠ শেষ হলে মনসুউদ্দীন পড়তে আসেন পাশের গ্রাম খলিলপুরের মাইনর স্কুলে। এ স্কুলটিই যোগেন্দ্রনাথ জোয়ারদার নামক একজন কুসিদজীবী ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তির প্রচেষ্টায় ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে হাইস্কুলে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন অধ্যাপক মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন
শিক্ষা জীবন: অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে খলিলপুর উচ্চ বিদ্যালয় (সুজানগর) হতে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আইএসসি পড়েন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। তখন এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন রাধিকানাথ বোস। যে কয়জন মুষ্টিমেয় মুসলিম ছাত্র কলেজে পড়তো তিনি তাদের খুবই স্নেহ করতেন এবং নানাভাবে তাদের উৎসাহিত করতেন। কলেজে পড়তে এসে মনসুরউদ্দীন নূরপুর গ্রামের আকিল উদ্দিন বিশ্বাসের বাড়ি জায়গীর ছিলেন। তাঁর লোকগীতি সংগ্রহে আকিল উদ্দীনের অবদান রয়েছে। আকিল উদ্দীন নিজেই ছিলেন একজন পল্লী গায়ক। এডওয়ার্ড কলেজ ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হলেও মনসুরউদ্দীন যখন এখানে পড়তে আসেন, তখনও কলেজ থেকে কোন ম্যাগাজিন বের হয়নি।
স্কুল জীবন থেকেই সাহিত্য চর্চা এবং লোকগীতি সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। কবিতা লেখার সুবাদে তিনি ইতোমধ্যে ‘কবি সাহেব’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি ম্যাগাজিন প্রকাশের আবেদন নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে দরখাস্ত পেশ করেন। অধ্যক্ষ সানন্দে তার আবেদন মঞ্জুর করেন। ম্যাগাজিন সম্পাদক নিয়োজিত হন ইংরেজির অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ রায়। মনসুরউদ্দীন সহ-সম্পাদক নিযুক্ত হন। ম্যাগাজিন বের হলো। এতে স্থান পেলো তার একটি কবিতা ‘বেদুঈন মুসলমান’ আর লোকগীতি সংগ্রহ। সাহিত্য চর্চা এবং ম্যাগাজিন বের করার উৎসাহে পড়াশোনার দিকে তিনি মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হলেন। ফলে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে আইএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে পাস করলেন।
আরও পড়ুন এম. আকবর আলী
সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন জমিদারী পরিদর্শন আসেন, মনসুরউদ্দীন তখন শিলাইদহে। তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। বিএ পাস করে বসে আছেন। তার কাছে চাকরি চেয়ে বসলেন। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে কলকাতায় দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মনসুউদ্দীন দেখা করলেন। মনসুরউদ্দীনের চাকরি করার আকাঙ্ক্ষা সুরেন্দ্রনাথের মনঃপূত হয়নি। তিনি তাকে একটি পত্রসহ স্যার আবদুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দীর কাছে পাঠান। স্যার আবদুল্লাহ তাকে বাংলায় এমএ পড়ার পরামর্শ দেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগের সেক্রেটারি ডক্টর গৌরাঙ্গকে এই মর্মে অনুরোধ করে পত্র দেন, যেন মনসুরউদ্দীনকে বাংলা বিভাগে ভর্তি করে নেয়া হয়। তিনি সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থানুকূল্যে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। প্রথমে সুরেন্দ্রনাথের বাড়ি, পরে স্যার আবদুল্লাহর বাড়ি থেকে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হতো।
পরে একটি মোটা টাকার বৃত্তি পেয়ে তিনি কারমাইকেল হোস্টেলে চলে আসেন। কারমাইকেল হোস্টেলে এসে তিনি ‘তরুণ জমাত’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি এর সভাপতি ছিলেন। সেক্রেটারি ছিলেন মীর্জা আলাউদ্দীন বেগ। এই সংগঠন একটি সাহিত্য গোষ্ঠী গড়ে তোলার সময় একটি সুন্দর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল তরুণ জমাতের পক্ষ থেকে। তাতে যোগদান করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, এস ওয়াজেদ আলী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, দীনেশচন্দ্র সেন, কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির প্রমুখ। কারমাইকেল হোস্টেল ডিবেটিং সোসাইটিরও তিনি সভাপতি ছিলেন। মিস ফজিলাতুন্নেসার বিলেত যাত্রা উপলক্ষে সোসাইটির তরফ থেকে তাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। তিনি ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার’ (বাংলা) এ পাস করেন।
আরও পড়ুন অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১ম পর্ব)