দূর জংলার গান
দূর জংলার গান : ভাব ও রূপকল্পের অন্বেষণ
আতাউল হক মাসুম
হৃদয়ের গভীর অনুভূতি মস্তিষ্ক থেকে উৎসারিত হয়ে শব্দ-ছন্দ-অলঙ্কার ও উপমার মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যম হলো কবিতা। একটি সুদৃশ্য অট্টালিকা নির্মাণের পর দর্শক তার মহিমাকীর্তন বা সমালোচনাই করতে পারেন শুধু; তা নির্মাণে শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা কয়জনই বা স্মরণ করেন। একটি সার্থক কবিতা রচনার পেছনেও একজন কবির নিরলস শ্রমের কথা অস্বীকার করার জো নেই। তবে সব কবিই পরিশ্রমী নয়, কেউ কেউ পরিশ্রমী। বাংলা সাহিত্যে শূন্য দশকে আবির্ভূত কবি আদ্যনাথ ঘোষও তেমনি পরিশ্রমী কবিদের একজন, যিনি নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে একের পর এক লিখে চলেছেন রূপকাশ্রয়ী নান্দনিক সব কবিতা।
প্রায়োগিক দিক থেকে উপমাকে যদি দুইভাগে ভাগ করা যায় তাহলে আমরা পাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপমা এবং অতীন্দ্রিয় উপমা। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন ইন্দ্রিয়গাহ্য উপমা। আদ্যনাথ ঘোষের কবিতা পাঠ করলে আমরা দেখতে পাই তাঁর কবিতায় অতীন্দ্রিয় বা বিমূর্ত উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। তারপরও তাঁর কবিতায় রূপকের ছলে সংবেদ্য হয় মা-মাটি-জল ও জীবনের মতো প্রাকৃতিক সব বিষয়-আশয়। আদ্যনাথ ঘোষের কাব্য ‘দূর জংলার গান’ থেকে প্রণিধানযোগ্য উপমাগুলো উদ্ধার করলে আমরা পাই- ‘নিষিক্ত আগুন’, ‘শব্দ ঘ্রাণ’, ‘দুঃখের দেয়ালে বার্নিশ’, ‘কবোষ্ণ জলের স্নিগ্ধতা’, ‘থই থই আঁধারের ফণা’, ‘রোদের চাতাল’, ‘দরজার ঠোঁট’ প্রভৃতি।
শক্তির যেমন বিনাশ নাই, তা এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হয় মাত্র- তেমনি অনুভূতিরও বিনাশ নাই। তা কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিণত হয়। কবিতার ক্ষেত্রেও আমরা বলতে পারি অনুভূতির জায়গা ঠিক রেখে ব্যক্ত করার ধরনে একটু নতুনত্ব আনলেই তা পাঠকের মনে উপাদেয় শিল্প হিসেবে ধরা দেবে। আদ্যনাথ ঘোষও বলার ধরনে একটু হলেও নিজস্বতা আনতে পেরেছেন বলেই অন্যান্য কবিদের কবিতার তুলনায় তার কবিতায় পাঠক ভিন্ন স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। কবি তাঁর কবিতায় নাম নির্বাচনও করেন সুদক্ষ সচেতন যত্নতায়, কাব্যিক দ্যোতনায়। দূর জংলার গান কাব্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার শিরোনামের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই- আহত হেমন্ত, সব রং দূরে গেলে, তৃতীয় সূত্র, বসন্ত পড়ে থাকে, পোড়া আগুন, আপেল রোদ্দুর, ঘাসের ফুল, স্বপ্নভ্রণ, শৈতালী ঘুমের রাত, দরজার ঠোঁট, নদী ও জীবন ইত্যাদি।
রূপকের আশ্রয় নিয়ে কবিতা লিখে কবি আদ্যনাথ ঘোষ সবসময় জীবনের সুখ-দুঃখের গান গেয়ে যান-
“কতটা বিতৃষ্ণা হলে মাকড়শার জালের মতো
তুমি সংসার সাজাও আর আঁধারেও একদিন
ক্লান্ত সংসার নিয়ে জীবন নদীতে দাঁড় বেয়ে যাও।”
(নদী ও জীবন)
“সামাজিক হৃদপিন্ডের আয়োজনে বাড়িয়ে দেয় অভাব।
অথচ আমরা প্রাণান্ত সমীকরণ খুঁজে চলি বারংবার স্বপ্নভূক পাখির ডানায়।
ভেঙ্গে ফেলি সংখ্যার গুণনিয়ক।”
(জীবন ও পরিধি)
কালকে আমরা কোনো ক্রমেই এড়িয়ে যেতে পারি না। এ-কাব্যের কোনো কোনো কবিতায় অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে কালের পরিক্রমা-
“জটায় বসন্ত এসে ভর করে হেমন্তের কলিজায়।
