সোনালী সকাল (৩য় পর্ব)
সোনালী সকাল (৩য় পর্ব)
মোহাম্মাদ শাহ্ আলম
সেই থেকে আজ এক মাস হলো সকাল রবি সেজে এ বাড়িতে ফাইফরমাস পালন করে চলেছে। তবে বেশি কিছু করতে হয় না তাকে। এই থালা বাসন মাজা, বাগান সাফ করা, এই আর কি। তবে ছেলেটা অলস নয়। যে কাজেই পাঠানো যাক, তা সে ঠিক ঠিক করে দেয়। বোবা হলেও জ্ঞান তার কম নেই এ ব্যাপারটা সবাই বুঝতে পেরেছেন।
আজ সকালে উঠেই রবি বাগানে গেল। কিন্তু প্রতিদিনের মত আজ আর সোনাই সেখানে উপস্থিত নেই। রবির মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ সোনাই যেন তার প্রতিদিনের জীবনের রবি। তার মুখটা না দেখলে অথবা একটু হাসি হাসি মুখের কথা না শুনলে রবির দিনটাই বৃথা হয়ে যায়।
অবশেষে সে জানতে পারল, সোনাইয়ের ভীষণ জ্বর। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না।
রবি সোনাইয়ের ঘর ঝাড় দিতে এসে তার অবস্থা অনুমান করে কিছুক্ষণের মধ্যে ঔষধ নিয়ে এল।
সোনাই সে সব লক্ষ্য করে বলল,
_আমার জ্বর হয়েছে তুমি সেটা জানলে কি করে? আবার ঔষধগুলো তো ঠিকঠাকই এনেছ দেখছি।
রবি খানিকটা আ-উ করে বোকা হাসিতে দাঁড়িয়ে রইল।
সোনাই পাশ ফিরে শুতে শুতে বলল,
_ঠিক আছে যাও।
কিন্তু রবি কৌটা থেকে একটা বিস্কুট এনে ইশারায় সোনাইকে খেতে বলল।
_এখন খাব না। আচ্ছা ঠিক আছে পরে খেয়ে নেব যাও।
কিন্তু রবি নাছোর বান্দার মত বিস্কুটটা তার মুখের সামনেই ধরে রেখেছে।
সোনাই মুখে কিছুটা বিরক্তি ফুটিয়ে বলল,
_আহ্ রবি! তুমি বড্ড জ্বালাতন কর। দাও দাও, বিস্কুটটা দাও।
সোনাই তারপর ঔষধটা সেবন করে বল,
_এখন যাও। খুশি তো?
আরও পড়ুন দীপ্তিদের দেবতা
রবি খুব খুশি হয়েছে বোঝাতে একটু হাসল। সোনাই ওর টোল খাওয়া হাসি মুখটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিরুপণ করে নিজেও ফিক করে হেসে ফেলল। সে মনে মনে ঐটাও বলল,
_রবি তুমি যদি বোবা না হতে, আর আগে যদি দেখা হত, তাহলে নিশ্চয়ই তুমিই হতে আমার বর।
এমন সময় বড় মামার কলেজে পড়া ছোট মেয়ে রাবেয়া এসে বলল,
_এই সোনা আপু। এই অঙ্কটা করে দে নারে।
_আমার এখন মাথা ব্যাথা করছে। রেখে যা, করে রাখব।
_বিকেল ৩টার সময় স্যার পড়াতে আসবেন। অঙ্কটা না হলে কিন্তু খুব বকুনি খেতে হবে।
_ঠিক আছে। এখন তুই যা-না।
এরপর দুপুর বারোটার সময় সোনাই ঘুমিয়ে পড়ল। বেচারি এমন ঘুমিয়ে পড়ল যে, তার কানের কাছে সাত শত ঢাকি সর্বশক্তি দিয়ে ঢাক বাজিয়েও তাকে জাগাতে পারবে বলে মনে হল না। অথচ বড়মামা, মেঝমামা এবং ছোটমামা ফিস ফিস করে বলল,
_বাড়িতে কেউ জোরে কথা বলতে পারবে না। যদি কেও হঠাৎ জোরে কথা বলেই ফেলে তাহলে তার জরিমানা হবে…. জরিমানা হবে….
