হোড় জমিদার বাড়ি
হোড় জমিদার বাড়ি
পাবনার সুজানগর উপজেলার হাটখালি ইউনিয়নের কামালপুর গ্রাম, সুপ্রাচীনকালের স্মৃতিবাহী, ঐতিহ্যের বাতিঘর। এ গ্রামের মাটি গভীরভাবে ধারণ করে আছে অতীতের গৌরব, স্মৃতি, আর বংশপরম্পরায় চলে আসা প্রতাপের গল্প। এ গ্রামের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো হোড় জমিদার বাড়ি—একসময়কার ক্ষমতার প্রতীক, প্রভাবশালী হোড়ে বংশের কীর্তির সাক্ষী। সময়ের আবর্তে হয়তো ধূসরিত হয়েছে সেই দিনগুলো, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে তাদের স্মৃতি।
হোড়ে বংশের দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, শ্রীনাথ হোড় ও অক্ষয়কুমার হোড়, ছিলেন এ জমিদার বাড়ির মূল কর্ণধার। তারা শুধুমাত্র ধনসম্পত্তির অধিকারীই ছিলেন না, ছিলেন এ জনপদের শাসক। দুলাই জমিদার আজিম চৌধুরীর অধীনস্থ থাকলেও, হোড়ে বংশের জমিদাররা ছিল তাদের নিজস্ব অঞ্চলে একচ্ছত্র ক্ষমতাধর। বিল গণ্ডহস্তী, কামালপুর, হাটখালি, আর নারায়ণপুরে ছড়িয়ে থাকা তাদের জমিদারি। পাইক পেয়াদার ভিড়ে ভরা ছিল তাদের প্রাসাদ, নায়েবরা নিয়ম করে জমির খাজনা আদায় করত।
কামালপুরের মাটি ছুঁয়ে দাঁড়ানো হোড় জমিদার বাড়ি ছিল প্রকৃত অর্থে এক প্রাসাদ। তার বিশাল আকার, দোতলা কাঠামো, আর চতুর্দিকে বিস্তৃত ১০/১২ বিঘার জমি, যেন কোনো সুদৃঢ় দুর্গ। দোতলা বাড়ি, চারপাশে বিস্তৃত পুকুর, মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি যেন বাতাসে মিশে গিয়ে ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতা তৈরি করত। মন্দিরে নিয়মিত পূজা–অর্চনা, উৎসবের আয়োজন, গ্রামের মানুষের মনে সম্মান আর ভয়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণ সৃষ্টি করত।
হোড়ে বংশের মধ্যে বিশু হোড়, যার নাম আজও শোনা যায় প্রবীণদের মুখে মুখে, ছিল এক প্রতাপশালী ব্যক্তি। বিশুর দুই পুত্র—হরেন ও অধীর, পিতার গর্বিত উত্তরাধিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। হরেন কলকাতা থেকে ওকালতি পাশ করে ফিরে আসেন, আর অধীর পাশ করেন ডাক্তারি। তারা শুধু পারিবারিক সম্মানই বাড়ায়নি, বরং শিক্ষার আলোকে আরও বিস্তৃত করেছিল হোড়ে বংশের প্রভাব। অক্ষয়কুমার হোড়, ছিলেন হাটখালি ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট, অনেক জমিজমার মালিক।
আরও পড়ুন জমিদার আজিম চৌধুরীর বাড়ি
এই জমিদার পরিবারের সদস্যরা পদ্মার তীরে নির্মাণ করেছিল হাওয়া ভবন নামে এক মনোরম হাওয়াখানা। সময়ের স্রোতে হাওয়াখানার জমি দান করা হয় নাজিরগঞ্জ মন্দিরের নামে, কিন্তু তার স্মৃতি আজও জেগে আছে গ্রামের মানুষের মনে।
হোড়ে জমিদারদের ক্ষমতা শুধু অর্থ বা শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; তাদের অবদান ছিল ধর্মীয় ক্ষেত্রেও। হোড় জমিদার বাড়ির পুকুর পাড়ে ছিল এক মঠ, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিবেকানন্দ আশ্রম। কলকাতা থেকে আগত ধর্মপ্রচারকরা এখানে এসে হিন্দুধর্মের বাণী প্রচার করত। একবার স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য প্রমোদ আনন্দ এখানে এসে বক্তব্য দেন আশ্রমকে ঘিরে বসত মাসব্যাপী মেলা, যেখানে হরেক রকম পণ্যের দোকানপাট, যাত্রাপালা, আর সংস্কৃতির প্রাণবন্ত ধারা মানুষের মনে আনন্দের সঞ্চার করত।
হোড়ে জমিদার বাড়ির ইতিহাস শুধু ধর্ম বা শিক্ষায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা এলাকার মানুষের উন্নতির জন্যও বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। তাদের দানে প্রতিষ্ঠিত হয় কামালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তাদের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার আলোকে ছড়িয়ে দেয়া, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে।
তবে, সময়ের নিষ্ঠুর ঘূর্ণিপাকে দেশভাগের পর, হোড়েরা ছাড়তে বাধ্য হয় তাদের প্রিয় ভিটে। চলে যায় তারা সুদূর ভারতে, ফেলে রেখে যায় তাদের জমিজমা আর অম্লান স্মৃতি। হোড়ে জমিদার বাড়ির প্রাসাদ, মঠ, মন্দির, আর হাওয়া ভবন এখন ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে কিন্তু তার গায়ে লেগে আছে সময়ের ক্ষতচিহ্ন, সেই প্রাচুর্য আর ক্ষমতার স্মৃতি। হোড় বংশের গল্পগুলো আজ শুধু বাতাসে ভেসে বেড়ায়, কামালপুরের প্রতিটি ধূলিকণায় লুকিয়ে আছে তাদের হারানো দিনগুলোর গল্প।
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে