হাতের-চুড়ি
গল্প,  শফিক নহোর (গল্প),  সাহিত্য

হাতের চুড়ি

হাতের চুড়ি
আমি তখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। লাবণী আমাকে প্রথম পরিচয়ে বলেছিল, হাইস্কুলে থাকতে নিরাল নামের ছেলের সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক ছিল! আমি জানতে চাইলাম,
──কেমন সম্পর্ক?
ভেবেছিলাম, মামাতো অথবা খালাতো ভাই এমন কিছু একটা হবে হয়তো। কিন্তু না সম্পর্ক ছিল প্রেমের।
এ কথা শুনে,
আমার শরীরের লোম শিউরে উঠল।
কেমন সহজসরল ভাবে লাবণী বলল,
──সে আমার কাছে অন্য কিছু চাইত।
অন্য কোন মেয়ে হলে হয়তো বলতে পারত না। হঠাৎ ওর চোখে অশ্রু দেখে অবাক হলাম। মেয়েদের দু’চোখের জল দু’রকম ।
──কি রে কান্না করছিস কেন?
──না তেমন কিছু না। মেয়েদের কষ্ট তুই বুঝবি না।
আমি সত্যিই মানুষের কষ্ট একটু কম বুঝি। কিন্তু যে ভাবে কান্না করেছিল, মনে হল কোন গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। জানতে চেয়েও হল না জানা। আমার ভেতরে এক ধরণের জড়তা কাজ করছিল।
সেদিন কলেজ শেষ করে বাড়ি যাবার পথে লাবণী মায়া ভরা কণ্ঠে বলল,
── আমরা কি বন্ধু হতে পারি?
── কলেজে সবাই তো বন্ধু, আবার কিসের বন্ধু?
লাবণী সেদিন আমাকে গবেট বলেছিল, কিন্তু সে বছর ফাইনাল পরীক্ষায় আমি প্রথম হয়েছিলাম। তবুও আমাকে মেধাহীন মনে করত, তার বিশেষ কোন কারণ আমার নজরে পড়েনি।
কিছুদিন যাবার পর আমার রসায়ন বইয়ের ভেতর চিঠি পেলাম।
সেদিন রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি।
তারপর ভেবেছি;
একটা মেয়ে আমাকে এতো ভালবাসে।
অথচ, আমি তার সঙ্গে দিনের পর দিন কেমন অবহেলা করেছি।
চিঠির ভাষা এমন হয়, এতো আবেগ ছিল চিঠিতে সেদিন রাতে আমি চৌদ্দ বার পড়েছিলাম।
আরও পড়ুন গল্প জীবনের উপহাস
প্রিয় রানা,
তোমাকে বলব কিন্তু বলতে পারি না। অপারগতার হাত আমার গলা চেপে ধরে। জানি তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে না। তবুও বলছি, আমি তোমাকে চাই, মন থেকে চাই। তোমাকে একটা দিন না দেখলে আমি অস্থির হয়ে যাই। জানি না এ চিঠি তুমি পাবে কি না। অথবা আমার চিঠির উত্তর তুমি দিবে কি না। তবে জেনো রেখ আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। প্লিজ! আমাকে অবহেলা করে দূরে রেখো না। তোমার অবহেলা আমি সহ্য করতে পারবো না। আগামীকাল থেকে কলেজ ছুটি। তোমার চাঁদমুখ অনেকদিন না দেখে থাকতে হবে। তুমি তো আমার হৃদয়ে থাকো। সেখান থেকে রোজ দেখে নিবো। নিজের প্রতি যত্ন নিও। ভালো থেকো সবসময়।
ইতি,
লাবণী
বাড়িতে আমাকে নিয়ে সবাই স্বপ্ন দেখে, আমি বড় অফিসার হবো, মাস শেষে বাবা মায়ের হাতে টাকা তুলে দিবো।
আমাদের চিন্তা ভাবনাগুলো বিয়ে আর ভালো একটা চাকরি হলে আর কোন চাওয়া-পাওয়া থাকে না বাড়ির মানুষের। দেশ, সমাজ, সংসার ভাবনার ভেতর মাথা ডুবে গেলে ভেসে ওঠা হয় কি? হয় না।
পরিবার ও সমাজ আমাদের শিখিয়ে দেয়, ভালো একটা চাকরি করতে পারলেই ভালো ও ভদ্র মানুষ হিসাবে সমাজ তাকে সেলাম দেবে। আমার ভাবনার সঙ্গে বাড়ির কারও ভাবনা কখনো মেলেনি।
কলেজের ছুটি শেষ। আগামীকাল থেকে কলেজে ক্লাস শুরু হবে। বুকের ভেতর কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল, লাবণীর কথা মনে পড়ে। মেয়েটি কত সহজ সরল, প্রাণবন্ত।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বক্কার এসে আমাকে ডাকতে শুরু করল।
আমার জন্য না কী আজ কলেজে যাওয়া দেরি হয়ে যাচ্ছে। একটা লাল রঙের সাইকেল ছিল আমার। বন্ধুদের ভেতর বক্কার ছাড়া অন্য কেউ চালাতে পারতো না।
সাইকেল ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা কলেজে যাওয়ার জন্য।
তখন বেশির ভাগ মানুষ পায়ে হেঁটে যেত। কিছুক্ষণ আমি সাইকেল চালাচ্ছি; চারদিকে কেমন সুনসান নীরবতা। কেউ কেউ মাঠে গরু নিয়ে যাচ্ছে। শীতের মাস। খেজুর গাছে দুষ্টু ছেলে-পেলে পাখি ধরছে গাছের আঠা দিয়ে।
আরও পড়ুন গল্প অশরীরী আত্মা
‘কলেজে প্রবেশ পথে সোনিয়ার সঙ্গে দেখা,
আমাকে দেখে কেমন চুপসে গেল। এতদিন পর দেখা-সাক্ষাত, মুখে একটু আনন্দের হাসি থাকা চাই। এ দেখছি সোয়ামি মরার শোক!’
আমি নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলাম।
──কি রে খুব ভাবে আছিস মনে হচ্ছে।
──না রে ভাবে না ঠিক, এমনি মন খারাপ।
── মন খারাপ কি এমনি হয়?
