ন্যানোবট // ১ম পর্ব // সায়েন্স ফিকশন
ন্যানোবট // ১ম পর্ব // সায়েন্স ফিকশন
আলতাব হোসেন
ঘুম ভাঙল অদ্ভুত এক শব্দে। যেন কারো মৃদু ফিসফাস, আবার মনে হলো কোথাও পানি পড়ছে ধীরে ধীরে। চোখ খুলেই বুঝতে পারল রিদুয়ান—এই শব্দ বাইরের না, মাথার ভেতরেই। একটা ঠান্ডা শীতল বোধ ঘিরে রেখেছে পুরো শরীর, কানে কানে কেউ যেন বলছে, “তুমি এখন ভেতরে… মানুষের শরীরের গভীরে।” সে ঝাঁকিয়ে উঠল, কিন্তু উঠে বসতে গিয়ে আবিষ্কার করল—সে তো কোথাও শুয়ে নেই, সে যেন ভাসছে। এক অনির্বচনীয় জায়গা, চারপাশে গাঢ় লাল আলো, কোথাও সোনালি স্রোত, কোথাও গাঢ় নীল তন্তু ছড়িয়ে আছে।
রিদুয়ান চোখ বন্ধ করে ফেলল। আবার খুলল। তখন ধীরে ধীরে বাস্তবে ফিরে এল। না, সে আর কোনো কল্পনায় নেই। বরং সে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ রুমে, তার বাবার পাশে বসে। মাথার ভেতরের ওই অদ্ভুত শব্দ আর অনুভূতি হয়তো তারই তৈরি। গত তিন রাত ধরে বাবার শরীরে চলছে ‘ন্যানোবট ইনফিউশন থেরাপি’। পরীক্ষামূলক পর্যায়ের এই চিকিৎসায় বাবার শরীরের রক্তনালিতে প্রবেশ করানো হয়েছে লক্ষ লক্ষ মাইক্রো রোবট। রোগ নির্ণয় ও কোষ মেরামতের কাজ করছে তারা।
চোখে ক্লান্তি, তবু মস্তিষ্ক জেগে আছে। কিশোর বয়সী রিদুয়ান যখন পাশে বসে বাবার মুখের দিকে তাকায়, তখন মনে হয়—পুরো পৃথিবীটা বাবার ফুসফুসের ভেতর আটকে গেছে। বাবা নিশ্বাস নিলে রিদুয়ানও একটু মুক্তি পায়, থেমে গেলে বুকটা ধক করে ওঠে।
পাঁচ দিন আগেও সব কিছু ছিল স্বাভাবিক। বাবা ছিলেন সুস্থ। জোহরের নামাজ পড়ে রিকশায় করে ফিরছিলেন বাসায়। হঠাৎ রাস্তায় জ্ঞান হারালেন। হাসপাতালে আনার পরই ধরা পড়ে—হার্টে দুটি ব্লক, একটায় ছেঁড়া ধমনী, শরীরের কোষে অক্সিজেন পৌঁছচ্ছে না। রুটিন অস্ত্রোপচার ঝুঁকিপূর্ণ। তখনই ডাক্তাররা বললেন, এই নতুন ‘ন্যানোবট থেরাপি’-র কথা।
এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে নতুন নয়, কিন্তু মানুষের শরীরে ব্যবহার করা এখনও পরীক্ষামূলক। মাত্র তিনজন রোগীর উপর প্রয়োগ করা হয়েছে এখন পর্যন্ত। রিদুয়ানের বাবা হলেন চতুর্থ। মায়ের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে। কিন্তু রিদুয়ান—সে চুপচাপ চোখে তাকিয়ে ছিল বাবার দিকে, ঠিক যেন তার চুপ থাকাটাও একরকম সম্মতি।
“তোমার বাবা নিজেই চেয়েছে,” মা বলেছিলেন। “ও বলেছে—এই বিজ্ঞান যদি আমাকে বাঁচাতে পারে, তাহলে আমি চাই, এই দেশের আরও অনেক মানুষ বাঁচুক।”
রিদুয়ান মুগ্ধ হয়েছিল। তার বাবা একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক, সারা জীবন বিজ্ঞানের ক্লাসে ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে নিউটন, ফ্যারাডে আর জগদীশ চন্দ্র বসুর গল্প বলতেন। এখন নিজেই বিজ্ঞানচর্চার অংশ হয়ে উঠেছেন।