কিন্তু কি যে জরিমানা হবে সেটা মেঝভাই আর বড়ভাই কিছুতেই ঠিক করতে পারছেন না।
কিন্তু ছোটভাই হচ্ছে এ যুগের স্মার্ট ছেলে, বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে। সেই ছেলেই মেঝ আর বড়ভাইকে মুশকিল আসান করে দিল।
_ভাবছ কেন বড় ভাই! আমি আছি না?
আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা
বড়ভাই রাগত কণ্ঠে বললেন,
_আহা কি ভেবেছিস, সেটা বলবি তো? হতচ্ছারা ডেপোঁ ছেলে। এই ঘোর বিপদেও রসিকতা না করলেই নয়?
_আহ্ বড়ভাই! তোমার আসলে ধৈর্য্যবস্তটাই নেই। অথচ জ্ঞানীরা বলেন ধৈর্য্যে মেওয়া ফলে।
বড়ভাই এবার অত্যাধিক চটে গিয়ে ছোটটার কান চেপে ধরে বললেন,
_এই হতভাগা। উপদেশ দিচ্ছিস বুঝি? দাঁড়া তবে…
_খুব লাগছে কিন্তু বড় ভাই।
কানটা ছেড়ে দিয়ে বড় ভাই বললেন,
_তা হলে বল! বল বলছি…
_হ্যাঁ বলছি, শোন। যে জোরে কথা বলবে তাকে তিন দিন কথা বন্ধ করে থাকতে হবে। ভুলে যদি কথা হঠাৎ বলে ফেলে আরও তিন দিনের শাস্তি বেশি বরাদ্দ হবে।
বড়ভাই হো হো করে হেসে বললেন,
_আহ্ ছোট। ভারি বুদ্ধি রাখিস তো। বাঁচালি! ঠিক আছে এবার অন্দর মহলে জানিয়ে আয় কথাটা।
অতপর ঘটা করে বাড়ির সবাইকে জানানো হলো নির্দেশটা।
আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি
এদিকে বেলা পৌনে দুটোর সময় সোনায়ের ঘুম ভাঙল। আর সঙ্গে সঙ্গে বড় মামার মেয়ে রাবেয়া এসে বলল,
_কিরে আপু অঙ্কটা হয়েছে তো?
সোনাই ড্যাব ড্যাব করে শুধু রাবেয়ার দিকে চেয়ে রইল।
_কি করিসনি তো? খুব ভালো করেছিস। দে খাতাটা দে আমায়।
রান্নাঘর থেকে রাবেয়ার মা মর্জিনা বেগম ডাকলেন,
_রাবেয়া এখানে এসো।
রাবেয়া এতক্ষণও খুলে দেখেনি। এবার কি মনে হওয়ায় খুব জোরে জোরে পাতা উল্টিয়ে দেখল অঙ্কটা দিব্যি কষা হয়ে গেছে।
রাবেয়া এতক্ষণে থম থমে মুখটা হঠাৎ হাসির উজ্জ্বল আভায় পরপূর্ণ হয়ে উঠল। সোনা আপামনিকে ধন্যবাদ জানানোর আগে মায়ের কথাটা শুনতে গেল রাবেয়া।
_কি মা! ডাকলে বুঝি?
_হ্যাঁ! যা-তো মা ফটিকের দোকান থেকে কাঁচা লঙ্কা নিয়ে আয়।
_আমি এখন পারব না মা। রবিকে বল না, এনে দেবে।
_গেটের সামনেই ফটিকের দোকান। বেচারা রবি সকাল থেকে বহু ফাইফরমাস পালন করছে। বলি ওরও তো শরীর নাকি?
