অধ্যাপক মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন (২য় পর্ব)
অধ্যাপক মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন (২য় পর্ব)
খ ম আবদুল আউয়াল
ধর্ম সাধনা ও সমাজ সেবা: অধ্যাপক মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন নিজে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন যাকে বলে self made man. তিনি ছিলেন প্রকৃত ধর্মপ্রাণ, সত্যনিষ্ঠ, আদর্শবাদী মানুষ। ধর্মবোধ থেকেই পিতামাতার প্রতি ছিলেন পরম ভক্ত ও কর্তব্যনিষ্ঠ। তাই পিতার ইচ্ছানুযায়ী ধর্মীয় জ্ঞানেই আধুনিক উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছিলেন, যদিও তাঁর মেধা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয় ছিল গণিতশাস্ত্র। শিক্ষা লাভের শুরু থেকেই তিনি আদর্শ মানব হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন হযরত মুহম্মদ (সা.) কে। তাই সচেতনভাবে তরুণ বয়স থেকেই মহানবীর মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বনবীকে গভীর ভালোবেসে অনুসরণ করে আমরণ জীবন যাপন করে গিয়েছেন।
তিনি একাধারে যেমন ছিলেন পরম দয়ালু তেমনি কঠোর আদর্শপরায়ণ। তিনি যেমন ছিলেন জীবন যাপনে মিতব্যয়ী ও স্বাবলম্বী, তেমনি ছিলেন পরহিতব্রতী মানুষ। শিক্ষানুরাগী আত্মমর্যাদা পরায়ণ শিক্ষার্থীদের পরম আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। সকলকে নিয়ে সুন্দরভাবে শিক্ষিত সমাজ গড়ে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর প্রবল। পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিও তিনি ছিলেন অঙ্গিকারাবদ্ধ। তাই তাঁর পারিবারিক জীবন ছিল সমাজ ও মানুষের কল্যাণার্থে উৎসর্গিকৃত। বস্তুত তাঁর পারিবারিক জীবন ছিল সকল আত্মীয়-অনাত্মীয়, গ্রামের বা দেশের মানুষের ঠিকানা।
ধর্মসাধনার মাধ্যম হিসেবে মানব সাধনা করে তিনি ধর্মীয় পরিতৃপ্তি লাভ করতেন। নিজ গ্রামের অনাথ শিশু ও বিধবাদের অত্যন্ত সংগোপনে অর্থ ও বস্তু দিয়ে তাঁর কর্ম জীবনের শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত সহায়তা করে গিয়েছেন। মহানবীর আদর্শে তিনি তাঁর কলেজ জীবনের দিনগুলোতে সমবয়সীদের নিয়ে নিজগ্রামে গড়ে তুলেছিলেন ‘আনজুমানে খাদেমুল ইনসান’ নামে সমাজসেবামূলক একটি সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৎকালীন বৃহৎ বঙ্গে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। অনাহারে ক্লিষ্ট মানুষ খাদ্যাভাবে মরে থাকতে দেখেছেন কলকাতায় এবং নিজ গ্রামেও। সে সময়ে গ্রামে মহামারি আকারে মানুষ মারা যেত কলেরা ও ম্যালেরিয়ায়। এসব প্রত্যক্ষ করে তিনি অতিশয় বিচলিত হয়ে পড়েন। এ জন্য তিনি তাঁর সহযোগী গ্রামবাসীদের নিয়ে ঐ ‘আনজুমানে খাদেমুল ইনসান’ সংগঠনের মাধ্যমে ঐ সময়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি চেরিটেবল ডিসপেন্সারি এবং নাম দিয়েছিলেন এলাকার শাহ সাহেবের নামানুসারে মাহতাবীয়া চেরিটেবল ডিসপেন্সারি। পরবর্তীকালে এটি সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার
মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছেন পরিপূর্ণ ধর্মীয় নিষ্ঠায় এবং শুধুমাত্র পিতামাতার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় তাঁদের সুখের জন্য গ্রামের পুরান বাড়ি থেকে সন্মুখের মাঠের জমিতে নতুন পৈত্রিক বাড়ি নির্মাণ করেন। বাহির বাড়িতে ইন্দারা, বৈঠকখানা, ভিতর বাড়িতে চার ভিটায় চারটি ঘর এবং অন্দর মহলের আঙিনায় রান্নাঘর, ঢেকিঘর এবং বাহির বাড়িতে ও অন্দরমহলে পৃথক পৃথক কুয়া, গোসলখানা ও পায়খানা, এমনকি টিনের গোয়ালঘরসহ বাড়ির চতুর্দিকে সাজানো বাগান ও ফলের গাছ লাগিয়ে একটি আদর্শ বাড়িতে রূপান্তর করেন তিনি কর্মজীবনের শুরুতে। তখনকার দিনে গ্রামে কোনো টিউবওয়েল ছিল না। এবং আধুনিক সেনিটেশনের ধারণাও ছিল না। কুয়া, পুকুর বা নদীর পানি দিয়ে গ্রামের জনজীবন চলতো। মানুষের পানির কষ্ট লাঘবের জন্যই তিনি তাঁর বাহির বাড়ির ইন্দারা তৈরি করে দিয়েছিলেন।
তিনি পিতার ইচ্ছায় গ্রামে জমিও কিনে দিয়েছিলেন পৈতৃক জমির সাথে। তাঁর কেনা অনেক জমিই তখনকার নিয়মানুযায়ী পিতা মুহম্মদ মুকিমউদ্দিন ও ছোট চাচা মুহম্মদ ইফাজউদ্দিনের নামে রেজিস্ট্রি করা হতো। এমনি একটি জমি ও বাগানবাড়ি এলাকার নদীর ধারে তিনি কিনেছিলেন। সেই জমিতে ইট পুড়িয়ে ১৯৬১ সালে মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন মোল্লাপাড়া জামে মসজিদের পাকা ভবন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন চাচা মুহম্মদ ইফাজউদ্দিন মোল্লার সাথে।
মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিনের একমাত্র ছোট ভাই মুহম্মদ মকছুদুর রহমান ছিলেন বয়সে অনেক ছোট। তাকে পরম স্নেহে নিজের কাছে রেখে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন। পরে তাকে ব্যবসার জন্য পুঁজি দেন। ব্যর্থ হলে কৃষি বিভাগে চাকরিও দিয়ে দেন এবং বিয়ে দিয়ে দেন । গ্রামের বাড়ির জমিজমা, গরু-বাছুর, নৌকাসহ সকল স্থাপনা তাকেই দিয়ে দেন। মুহম্মদ মকছুদুর রহমান সুনামের সাথেই এগ্রিকালচার এক্সটেনশন অফিসার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।। অবশ্য মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিনকে তাঁর চাচাতো ভাই, ভাতিজা এমনকি অনাত্মীয় গ্রামের অনেককেই লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নিতে হতো সেই সময়।
আরও পড়ুন বাংলাদেশে বইমেলার প্রবর্তক সরদার জয়েনউদ্দীন
এলাকার একমাত্র ঈদগা মাঠের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমাম ছিলেন হাজী মুহম্মদ কিসমত উল্লাহ। এই ঈদগাহ মাঠে ১৯৩০ সালের জমিদারের নিষেধ উপেক্ষা করে এলাকার শাহ সাহেব শাহ মাহতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে হাজী মুহম্মদ কিসমত উল্লাহ তখনকার মুসলিম প্রজা সমাজে বকরা ঈদ শেষে প্রথম কোরবানি দিতে সক্ষম হন এবং পরে প্রতি বকরা ঈদে তা চালু থাকে। এই ঈদগাহ মসজিদটি ও এর সংলগ্ন কবরস্থানটি উন্নয়নে মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন পরবর্তীকালে নেতৃত্ব দেন এবং ঈদগাহ ময়দানে প্রতি ঈদের নামাজের শেষে সংগৃহিত সমুদয় অর্থসহ নিজের অর্থও তিনি নিয়মিত দান করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের আবাসিক ছাত্র থাকা কালে মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন হাউজ টিউটর হিসাবে পেয়েছিলেন শিক্ষাবিদ ও পীর ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যেই তাঁর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের গোড়াপত্তন হয়। ফলে তিনি সংস্কারমুক্ত ধর্মনিষ্ঠতা ও উচ্চশিক্ষার আলোকে নিজেকে গড়ে তোলেন এবং ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিকতার সাথে সাথে নিষ্ঠাবান ধার্মিক হিসাবে পথ চলেছেন। তিনি ছিলেন honest not by chance but by choice. তিনি তাঁর প্রতিটি ছেলে-মেয়েকে প্রথমে ধর্ম শিক্ষা ও সে আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
উল্লেখ্য, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব মরহুম আব্দুল হাই সিদ্দিকী খেলাফত দান করেছিলেন। তাঁর নির্দেশে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজের পীর হিসেবে এবং বিশ্ব ইসলামী মিশনের খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই বিশ্ব ইসলামী মিশনের একজন সদস্য হিসেবে মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন জড়িত ছিলেন। আরও উল্লেখ্য ১৯৬৯ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর তিরোধানের পর ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব মরহুম আব্দুল হাই সিদ্দিকী বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য তৎকালের বিভাগীয় কমিশনার সৈয়দ আহমদ চৌধুরীকে খেলাফত দান করেন। এই মরহুম সৈয়দ আহমদ চৌধুরীকে পরম শ্রদ্ধায় ও ভালবাসায় পীর হিসেবে মেনে উচ্চ শিক্ষিত মুরিদদের (অধিকাংশই সচিব পর্যায়ের) সাথে ধর্মসাধনায় ও আধ্যাত্মিকতায় উন্নতি সাধনের জন্য তিনি ঢাকায় শেষ জীবন কাটিয়েছেন।
আরও পড়ুন আবদুল গণি হাজারী
এর আগে মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত রাজশাহী সরকারী মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। তখন রাজশাহী ছিল জ্ঞানের নগরী। রাজশাহীর বিদ্বৎসমাজে মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন সুপরিচিত ছিলেন। রাজশাহী বেতারে ধর্মীয় ও শিক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন কথিকা প্রচার ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলে জ্ঞানী গুণীদের সভায় মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন অন্যতম ছিলেন। সেই ষাটের দশকে সৈয়দ আহমদ চৌধুরী রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন এবং তাঁরই বাসভবনে আধ্যাত্মিক সাধনার বৈঠকগুলো হতো। সেখানে মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন ছিলেন অন্যতম উদ্যোগী সহযোগী। রাজশাহী বাজার জামে মসজিদ কেন্দ্রিক ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যেও তিনি ছিলেন অন্যতম সঞ্চালক। এ সকল প্রাতিষ্ঠানিক সমাজসেবামূলক ধর্মীয় উদ্যোগ তাঁর কর্মস্থল ঢাকা ও রাজশাহীতে যেমন ছিল নিজ গ্রামেও তার স্বাক্ষর রয়ে গিয়েছে।
মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন বাড়িঘর ছেড়ে প্রবাসে থেকে অনেক কষ্টে অনেক প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। তাই তাঁর সতত ইচ্ছা ছিল নিজ গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য অন্তত মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। তিনি যে মক্তবে প্রথম পাঠ গ্রহণ করেছিলেন সেই তালিমনগর মাদ্রাসাকে অনেক প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ১৯৬৭ সালে হাইস্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং নাম দেন শাহ মাহতাব উদ্দিন হাইস্কুল।
এখানে উল্লেখ্য, শাহ মাহতাব উদ্দিন ছিলেন এলাকার শাহ সাহেব বা আধ্যাত্মিক গুরু। এই শাহ সাহেব তরুণ বয়সে সংসারবিরাগী হয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করে শেষে ভারতের ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রঃ)-এর সংস্পর্শে আসেন এবং তাসাওয়াফপন্থী শাহ সাহেব হন। ফুরফুরা শরীফের পীরসাহেবের পরামর্শে তিনি নিজ এলাকায় এসে নিরক্ষর কৃষিজীবী মুসলমান সমাজে শিক্ষার আলো ছড়াতে প্রয়াস পান। তাঁর কাজের সারথী হন এলাকার ওস্তাদজি হাজি মুহম্মদ কিসমতউল্লাহ। এই হাজি মুহম্মদ কিসমতউল্লাহ ঊনিশ শতকের শেষে এলাকায় একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রথমে বয়স্ক শিক্ষা দিতেন বলে তিনি ছিলেন এলাকার ওস্তাদজী। পরে নিয়মিত শিক্ষা দেয়ার একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই মক্তবকে তিনি চালু করেন।
আরও পড়ুন নিউরো সার্জন অশোক কুমার বাগচী
সুজানগর উপজেলার প্রথম এম এ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) মাওলানা রইচ উদ্দিন এই মক্তবের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বস্তুত শাহ সাহেব তাঁকে মানসপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১১ সালে এম. এ. পাস করিয়ে আনেন এবং ঐ মক্তবটিকে মাদ্রাসায় রূপান্তর করার জন্য তাঁকে নির্দেশ দেন। শাহ সাহেবের নির্দেশে এলাকার সহযোগিতায় মাওলানা রইচউদ্দিন ঐ মক্তবকে ১৯২৬ সালে নিউস্কিম শিক্ষাপদ্ধতির জুনিয়র মাদ্রাসায় উন্নিত করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই জুনিয়র মাদ্রাসা আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকেই মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন হাইস্কুলে উন্নীত করেন।
মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিনের পিতারা ছিলেন তিন ভাই। বড় চাচা ছিলেন গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। জমিদারদের সাথে তাঁর ওঠাবসা ছিল। সেই বড় চাচা ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অকালে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। তখন তাঁর ছোট ভাই মুহম্মদ মুকিম উদ্দিনের ইচ্ছা দেখা দিয়েছিল বংশের পরবর্তী প্রজন্মের প্রথম সন্তানকে কলকাতার এম বি ডাক্তারদের মতো ডাক্তারি পড়াবেন। মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন তখন সদ্য বিবাহিত। তাঁর প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে গ্রামে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। কারণ ঐ প্রজন্মের সেই ছিল প্রথম সন্তান এবং পুত্র সন্তান। বড় চাচা মুহম্মদ ময়ছেরউদ্দিন তথা গ্রামের সবেচেয়ে মান্যবর মাতবরের মৃত্যুতে শোকবিহ্বল গ্রামবাসী যেন এই পুত্র সন্তান পেয়ে তখনই একজন ডাক্তার পেয়ে গেল। দাদা দাদীর বড় আদরের এই নাতিকে অর্থাৎ মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন তাঁর প্রথম সন্তানকে নিজ হাতে গড়ে তোলেন।
আরও পড়ুন কবি ও কথাসাহিত্যিক আনন্দ বাগচী
গ্রামের আয়েশী জীবন ত্যাগ করে শহরে থেকে নিজের একটিমাত্র ছোট ভাই ও প্রথম সন্তানকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন। তিনি তাঁর প্রথম সন্তানকে ডাক্তারি পড়িয়েছিলেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সদ্য প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজে। প্রথম সন্তান অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুস সাত্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে এম বি বি এস পাস করেন এবং স্টেট স্কলারশীপ নিয়ে লণ্ডনের রয়েল কলেজ অব অবথলমোলজি থেকে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডিও ডিগ্রি অর্জন করেন। পিতা মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন তাঁকে ডাক্তারী পড়াতে উদ্বুদ্ধ করে বলেছিলেন চিকিৎসা সেবা দিয়ে মানুষকে যত উপকার করা যায় অন্য কোন পেশায় তা সম্ভব নয়। পিতার ইচ্ছা অনুযায়ী ছাত্রাবস্থায়ই তিনি গ্রামে মেডিকেল টিম নিয়ে বসন্ত রোগ নির্মূল অভিযানে চিকিৎসা সেবা দিতেন। চক্ষু বিশেষজ্ঞ হয়ে গ্রামে নিয়মিত চক্ষু শিবিরও করতেন। প্রফেসর অব অবথলমোলজি মুহম্মদ আব্দুস সাত্তারও নিজ গ্রামে একটি চক্ষু হাসপাতাল করে গিয়েছেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে সিভিল সাপ্লাই কর্মকর্তা থাকাকালে সেকান্দার ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিনকে বর্তমান ধানমণ্ডি এক নম্বরে এক বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি তা গ্রহণ না করে পুনরায় তাদেরকেই জমিটি রেজিস্ট্রি করে ফিরিয়ে দেন। পরবর্তীকালে সরকারিভাবে ধানমণ্ডির প্লট বরাদ্দ পেয়েও তিনি তা নেননি। তাঁর ইচ্ছা ছিল চাকরি জীবনের শেষে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর শ্যালক সার্কেল অফিসার আবদুল কাদের খানের ছেলে এনামুল হক খানের জমি কেনায় সহায়তা করতে যেয়ে জিগাতলার মামলত হাজীর ১১ কাঠা জমি তাঁকেও কিনতে হয়। তাঁর বন্ধু ও পীর অবসরপ্রাপ্ত কমিশনার সৈয়দ আহমদ চৌধুরীর নির্দেশে গ্রামে যাওয়া আর হয় না, ধর্ম সাধনার জন্য। জিগাতলায় তাঁর জমিতে নিজেই টিনসেড বিল্ডিং করে থাকতে শুরু করেন। এই বাড়ির ভিত্তি দেন মরহুম পীর সাহেব।
আরও পড়ুন কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক বিমল কুণ্ডু
জিগাতলার মূল জমির মালিক মামলত হাজির নিকট থেকে তিনি এগার কাঠা ধানিজমি প্রভিডেন্ট ফান্ডের পনের হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেছিলেন যার অর্ধেক অর্থাৎ সাড়ে পাঁচ কাঠা জমি তাঁর বড় ছেলে প্রফেসর ডা. মো. আব্দুস সাত্তারকে দলিল করে দিয়ে দেন। এখানেও তাঁর মহত্ত্ব – তাঁর নিজহাতে গড়া বড় ছেলের প্রতি গভীর ভালবাসা এবং তিনি আশা করেছিলেন বড় ছেলেই বাড়ি করবে। কিন্তু অবসর জীবনে তাঁকে শুধু বাড়িই করতে হয়নি রাস্তাহীন এই ধানমণ্ডির প্রান্তে তখন জিগাতলা থেকে কোন সংযোগ রাস্তা ছিল না। এই বাড়ি করার সূত্রে তিনি জিগাতলার পূব উত্তর মাথা থেকে ধানমণ্ডি ৭/এ রাস্তার পশ্চিম মাথার উত্তর-দক্ষিণ সড়কটি তখনকার ঢাকা মিউনিসিপালিটিকে দিয়ে নিজ উদ্যোগে করিয়ে নেন।
মরহুম মুহাম্মদ খোয়াজউদ্দিনের প্রস্তাবে হাজী আব্দুর রাজ্জাক ও আতিকুর রহমানের সহযোগিতায় মামলত হাজির নাতী আবুল হোসেনকে মোতাওয়াল্লি করে তার পশ্চিমের জমিটুকুতে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এই বায়তুত তাওয়াব মসজিদের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ খোয়াজউদ্দিন এবং তিনি প্রায় এক বছর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ইমামতির দায়িত্বও পালন করেন। তখনকার কাঁচা মসজিদটির ওজুর ব্যবস্থাও তিনি নিজ ব্যয়ে করেছিলেন। পরে ইমাম নিয়োগ করা হলে তার খাওয়া ও বেতনের যে ব্যবস্থা করা হয় তার অন্যতম দায়িত্ব পালনকারী ছিলেন মরহুম মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন। এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন পীরসাহেব মরহুম সৈয়দ আহমদ চৌধুরী।
আরও পড়ুন কবি ও গল্পকার খলিফা আশরাফ
মৃত্যু: মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন পীর সাহেবের উচ্চশিক্ষিত মুরিদদের (অধিকাংশই সচিব পর্যায়ের) সাথে নিয়মিত কোরআনের তফসির ও জেকেরের মাহফিলে শয্যা গ্রহণের আগ পর্যন্ত নিয়মিত উপস্থিত থেকে আত্মিক উন্নতিতে মগ্ন থাকতেন। উচ্চ রক্তচাপ রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থেকে ১৯৮৫ সালের ৩০শে মে মোতাবেক ১১ রমজান তিনি তাঁর ঢাকার নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পীর সাহেব প্রায় প্রতি সপ্তাহে শয্যাশায়ী মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিনকে দেখতে আসতেন এবং তাঁর ইন্তেকালে তাঁর জিগাতলা বাড়ির আঙিনায় পীর সাহেব তাঁর জানাযার নামাজ পড়িয়েছিলেন ও বলেছিলেন তিনি একজন কামেল মানুষ তাঁর কবরের ঠিকানা যেন রাখা হয়।
ব্রিটিশ আমলে সিভিল সাপ্লাইজের ইন্সপেক্টর থাকাকালে তাঁর সততার প্রতি মুগ্ধ হয়ে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের ম্যানেজার দক্ষিণারঞ্জন বাবু বলেছিলেন মাওলানা সাহেব দেবতা-তুল্য শুদ্ধ মানুষ এবং সেকেন্দার ইণ্ডাস্ট্রিজের মালিক বলেছিলেন তিনি ঈমান ও ইয়াকীনে একজন প্রকৃত মুমেনিন, সততায় সাদেকীন এবং সৎকর্মশীলতায় সালেহীন। মুহম্মদ খোয়াজ উদ্দিন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর এই ঈমান, আকিদা ও আমল বজায় রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন অধ্যাপক মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন-
১ম পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
অধ্যাপক মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন (২য় পর্ব)