── সত্যি করে বল, কি হয়েছে, না কি প্রেমে পড়েছিস?
── প্রেম টেম কিছু না, লাবণীর জন্য মনটা খারাপ।
──’কেন?’ কি হয়েছে?’
── কেন জানিস না, ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে। আজ এই প্রথম একা একা কলেজে আসলাম —মনটা ভীষণ খারাপ।
সোনিয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছে কেউ আমার নাকে মুখে গরম পানি ঢালছে; চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল।
লাবণীকে চিঠি দিবো ভেবে কদিন ধরে চিঠি লিখেছি,
বুক পকেটে রাখা চিঠিতে হাত দিতেই মনে হল কেউ আমার বুকে বিষাক্ত ধনুক মেরেছে, দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। সোনিয়াকে বিষয়টা বুঝতে না দিয়ে আমি ক্লাসে বই রেখে বাজারে গিয়ে একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে সিগারেট জ্বালাতেই মজিদ স্যার এসে হাজির।
সিগারেট হাতের মুঠে চেপে ধরে সুধির কাকার দোকানের দিকে রওনা দিলাম।
হাত পুড়ে যাওয়ার ক্ষত, ক্ষুদ্র ছিল তখন।
ক্লাস শেষ করে মিন্টু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল,
──বন্ধু মন খারাপ কেন? আমাকে বল শুনি।
──শুনে কি হবে বন্ধু। যা হবার তা তো শেষ।
── এমন করে বলছিস কেন? কি হয়েছে বল।
──লাবণী আমাকে চাইত, একান্তভাবে ভালোবাসত। আমাকে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু চিঠির উত্তরটা আমার বুক পকেটে এখন পরে আছে।
সাইকেল নিয়ে দুজন হাঁটতে লাগলাম। গল্প করতে করতে দূরের রাস্তা ছোট হয়ে আসে।
বক্কার কবি মানুষ, আমাকে বলেছিল,
──বন্ধু তোর আর লাবণীর নিয়ে একটা গল্প লিখব।
‘বন্ধু চিরকাল বন্ধু হয়েই থাকে।’
‘মা ও বন্ধুত্ব সম্পর্ক দুটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি পবিত্র মনে হয় ।’
কলেজ জীবন শেষ করে অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়নি। তিন চারজন ক্লাসমেট হয়তো শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছিল। শেষ পর্যন্ত অনেকের সঙ্গে আর দেখা হয়ে ওঠে নি কিন্তু বুকের ভেতর ওদের জন্য হাহাকার করে উঠত, কারণে-অকারণে ভীষণ মিস করতাম সবাইকে। নদী জল রেখা টেনে গেছে স্মৃতির মতো।
কেউ কেউ চাকরি করছে, ব্যবসা করছে।
আমার চাকরি হল পুলিশে যদিও আমার পছন্দ ছিল ভিন্ন কিছু।
আরও পড়ুন গল্প তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা
উনিশ বছর পর!
এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইল, পৃথিবীটা এখন একটা ঘরের মতো মনে হয় তবুও পাশের মানুষ পরিচিত মানুষ কেমন অচেনা হয়ে আছে। একজন মানুষকে এত বছর ধরে খুঁজে পাচ্ছি না।
হঠাৎ সেদিন সোনিয়ার সঙ্গে ফোনে কথা হল। জানতে পারলাম, লাবণী টাঙ্গাইল থাকে। স্বামী সংসার নিয়ে খুব একটা ভালো নেই। স্বামী নেশা করে।
বুকের ভেতর একটা আশা জেগে উঠল অবশ্য। হয়তো আমাদের দেখা হবে কোনো একদিন।
সকালে নাশতা করে বাসা থেকে বের হবো। তখন মোবাইল ফোন বেজে উঠল,
হ্যালো বলতেই,
এসআই পারভেজ বলল,
── স্যার আজ আট পুকুর পাড়ে একটি জোড়া খুন হয়েছে। আমাদের কাছে এইমাত্র তথ্য এসেছে।
আমি দ্রুত আসছি বলেই ফোন পকেটে ঢুকিয়ে গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম। থানায় এসেই পুরো টিম নিয়ে আমরা রওনা হলাম।
──পাগল হলেও তো নিজেকে বাঁচাতে চায় মানুষ।
অথচ,
খুনি খুন করে পালিয়ে যায়নি কেন?’
── কিছুক্ষণ পর আসামীকে নিয়ে আসল।
──আসামির নাম কি?’
── ‘লাবণী ।’
চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম।
── ‘হ্যাঁ ।’
সত্যিই তো লাবণী।
‘ যে হাতে ফুল অথবা রেশমি চুড়ি থাকার কথা সে হাতে আজ হাতকড়া। চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না কোনো ভাবেই। নিজের কাছে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম।
লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দিয়ে আমি পুরোনো চিঠির ভেতর ডুব দিলাম। লাবণীর মতন একটি মেয়ে খুন করতে পারে?’

যে কি না মৌমাছির শব্দে আমার বুকে এসে লুকিয়ে গিয়েছিল সেদিন প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পথে বাসার স্যারের বাড়ির সামনের বাগানে। তাও অনেকর সামনে। সেই ভীতু মেয়ে আজ! খুনি হয়ে আমার হাতে ধরা।

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!