তাই বেভুলো পথের কাঁটা পড়ে থাকে উপেক্ষার বুনোপথ ছেড়ে।”
(আহত হেমন্ত)
“মধ্যরাত মুছে যায় ফুলরাঙা স্রোতস্বিনী ফাঁদে।
তবুও আতন্ত সূর্য, ঝিনুকমালার চোখের পরণে
ক্ষুধার্ত পোশাক হয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়
ফন্দিফিকিরের রসমন্দিরে।”
(বসন্ত বাউরি)
কবি আদ্যনাথ ঘোষের কবিতায় স্বপ্নেরা ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে সহজাতভাবেই–
“এই ঘুমকাতর শহরে-
ভাঁজে ভাঁজে স্বপ্ন জমা থাকে ফসলের মাঠে
অথবা বাতাসের চোখের ভিতর।”
(হাওয়াঘরে কালোঘুম)
“ফ্যাকাসে স্বপ্ন এসে নিয়ে যায় ঘুমের আবেশ-
তবু বহু নদী বয়ে গিয়ে-
ফণা তোলে ঘরহীন প্রণয়ের রাতের শাখায়।”
(অনুযোগ)
এ-কাব্যের অন্তর্গত ‘আপেল রোদ্দুর’ নামের একটি কবিতা কবি ওমর আলীকে নিবেদন করে আদ্যনাথ ঘোষ বলেন-
“কীভাবে পুজিব বলো। সাধনার বিভাসিত মাঠ।
একদিন কাব্যের পঙক্তিরা এসে
কবিতা নারীর সুধাময় সুরেলা ছন্দের চিত্রপটে
মেতেছিলে অন্ধ স্নানে ফাগুনের কোলে
যতো আছে কাব্যকলা, রাঙানো দুপুর।”
(আপেল রোদ্দুর)
আদ্যনাথ ঘোষের কবিতার বিশেষ বিশেষত্ব হলো তিনি কবিতার প্রথম লাইন খুব যত্ন নিয়ে রচনা করেন। প্রথম লাইনেই গোটা কবিতার মর্মার্থ বলে দিতে চান। এরকম কয়েকটি সুদক্ষ কারুকাজ আমরা উদ্ধার করতে পারি: ‘উদ্বাস্তু মাটিও একদিন হয়ে পড়ে নিষিক্ত আগুন’, ‘জটায়ু বসন্ত এসে ভর করে হেমন্ত্রের কলিজায়’, ‘এভাবে আর কত মিলাবো জীবনের অভিধান’, ‘আশ্রিত দুঃখের ফেনা ফেটে পড়ে শিল্পিত হাওয়ায়’, ‘বেঁচেই তো আছি নিরাশার হিমঘরে’, ‘মুখস্ত পুরাণ খোঁজে লোভাতুর পূর্ণিমা চাঁদ’, ‘জ্যামিতিক কেন্দ্র খোঁজে পরিধির পরিমাপ’ ইত্যাদি।
বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত সমালোচক আব্দুল মান্নান সৈয়দ আধুনিক বাংলা কবিতার স্বরূপ সম্পর্কে এক আলাপে বলেছিলেন, “আধুনিক কবিতা হচ্ছে গদ্যকেই কবিতা করে তোলা।” প্রকৃতপক্ষে জীবনের ব্যবচ্ছেদ করতে গেলে আমাদের কবিতা ও গদ্যে তা আলাদাভাবে করার উপায় নেই, বরং কবিতা ও গদ্য যুগপৎভাবেই নির্মোহ জীবনের জয়গান গাওয়া যায়। গদ্যের ভিতর দিয়ে কবিতা অতি সহজে সঞ্চারিত হতে পারে বলেই কবিতা ও গদ্য পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হতে পারে।
‘বাপজান ও লাঙলের ফলা’ কবিতায় আদ্যনাথ ঘোষ বলেছেন, “আমার বাপজান প্রতিদিন লাঙলের ফলায় মাটি খোঁড়ে সোনার অলঙ্কারের পস্তানো নেশায়।”
একজন কৃষক মাটি খুঁড়ে বীজ বপন করে নির্দিষ্ট সময়ের শেষে ফসল ঘরে তোলার লক্ষ্যে; কবি যেটাকে অভিহিত করেছেন ‘সোনার অলঙ্কার’ হিসেবে। কৃষিপ্রধান এই দেশে কবিরা ফল-ফসল নিয়ে আমাদের স্বপ্ন দেখাবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
কবি সমর সেন যে রকম বলতে পেরেছিলেন, “আমাদের স্বপ্ন হোক ফসলের সুষম বণ্টন।”
যদিও আদ্যনাথ ঘোষের কবিতায় আমরা স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি হতাশার চিত্রও দেখতে পাই। ‘প্রাগুপ্ত’ কবিতার শেষ চরণে দৃষ্টিপাত করলে আমরা পাই, ‘আমার বাপজান, এ দ্বিচারিণী সংসারের চাবি খুঁজে বেড়ায় অনন্তকাল।’
কবিদের কাজই হচ্ছে মানব জাতির ঘুমন্ত বিবেককে স্বপ্ন দেখিয়ে জাগ্রত করে তোলা। আদ্যনাথ ঘোষও তার কবিতায় কখনো অক্ষরবৃত্তে, কখনো গদ্যছন্দে, আবার কখনো মুক্ত ছন্দে সে কাজটিই করে যাচ্ছেন নিরন্তর নিরলস ও পরম নিষ্ঠার সাথে।
আরও পড়ুন আদ্যনাথ ঘোষ-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
দূর জংলার গান