অভিমান ।। শেষ পর্ব ।। ছোটোগল্প ।। আলতাব হোসেন
অভিমান ।। শেষ পর্ব
আলতাব হোসেন
২.
মার মুখটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে দিনকে দিন। আগের মতো আর কথা বলেন না। বাড়ি গেলে সকালে রুটি বানিয়ে রেখে দেন, কিন্তু ডাকেন না। টেবিলে বসে থাকেন, মুখ গম্ভীর করে। আমি বুঝি, কিছু একটা পুড়ে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে।
একদিন সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় বসে ছিলাম, পায়ের কাছে বিছানো শীতলপাটি। মা এসে চুপ করে বসলেন পাশে। তারপর হঠাৎ বললেন—
“তোর আব্বা থাকলে বুঝত, মা কেমন করে ভিতরে ভিতরে একা হয়ে যায়।”
আমি কোনো উত্তর দিই না। চুপ করে বসে থাকি।
মা আবার বললেন,
“তুই ছোটো ছিলি তখন। তোর আব্বার মৃত্যুর পর কত নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছি। তোর স্কুলের ব্যাগ গোছানো থেকে শুরু করে সব কিছুতেই তো আগলে রাখার চেষ্টা করেছি।”
আমি আস্তে করে মা’র হাত ধরলাম। মা হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন।
“কিন্তু এখন তো তোর এক নতুন জগত হয়েছে। তাতে আমার কোনো স্থান নেই।”
এই কথাগুলো যেন বুকের মধ্যে ধাক্কা মারতে থাকে। আমি কিছু বলতে গেলাম, মা উঠে চলে যান।
পরদিন সকালে তাহিরা এসে চা দিলো হাতে। বলল,
“মা রুমে বসে চুপ করে আছেন। সকালে রুটি বানিয়েও খায়নি। তুমি একটু কথা বলো না মায়ের সাথে?”
আমি ঘরে গিয়ে দেখি মা জানালার পাশে বসে, বাইরে তাকিয়ে আছেন। পাশে রাখা খুন্তি, গামছা। আয়নার সামনে এখন আর চুলে তেল দেন না মা। যেন তার নিজেকে সাজানোর, গোছানোর কোনো ইচ্ছেই আর নেই।
আমি বললাম,
“মা, তোমার কিছু মনে হলে আমাকে বলো। কিছু ভুল করলে আমি ঠিক করব। তাহিরাও তো…”
মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তাহিরা খারাপ না। ও শুধু ভালোবাসে তোকে। কিন্তু একটা মেয়ে যখন নিজের স্বামীকে পুরোপুরি নিজের করে নিতে চায়, তখন সে অজান্তেই শাশুড়িকে সরিয়ে দেয়। ও কি কখনো এসে বলেছে— ‘মা, চলো একসাথে রান্না করি’? না-কি একদিন বলেছে, ‘আপনি বসুন, আমি মাথায় তেল দিয়ে দেই’?”
আমি থেমে যাই। সত্যিই, তাহিরা খুব ভালো, কিন্তু মা যা খুঁজছেন, তা ও দিতে পারছে না।
এরপর কিছুদিন ঘরটা অস্বস্তিতে ভরে যায়। কথা হয় কম, দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, নীরবতা জমাট বাঁধে চারপাশে।
প্রথম বারের মতো মা ঢাকায় এসেছেন আমার বাসায়।
একদিন রাতে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। কুয়াশার মতো নীরবতা ঘিরে রেখেছে চারদিক। হঠাৎ মা বললেন—
“জানিস, আমি তো তোর বউয়ের মতো পড়াশোনা করিনি। হাটে-বাজারে হাঁটতে হাঁটতে সংসার শিখেছি। ওর চোখে আমায় ‘পুরোনো’ লাগে, অচল লাগে। কিন্তু তুই কি ভুলে গেছিস, তোর নতুন জীবনের ভিতটা আমি তৈরি করে দিয়েছি?”
আমি বললাম,
“মা, আমি জানি সব। তোমার কষ্টটা আমাকে বলো। আমি কী করলে তুমি শান্তি পাবে?”
মা ধীরে বললেন,
“আমি কিছু চাই না। শুধু একটা কথাই তোর বউকে বল— আমাকে যেন মায়ের মতো না হোক, অন্তত মানুষ হিসেবে একটু শ্রদ্ধার চোখে দেখে। আমি এই ঘরে বেঁচে আছি, যেন এক খোলা জানালার পর্দা— বাতাস এলেই সরে যাই, কেউ টানেও না।”
পনেরো দিন পরে আমরা বাড়ি ফিরি। মা অনেকটাই চুপ।
তাহিরা এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
“মা, আপনি গেলে আমি একদম একা হয়ে যাই। আপনাকে কিছু বলতে পারি না, কিন্তু সারাদিন আপনার অভাব টের পাই।”
মা কিছু না বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
সেই রাতেই আমি তাহিরার সঙ্গে কথা বলি। সব খুলে বলি। মা কীভাবে কষ্ট পাচ্ছেন, কেন নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন।
তাহিরা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ভুল আমারই। আমি ভেবেছিলাম ভালোবাসা মানেই স্বামীকে ধরে রাখা। কিন্তু মা তো কখনো কিছু চাননি, শুধু আমাদের মাঝে একটু জায়গা খুঁজছিলেন। আমি সেটা দিইনি।”
“কখনো কখনো মানুষ ভালোবাসার চেয়ে সম্মানটুকুর অভাবেই ভেঙে পড়ে। ভালোবাসা মুখে বলা যায়, কিন্তু সম্মান চোখে চোখে প্রকাশ পায়।”
তারপরের দিন সকাল থেকে তাহিরা মায়ের পাশে পাশে থাকে। রান্নাঘরে গিয়ে বলল—
“মা, আজ আপনি রুটি বানান, আমি ডিমভাজি করি।”
মা প্রথমে অবাক হন, তারপর হেসে ফেলেন। সেই হাসি যেন বহুদিন পর খুঁজে পাওয়া এক পুরোনো গানের মতো।
দিনে দিনে সম্পর্কের জট খোলে। মায়ের মুখে হাসি ফেরে, তাহিরার চোখে মায়া বাড়ে। আমি সেই দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে বুঝি—
ভালোবাসা কখনো একতরফা হয় না, শ্রদ্ধা ছাড়া ভালোবাসা সম্পূর্ণ হয় না। আর ভালোবাসার ভিতরে যদি ত্যাগ না থাকে, তাহলে সেটাও একটা বন্ধ খাঁচা হয়ে যায়।
৩.
বাড়িতে শান্তির আবহ ফিরে এসেছে যেন। মা আর তাহিরার মাঝে কথাবারতা হয়, রান্নাঘর থেকে কখনো কখনো খিলখিল করে হাসির শব্দও আসে। আমি দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখি— বুকের মধ্যে এক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।
পরেরদিন সকালে মা বাথরুম থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। মুখ ফ্যাকাশে। আমি দৌড়ে গিয়ে বললাম,
“মা, কী হয়েছে?”
মা আস্তে আস্তে বললেন,
“বুকে ব্যথা করছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।”
আমরা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
ডাক্তার বললেন,
“লং টাইম কার্ডিয়াক ইসকেমিয়া। হার্টে ব্লক থাকতে পারে। বয়স হয়েছে, কিছু পরীক্ষা করতে হবে।”
“মানুষের শরীরের রোগ হয়তো চিকিৎসায় সারে, কিন্তু উপেক্ষার ব্যথা যে একদম নিরাময়হীন— তা টের পাওয়া যায় দেরিতে।”
সেই রাতটা আমি আর তাহিরা হাসপাতালে কাটালাম।
মা ঘুমিয়ে পড়েছেন, তবু আমি পাশে বসে আছি। মনে হলো, মা যদি আজ চলে যান, আমি কোনো দিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।
তাহিরা আমার হাত ধরে বলল—
“তুমি জানো, এই কয়েক মাসে আমি সবচেয়ে বেশি শিখেছি মা’র কাছ থেকে। আমি ভেবেছিলাম ওনার অভিমানটা অহংকার। এখন বুঝি, সেটা আসলে গভীর নিঃসঙ্গতা। মা তো সারাজীবন আমাদের জন্যই বেঁচেছেন।”
আমি বলি,
“হ্যাঁ, কিন্তু সেই কথা কখনো মুখে বলা হয়নি। সেই না-বলা কথাগুলোই বুকের ভিতর জমে জমে পাথর হয়ে গেছে।”
পরদিন সকালে মা জেগে ওঠেন। চোখে-মুখে ক্লান্তি, কিন্তু হাসেন আমাদের দেখে।
আমি তাঁর হাত ধরে বলি—
“মা, তুমি আজকে যা কিছু চাও, আমি সব দেবো। এমনকি আমার অহংকারটাও।”
মা হেসে বললেন—
“তুই আর তাহিরা একসাথে সুখে থাক, সেটাই আমি চাই। আমাকে আলাদা করে কিছু দিতে হবে না। শুধু মাঝে মাঝে পাশে বসে একটু গল্প করিস। আমি তো আর বেশি দিন থাকব না…”
আমি বলি,
“মা, এমন কথা বলো না। তুমি ছাড়া এই বাড়ি যেন প্রাণহীন।”
মা চোখ বুজে ফেলেন। চোখে পানি জমে ওঠে, আবার হারিয়ে যায় ভিতরে।
দুই মাস পর,
মা এখন অনেকটাই ভালো। ওষুধ খেতে হয় নিয়ম করে, হাঁটেন ধীরে। মুখে সেই পুরোনো আলোর ছাপ। তাহিরা এখন মাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কখনো তেল দিয়ে চুলে বিলি কাটে, কখনো নতুন শাড়ি এনে বলে—
“মা, এটা আপনার জন্য। এই রংটা আপনাকে খুব মানায়।”
আমি বসে দেখি, মা আয়নায় নিজের চেহারা দেখেন— অনেক বছর পর যেন নিজেকে মানুষ মনে হয় তাঁর।
হয়তো এই ভালোবাসাটাই চেয়েছিলেন তিনি প্রথম দিন থেকে—একটুখানি সম্মান, একটুখানি খেয়াল, আর কিছুটা নিজের জায়গা।
বিকেলে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি আমরা তিনজন। মা পায়ের ওপর পা তুলে বসে বললেন—
“তুই জানিস, আমি এখন আর কারও প্রতি অভিমান রাখি না। অভিমান জমে গেলে বুক ভারী হয়। এখন আমি হালকা, মেঘের মতো।”
আমি হেসে বলি,
“কিন্তু মা, তোমার বুকের ভেতর তো একটা পাথর ছিল।”
মা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলেন—
“ছিল, এখন সেটা গলে গেছে; তোর আর তাহিরার ভালোবাসায়। এখন বুকটা ফাঁকা, শান্ত।”
হাওয়া এসে পর্দা নেড়ে দেয়।
আমি জানি—সব পাথর গলে না। কিন্তু যেটা ভালোবাসায় গলে, সেটাই মানুষকে নতুন করে বাঁচায়।
“সব সম্পর্কেই একসময় পাথর জমে, কিন্তু ভালোবাসা যদি যথাসময়ে আসে, তবে সেই পাথরও গলে জল হয়ে যায়।”
আরও পড়ুন ‘অভিমান’ গল্পের-
১ম পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
অভিমান ।। শেষ পর্ব