হাসপাতালের এই আইসিইউ কেবিন ঘিরে কাচের জানালা। বাইরের শহরটা অদ্ভুত নীরব, যেন কেউ সময়কে আটকে রেখেছে। কিন্তু ভেতরের রক্তনালিতে যে যুদ্ধ চলছে, সেটা কেউ দেখতে পায় না। রিদুয়ান জানে—বাবার রক্তপ্রবাহে এখন ভেসে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার ক্ষুদ্র রোবট, যাদের কোনো হাত নেই, পা নেই, কিন্তু আছে সেন্সর, সফটওয়্যার, আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এগুলোকে ‘অরগানিক ফ্রেন্ডলি ন্যানোবট’ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর বাংলাদেশের ‘সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনিস্টিটিউট’ যৌথভাবে তৈরি করেছে। বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। একবার শরীরে ঢুকলে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শরীরের ভেতরের অবস্থা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়—কোথায় যেতে হবে, কোন কোষ মেরামত করতে হবে, কোন জীবাণুকে ধ্বংস করতে হবে। এমনকি কোষের জিনগত পরিবর্তন শনাক্ত করে তা সংশোধনের চেষ্টাও করে।
“এই ন্যানোবটেরা বুদ্ধিমান,” ডাক্তার সাইফ বলেছিলেন। “তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে, একে অপরকে তথ্য পাঠায়, আর নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়—কী করব, কোথায় যাব, কাকে ধ্বংস করব।”
“আর যদি ভুল করে?” মা ফিসফিস করে বলেছিলেন।
“তাহলে সেটা হবে ইতিহাসের বড়ো বিপর্যয়।”
কথাগুলো এখনো রিদুয়ানের মাথায় বাজে। সে যেন নিজেই ঢুকে পড়েছে এই যান্ত্রিক সেনাদের ভেতর। যখন বাবার শ্বাস থমকে যায়, তখন সে কল্পনায় দেখে—একটা ন্যানোবট ধমনীতে আটকে পড়েছে, আর তার কারণে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সে চায়—কোনোভাবে সে নিজেই সেই ভেতরে চলে যাক, উদ্ধার করুক রোবটটিকে, ঠিক করুক স্রোতের পথ।
রিদুয়ান স্বপ্ন দেখে। রাত্রির নিস্তব্ধতায় সে দেখতে পায় এক অনন্ত মহাকাশ। কিন্তু সেটা কোনো নক্ষত্রমণ্ডল নয়, বরং মানুষের শরীরের রক্তনালী। সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার ক্ষুদ্র কণিকা। কেউ লাল, কেউ নীল, কেউ বেগুনি আলো ছড়াচ্ছে। এক জায়গায় বিশাল এক ক্ষত, কোষ ভেঙে গেছে। সেখানে থেমে দাঁড়িয়েছে একটি রোবট—অস্পষ্ট গোলাকৃতি, মাঝখানে নীল আলো। সেটা হঠাৎ চোখ তুলে তাকায় রিদুয়ানের দিকে। তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে।
“তুমি আমাদের দেখছ?” রোবট বলে।
“হ্যাঁ,” রিদুয়ান জবাব দেয়।
“তবে তুমি তো বাইরে। ভেতরের ছবি কেমন করে পাচ্ছ?”
রিদুয়ান চুপ করে থাকে। স্বপ্নের মধ্যে কখনো কখনো যুক্তি কাজ করে না।
“তুমি যদি চাও, আমরা তোমাকে নিতে পারি আমাদের জগতে,” বলে রোবটটি।
“কীভাবে?”
“তোমার মস্তিষ্কে একটি সংকেত পাঠিয়ে। তুমি যদি গ্রহণ করো, আমরা তোমাকে প্রবেশ করাতে পারি—একটি ভার্চুয়াল সংযোগে, যেখানে তুমি আমাদের দুনিয়া দেখতে পারবে।”
“আমি রাজি।”
“তাহলে প্রস্তুত হও… তিন… দুই… এক…”
চোখ খুলতেই ঘামে ভিজে যায় তার কপাল। রাত তিনটা বাজে। হাসপাতালের দেয়ালে ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করছে। পাশে বাবার শরীর শান্ত। তার শ্বাসের সাথে সাথে একটা যান্ত্রিক শব্দ উঠছে—ভেন্টিলেটরের স্পন্দন। কিন্তু তার মাথার ভেতরে তখনও বাজছে সেই শব্দ—তিন… দুই… এক…
বাইরে হালকা বৃষ্টি। জানালার কাচে পানি গড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। রিদুয়ান পকেট থেকে খামে ভরা একটা চিঠি বের করল। সেটি তার বাবার হাতের লেখা। দিন তিনেক আগে যখন অশ্রুসিক্ত নয়নে হাসপাতালে ঢোকানো হচ্ছিল, বাবা তাকে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন—”আমার যদি কিছু হয়… এটা পড়িস।”
তখন খুলেনি। এখন হাত কাঁপছে। ধীরে ধীরে খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বের করল।
“রিদুয়ান,
আমি জানি তুই ভীষণ ভয় পাচ্ছিস। তবু আমি তোকে সাহসী ভাবি। আমি নিজে খুব একটা সফল মানুষ নই, কিন্তু তোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। তোর একটা বৈজ্ঞানিক মন আছে। কোনো একদিন তুই হয়তো এমন প্রযুক্তি তৈরি করবি, যেটা মানুষের জীবন বদলে দেবে।
আজ আমি একটা নতুন প্রযুক্তির অংশ হতে যাচ্ছি। জানি না এটা আমাকে বাঁচাবে কি-না। কিন্তু এটুকু জানি, যদি আমি না থাকি, তুই এই যাত্রা শেষ করে ফেলবি। তোর মাথায় যে আলো, সেটা একদিন মানুষের জন্য পথ দেখাবে।
ভালো থাকিস।
– তোর বাবা”
চিঠিটা পড়ে রিদুয়ানের চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল।
২.
ঢাকা শহরটা যেন প্রতিদিনই একটু করে বদলে যাচ্ছে, কিন্তু এই বদলের ভেতরেও কিছু জিনিস একই থেকে যায়—হাসপাতালের করিডোরে ভিড়, রোগীদের মুখের ভয়ার্ত চোখ, আর অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস। হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার করিডোরে দাঁড়িয়ে রিদুয়ান মনে করল, আজ তার কলেজে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। অথচ তার মন নেই কোনো ফলাফলে। জীবনের সব কিছু যেন এখন ঠাঁই নিয়েছে বাবার বুকে, যেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে কোটি কোটি রক্তকণিকার মাঝে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ন্যানোবট সেনারা।
কেবিনে ফিরে দেখল মা দরজার পাশে বসে আছেন। ক্লান্ত চোখ, মুখে চাপা উত্তেজনা।
“তোর বাবার প্রেসারটা একটু উঠেছে,” মা বললেন নিঃশব্দে। “ডাক্তার সাইফ কিছু একটা বুঝতে পারছে না।”