মেঝ বউ অশালতা মুখটিপে হেঁসে বলল,
_সে তুমি যা-ই বল না বড় আপা। রবি এসে এ বাড়ির ছোট থেকে বড় সবারই বাবুগিরিটা বেশ বেড়েছে কিন্তু।
মর্জিনা বেগম কিঞ্চিত রাগত কণ্ঠে বললেন,
_-না, না। এটা মোটেই ভালো নয়। পরের ছেলে বলেই সবাই ওকে দু-দণ্ড স্বস্তি দেবে না?
_ঠিক আছে এনে দিচ্ছি।
এদিকে রবি সোনাইয়ের ঘরে ঝাড় দিতে গেলে বালিশ থেকে মাথা তুলে সে বলল,
_রবি শোন তো। এ বেলা জ্বর আর নেই। মাথা ব্যাথাটাও কমেছে বটে। কিন্তু গায়ে এক রত্তি বল নেই। ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলবে। দূর ছাই। তুমিতো আবার বলতেও পারবে না। তার থেকে লিখে দিচ্ছি, নিয়ে যাও ডাক্তারকে দিও।
আরও পড়ুন গল্প নীরুর মা
ঠিক এমন সময় রাবেয়া সেখানে এসে বলল,
_অঙ্কটা করেছিস তাহলে।
_আরে আমি আবার অঙ্কটা কখন করলাম? দাঁড়া! দাঁড়া! তাহলে অঙ্কটা করল কে? এ ঘরে তো শুধুই রবি এসেছে। আর অন্য কেউ এলেও এ বাড়িতে তোর অঙ্ক কষে দেবে এ রকম আর কে আছে? ব্যাপারটা বেজায় গোণ্ডগোলে মনে হচ্ছে তো।
ঠিক এমন সময় মেঝ বউ সেখানে উপস্থিত হয়ে বলল,
_রবি এই স্যান্ডেল জোড়া সেরে নিয়ে এসো না ভাই।
রবি আঁ-উঁ করে যেটা বোঝালো তার অর্থ হলো এই যে, সে স্যান্ডেল অবশ্যই সেরে আনবে। তবে তার আগে সোনাইয়ের জন্য তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে একটা ঔষধের ফইল আর সঙ্গে কিছু ফল ফলারি নিয়ে হাজির হল রবি।
_এত ফল কেন এনেছ রবি? ও আমি খেতে পারব না।
কিন্তু নাছো বান্দা রবি ফলের খোসা ছাড়িয়ে একটা পিরিচে নিয়ে এসে এমন ভাবে আব্দারের ভঙ্গিতে সেগুলো সোনাইকে খেতে বলল যে সোনাই না হেসে পারল না।
রবি সে হাসি গভীর আগ্রহে দেখল। সোনাইও রবির বিজয় উদ্দিপ্ত উজ্জ্বল মুখটা দেখল। খুব ভালো লাগলো তার। এমন মুখকে যে ভালোবাসা যায়, আপনার করে ভাবা যায়, এ ব্যাপারে মন থেকে সে যথেষ্ট স্বীকৃতি পেল
তবে দুঃখও হলো। কারণ এত সুন্দর একটা তরুণকে কেন যে বিধাতা বোবা করে পাঠালেন এই ভেবে। নইলে কি জানি সোনাই-ই তাকে প্রেমনিবেদন করে বসত কিনা কে জানে?
মুখ টিপে আর একটু হাসল সোনাই। ধ্যেৎ! এসব কি ভাবছে সে! তার তো বিয়ে হয়ে গেছে। তার বান্ধবী বলছে, তার বর নাকি স্বপ্নে দেখা রাজপুত্তুরের মত। লজ্জায় সোনাই এর গণ্ড দুটো লাল হয়ে উঠল।
আরও পড়ুন সোনালী সকাল গল্পের-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সোনালী সকাল (৩য় পর্ব)