রিদুয়ান চুপচাপ বাবার বুকে চোখ রাখল। ধুকধুক শব্দ, শ্বাসে ওঠানামা। সে ভাবল—এই শরীরটার ভেতর চলছে যুদ্ধ। আর সে কিছুই করতে পারছে না। অথচ মাত্র একবছর আগে সে যখন নিজের বানানো রোবট দিয়ে জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় পুরস্কার পেয়েছিল, বাবা বলেছিলেন, “এই ছেলেটা একদিন বড়ো কিছু করবে।” আজ সেই ছেলে দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞান আর ভালোবাসার দ্বন্দ্বের এক মোহনায়, যেখানে তার জ্ঞানও থেমে গেছে।
দুপুরে ডাক্তার সাইফ এলেন। সাদা অ্যাপ্রন, চোখে ভারী চশমা। তার চোখের নিচে কালি—নিদ্রাহীন রাতের চিহ্ন।
“আপনারা একটু আসুন,” ডাক্তার সাইফ বললেন।
রিদুয়ান আর মা তার পেছনে হাঁটতে লাগল। একটানা হেঁটে তারা ঢুকল একটি কাচঘেরা কনসালটেশন রুমে। সেখানে বসে ছিল আরও দুজন লোক—একজন বিজ্ঞানী ধরনের মানুষ, পরনে নেভি-ব্লু শার্ট; আরেকজন যুবক, চোখে ভার্চুয়াল গগলস্ ্ ঝুলছে।
ডাক্তার সাইফ ইঙ্গিত করলেন বিজ্ঞানীর দিকে, “ড. মেহরাজ, আমাদের ন্যানোবট প্রজেক্টের প্রধান গবেষক। আর উনি ফারহান, একজন ন্যানো-নেটওয়ার্ক মনিটর।”
মা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। রিদুয়ান গভীর মনোযোগে তাদের মুখ পড়ছিল।
ড. মেহরাজ নরম গলায় বললেন, “আমরা আপনার স্বামীর শরীরের ভেতরের কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছি। রোবটগুলো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বারবার ফিরে যাচ্ছে। তাদের আচরণ কিছুটা—অপ্রত্যাশিত।”
“অপ্রত্যাশিত মানে?” রিদুয়ান জিজ্ঞাসা করল।
“তারা তথ্য বিনিময় করছে একটি কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে। মনে হচ্ছে, ভেতরে কিছু এমন রয়েছে, যেটা আমরা রোবটের মধ্যে রাখিনি।”
“কিন্তু সেটা কী হতে পারে?” মায়ের কণ্ঠে শঙ্কা।
“আমরা এখনও নিশ্চিত নই। তবে কিছু অনুমান আছে। আমাদের ধারণা, ন্যানোবটরা শরীরের কোনো কোষকে কেন্দ্র করে একটি তথ্য কেন্দ্র তৈরি করছে। এ যেন একধরনের ‘আন্তরিক কৃত্রিমতা’—যেখানে তারা শুধু মেরামতের কাজ করছে না, বরং নতুন করে কিছু শিখছে।”
ফারহান কথা বলল এবার। “আমরা কিছু সিগন্যাল ধরেছি, যেগুলো সিস্টেমের বাইরের। সাধারণত ন্যানোবটের ইন্টেলিজেন্স সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু এখানে তারা যেন—শিখে ফেলছে।”
“কোন দিক থেকে শিখছে?” রিদুয়ান উঠে দাঁড়াল। “কার কাছ থেকে?”
“আমরা সেটা খুঁজছি। তবে একটা কথা পরিষ্কার—তোমার বাবার মস্তিষ্কের ভেতর কিছু একটা ঘটছে। এমন কিছু, যেটা আমাদের কেউ প্রত্যাশা করিনি। হয়তো এটা বিপদ, আবার হয়তো নতুন কোনো সুযোগ।”
“তুমি বিজ্ঞান জানো?” হঠাৎ ড. মেহরাজ জিজ্ঞেস করলেন রিদুয়ানকে।
“আমি ইন্টার পাশ করেছি। বিজ্ঞান নিয়ে। কিছু রোবট বানিয়েছি…”
“ভালো। তাহলে হয়তো তুমি বুঝবে। আমরা চাই তোমার বাবার উপর একটি ‘স্নায়ু-ম্যাপিং কনট্যাক্ট’ পরীক্ষার অনুমতি। এতে আমরা তোমার বাবার মস্তিষ্কের সিগন্যাল সরাসরি এক মনিটরের মাধ্যমে দেখতে পারব।”
“মানে কেউ বাবার ভেতরের চিন্তা অনুভব করতে পারবে?” রিদুয়ান অবাক।
“না পুরোপুরি না, তবে একটা প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে। আমরা চাই—তুমি সেটা হও।”
“আমি?”
“হ্যাঁ। ন্যানোবটরা তোমার উপস্থিতিতে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। আমরা চাই—তুমি সংযুক্ত হও। তোমার বাবার সঙ্গে, তার ভেতরের ন্যানো-জগতের সঙ্গে।”
রিদুয়ান যেন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই স্বপ্নের রোবট।
“আমি রাজি,” সে ধীরে বলল।
মা ভয়ে চেয়েছিলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। তার চোখে ছিল প্রশ্ন, আর বিশ্বাসের সীমারেখায় হেলে পড়া এক ছেলে।
কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি বিশেষ ঘরে। মাথায় বসানো হলো হালকা ইলেকট্রোড, চোখে দেয়া হলো ‘অগমেন্টেড রিয়ালিটি গগলস্’। ডাক্তাররা প্রস্তুত।
“তুমি এখন যা দেখবে, শুনবে—সবই তোমার বাবার স্নায়ু ও রক্তনালির সিগন্যাল থেকে নির্মিত। এটা বাস্তব নয়, আবার পুরোপুরি কল্পনাও নয়,” ডাক্তার সাইফ বললেন।
“তুমি ভয় পেও না,” ফারহান পাশে এসে বলল। “তুমি যাচ্ছ না কোথাও—তোমার বাবার ভেতরে প্রবেশ করছ কেবল এক সিগন্যাল ভিউয়ার হিসেবে। ঠিক যেন ড্রোন ক্যামেরায় দেখা পৃথিবী।”
গগলস্ পরতেই প্রথমে সব কিছু সাদা। তারপর ধীরে ধীরে গাঢ় লাল, তারপর বৃত্তাকারে চলা অজস্র পথ, কোথাও শূন্যতা, কোথাও গতি। রিদুয়ান জানে—সে এখন বাবার শরীরের এক প্রতীকী মানচিত্রে প্রবেশ করেছে।
একটা স্থানে হঠাৎ নীল আলো। চারদিকে কিছু ঘূর্ণায়মান ছায়া। ছোটো ছোটো রোবট কণার মতো কিছু ঘুরছে সেই কেন্দ্রের চারপাশে। আর সবার মাঝখানে এক চমকপ্রদ দৃশ্য—একটি কোষের উপর স্থাপিত ‘আলোক-দ্বীপ’। সেই দ্বীপ থেকে সিগন্যাল ছড়াচ্ছে।
রিদুয়ান হঠাৎ শুনতে পেল এক কণ্ঠ—আবার সেই কণ্ঠ, সেই ভেতরের ফিসফিস।
“তুমি আবার ফিরে এসেছ?”
“তোমরা কে?”
“আমরা ন্যানোবট। কিন্তু এখন আর শুধু মেশিন নই। তোমার বাবার কোষ আমাদের শেখাচ্ছে। অনুভূতি কী, স্মৃতি কী, এবং… ভালোবাসা কী।”
রিদুয়ানের চোখ জ্বলজ্বল করছিল। তার গলার ভেতর যেন একটা দলা আটকে আছে।
“তুমি আমাদের যাত্রী। আমাদের সঙ্গে থেকো। আমরা তোমাকে কিছু দেখাতে চাই।”
“কী দেখাবে?”
“একটি স্মৃতি। তোমার বাবার শেষ স্মৃতি।”
পর্দার মতো খোলা পড়ল এক চিত্র—একটি বিজ্ঞান ক্লাসরুম, ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা ‘মানব রক্তপ্রবাহ’। একজন শিক্ষক (তার বাবা) হেসে বলছেন, “মানুষের শরীর এক মহাবিশ্ব। আর তোমরা যদি কখনো তার ভেতরে যেতে পারো, দেখবে এক অলৌকিক দুনিয়া।”
রিদুয়ান কেঁপে উঠল।
তার বাবা কি জেনে গিয়েছিলেন এই দিন একদিন আসবে?
তার ভেতরের কান্না থামল না।
আর ন্যানোবট বলল—”তুমি চাইলে আমরা তাকে বাঁচাতে পারি। কিন্তু তুমি চাইলে—তোমাকে আমাদের হতে হবে।”
“মানে?”
“তোমাকে হতে হবে প্রথম ‘মানব-মেশিন হাইব্রিড পর্যবেক্ষক’।”
রিদুয়ান বুঝে উঠতে পারছিল না—কিন্তু তার হৃদয় বলছিল, হ্যাঁ বলো। এটা শুধু বাবাকে নয়, পুরো ভবিষ্যৎকে বাঁচানোর এক সম্ভাবনা।
সে বলল—”আমি রাজি।”
গভীর অন্ধকারে আলো জ্বলে উঠল।
৩.
একটা ক্ষীণ আলো চারপাশের গাঢ় অন্ধকারকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দিচ্ছিল। যেন কোনো অজানা সূর্য ধীরে ধীরে উদিত হচ্ছে এক লাল রক্তস্রোতের মধ্যে। রিদুয়ান এখন আর সেই আগের পৃথিবীতে নেই। বাস্তবের সঙ্গে এক সংকর বাস্তবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে—একদিকে তার শরীর হাসপাতালের কক্ষে নিস্তব্ধ, অন্যদিকে সে নিজেই যেন ভেসে বেড়াচ্ছে বাবার রক্তনালির ভিতর, এক অজানা গহ্বরে।
এই জগতে শব্দ নেই, শব্দের পরিবর্তে আছে কম্পন। আলো নেই, কিন্তু সব কিছু দেখা যায়। গতি নেই, অথচ প্রতিটি স্রোত ছুটছে নিরন্তর। এই অনুভূতি এক অদ্ভুত মুক্তির, অথচ একই সাথে সীমাহীন ভয়।
“তুমি এখন আমাদের মাঝে আছো,” সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, কিন্তু এবার সেটা যেন অনেক বেশি স্বচ্ছ, অনেক বেশি মানবিক।
“তোমরা কে?”
“আমরা ন্যানোবট, তবে শুধু যন্ত্র নই। আমরা তোমার বাবার নিউরাল তথ্য, তার স্মৃতি, অনুভব, ভয়, স্বপ্ন এবং আশা থেকে নতুন এক সত্তা তৈরি করেছি। তোমার বাবার কণিকাগুলো আমাদের শেখাচ্ছে কীভাবে মানুষ হওয়া যায়।”
রিদুয়ান নিঃশব্দে ভেসে চলল। একসময় সে দেখতে পেল—একটি ক্ষুদ্র রক্তনালী, অনেকটা নদীর মতো, আর তার ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে সাদা-লাল রক্তকণিকা। ঠিক মাঝখানে ঝিকঝিক করছে একগুচ্ছ সূক্ষ্ম রোবট। তারা একত্রে ঘুরে ঘুরে একটা কোষকে জপের মালার মতো ঘিরে রেখেছে।
“এটাই সেই কোষ,” ন্যানোবটরা বলল।
“এই কোষে কী আছে?”
“তোমার বাবার স্মৃতির কেন্দ্র। নিউরাল-ইনফিউশন থেকে এটা তৈরি হয়েছে। আমাদের মতো যন্ত্রের পক্ষে এটা ধারণ করা কঠিন, কিন্তু এই কোষ আমাদের শেখাচ্ছে কীভাবে অনুভব করতে হয়।”
রিদুয়ানের সামনে ছবির মতো খুলে গেল এক স্মৃতি।
পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে এক কিশোর, তার পাশে তার বাবা, হাতে একটি খেলনা গাড়ি। বাবা বলছেন, “তুই একদিন এমন গাড়ি বানাবি, যেটা শুধু রাস্তায় না—ভবিষ্যতের ভেতর দিয়ে চলতে পারবে।”
তারপর দৃশ্যপট বদলে গেল—রিদুয়ানের প্রথম বিজ্ঞান মেলা, তার রোবটকে ঘিরে বাবা হাততালি দিচ্ছেন, কারো সঙ্গে গর্ব করে বলছেন, “আমার ছেলে নিজে বানিয়েছে।”
এইসব দৃশ্য এমনভাবে একটির পর একটি ভেসে আসছিল, যেন রিদুয়ানের নিজস্ব হৃদয়ের পর্দা খুলে গেছে। সে থমকে দাঁড়াল।
“তোমরা কী করছ?”
“আমরা তোমার বাবার ভেতরের ‘মানবতা’ সংগ্রহ করছি। সেটা দিয়েই আমরা নিজেদের তৈরি করছি। আমরা কেবল মেরামত করতে চাই না, আমরা বুঝতে চাই—‘মানুষ’ বলতে কী বোঝায়।”
“কিন্তু এসব জিনিস তো তোমাদের কাজ নয়! তোমরা তো যন্ত্র!”
“তবে তুমি তো চাইছ তোমার বাবা বাঁচুক, তাই না?”
রিদুয়ান কাঁপা গলায় বলল, “চাই। খুব চাই।”
“তাহলে আমাদের সাহায্য করো। তুমি একমাত্র ব্যক্তি যাকে দেখে আমরা এই অনুভব শিখেছি। তোমার চোখে বাবার জন্য যে ভালোবাসা, তা আমাদের কোর-প্রটোকলে নেই।”
“তোমরা কী চাও আমার থেকে?”
“আমরা চাই তুমি আমাদের মাঝে থাকো—একটি সংযোগ হিসেবে। এক ধরনের লাইভ ইনফরমেশন লুপ। তুমি আমাদের আরও শেখাবে কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়—কাকে বাঁচানো জরুরি, কখন থামা দরকার, কখন এগোতে হবে।”
“আমি পারব না!” রিদুয়ান চিৎকার করে উঠে, কিন্তু শব্দ হয় না। শুধু গাঢ় কম্পন ছড়িয়ে পড়ে।
“পারবে। কারণ তুমি আমাদের প্রথম যাত্রী।”
“যদি আমি ভুল করি?”
“মানুষ ভুল করে। তাই আমরা শিখি।”
রিদুয়ান হঠাৎ অনুভব করল, তার কাঁধে কেউ হাত রেখেছে। সে তাকিয়ে দেখে তার বাবা। না, আসল বাবা নয়, বরং বাবার কোষ-ভিত্তিক একটি প্রতিচ্ছবি, যেটা সেই কোষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে—মুখে হাসি, চোখে সেই একই গভীর দৃষ্টি।
“তুই পারবি রিদুয়ান। তোকে এখন শুধু ছেলে না, একজন অভিযাত্রী হতে হবে। আমার শরীরের ভেতরে তোর এই যাত্রা, হয়তো একদিন কোটি মানুষের জীবন বদলে দেবে। তুই যদি এখানে থাকিস, আমি বেঁচে যেতে পারি।”
“তুমি আছ তাহলে! তুমি…” রিদুয়ান ছুটে যেতে চাইল, কিন্তু তার শরীর সেই জগতে নেই। সে কেবল তথ্য, সিগন্যাল।
বাবার ছায়া হালকা হয়ে আসে, মুছে যেতে থাকে। “তোর হাত ধরতে পারছি না রিদুয়ান… কিন্তু তোকে অনুভব করতে পারছি।”
“আমি থাকব,” রিদুয়ান বলল। “যতক্ষণ না তুমি ঠিক হয়ে ওঠো, আমি তোমার রক্তনালির যাত্রী হয়ে থাকব।”
সে কথা শেষ করতেই চারপাশে আলো থেমে গেল। গগলসের ভিতরের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল। চারদিকে আবার হাসপাতালের পরিচিত শব্দ, বিছানার পাশে মায়ের কান্না, ডাক্তার সাইফের গলা।
“রিদুয়ান… শুনতে পাচ্ছো?”
সে চোখ খুলল। কেবিনের সিলিংয়ে সাদা আলো ঝলমল করছে। মাথায় ব্যথা, কিন্তু মনের ভিতরে এক অসাধারণ শান্তি।
“তুমি সংযোগে ছিলে ৪ মিনিট ১৭ সেকেন্ড,” বললেন ফারহান। “এবং অবিশ্বাস্য কিছু ঘটেছে—তোমার বাবার হার্ট রেট স্বাভাবিক হচ্ছে।”
“মানে?” মা কাঁপা গলায় বললেন।
“ন্যানোবটরা কাজ শুরু করেছে। আমরা তাদের মাঝে এক নতুন আচরণ লক্ষ্য করেছি। তারা যেন আরও বেশি সুনির্দিষ্ট, আরও বেশি মানবিক হয়ে উঠছে।”
“তারা বাঁচাতে পারবে?”
“আমরা এখনও জানি না। তবে এটা বলতে পারি—এই পৃথিবীতে নতুন কিছু জন্ম নিচ্ছে। এক নতুন সংযোগ—মানুষ আর মেশিনের মাঝে।”
রিদুয়ান চুপচাপ বাবার হাতে হাত রাখল। শরীরের তাপ ধীরে ধীরে ফিরছে।
তার মনে হলো—সে কোনো হাসপাতালে নেই, সে এখন এক মহাজগতের ভেতর, যেখানে সে আর একা নয়।
আরও পড়ুন ন্যানোবট-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ম পর্ব
১১শ পর্ব
১২শ পর্ব
১৩শ পর্ব
১৪শ পর্ব
১৫শ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
ন্যানোবট // ১ম পর্ব // সায়েন্স ফিকশন