হাইয়া আলাল ফালাহ্ (৪র্থ পর্ব)
হাইয়া আলাল ফালাহ্ (৪র্থ পর্ব)
বিমল কুণ্ডু
বন্যার পর আবার এল মহামারী। পর পর দু’টি ধকল কাটিয়ে যারা বেঁচে গেল গঞ্জ থেকে আসা সরকারের সামান্য রিলিফই তাদের ভরসা। এ অবস্থায় হুজুরের ফেলে যাওয়া খোঁড়া ছেলেকে খাওয়ায় কে? গ্রামের লোকেরা ধরাধরিতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজিজ মাতুব্বর তাকে আশ্রয় দিল। মাতুব্বরের উঁচু করে তোলা ধানের গোলায় তখনও কিছু ধান আছে। রক্ষা পেয়েছে বীজধানও। বন্যার পলিপড়া নতুন মাটিতে ধান বুনলে খুব ভাল ফসল হবে। এ সুযোগ কাজে লাগায় আজিজ সরদার। গ্রামের দুর্বল মানুষেরা একবেলা পেটভাতায় দিনরাত খাটে মাতুব্বরদের ক্ষেতে। কিশোর রহমতকেও লাগানো হয় কামলার কাজে। তার মতই একরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে চর হাফেজিয়ার জীবন। সেই কবে স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। মসজিদ থেকে শোনা যায় না আযানের ধ্বনি। সময় কেটে যায় আরো ষোলটি বছর। এর মাঝেই আবার ছোট একটা ঘটনা ঘটে।
রহমতের বয়স যখন উনিশ তখন তার ভিতরের রক্ত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এ জীবন। তার ভাল লাগে না। মনে পড়ে বাবার কথা। যে সানন্দবাড়ীর রূপকার ছিলেন তার পিতা, তার সন্তান আজ কামলা। গ্রামের লোক ভুলে গেছে হুজুরের অবদান। সবাই তাকে ডাকে খোঁড়া রহমত বলে। না, এ জীবন অসহ্য। এই অসহনীয় পরিবেশ থেকে সে মুক্তি চায়।
পেটে পিতার দেয়া একটু বিদ্যা ছিল। তাই সাহস জোগায় তাকে। একদিন গভীর রাতে একখানি লুঙ্গি আর গামছা সম্বল করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে রহমত। কিন্তু সেই নিবিড় অন্ধকারে দু’হাত বাড়িয়ে পথ আটকায় মাতুব্বরের পনের বছর বয়সের নাতনি সুফিয়া খাতুন।
কই যাইতাছো রহমত ভাই?
রহমত প্রথমে একটু থতমত খায়। তারপর বলে, এই গ্রাম ছাইড়া চইলা যামু। তোর দাদা আমারে চাকর বানাইছে। তুই ক্যান পথ আটকাস?
সুফিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। হ, সব দেইখা শুইন্যাত তোমার পর নজর রাহি। তোমার বাপজানের কাছে ছোটকালে ছিপারা পড়ছি। সব আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা। তেনার ইচ্ছায়ই আমি তোমার পথ আটকাই। তুমি চইলা গেলে আমি যে বুক ফাইটা মইরা যামু।
রহমত চাপাস্বরে ফুঁসে ওঠে, ক্যান-ক্যান?
আরও পড়ুন গল্প বিপরীত
সুফিয়া আঁচলে মুখ গুঁজে উত্তর দেয়, আমি যে তোমারে ভালোবাসি রহমত ভাই।
রহমত বিস্মিত হয়। একটু চুপ থেকে নিচু কণ্ঠে বলে, আমার লগে কই যাবি? আমার তো কোন ঠিক-ঠিকানা নাই।
সুফিয়া তেমনি কোমলস্বরে বলে যায়, ভাইব্যা দেখ, ঠিকানা একদিন তোমার বাপজানেরও ছিল না। এই গাঁয়ে তিনি ঠিকানা পাইছিলো। তুমিও কোনখানে পাইবা।
রহমত ভাবে, সত্যিইতো মা’র মুখে শুনেছে তার বাপজানের কাহিনী। বাপজান তার মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। সেই বাপের ভালোবাসার গ্রামের আর এক ভালবাসাকে সে কি করে ফেলে যাবে? রহমত আস্তে করে সুফিয়ার হাত ধরে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে, ঘাটে নাও বাঁধা আছে। আমি দাঁড় টানবো। তুই হালের বৈঠা ধরবি। পারবিনে?
সুফিয়া উত্তর দেয়, পারবাম।
তারপর অন্ধকারে মিলিয়ে যায় দু’টি কিশোর-কিশোরী।
প্রথম দিকে গ্রামে খুব গুঞ্জন উঠেছিল। অনেক কুৎসা রটেছিল। মাতুব্বর লোক লাগিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাদের সন্ধান পায়নি। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে।
মানুষ ভুলে গেছে রহমত-সুফিয়ার কথা। ভুলে গেছে হাফেজ আজাহার আলীর নাম।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার সময় চর হাফেজিয়া ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। নৌকা দিয়ে রান্না করে দিয়ে, এলাকার গরীব নারী-পুরুষও মুক্তিযুদ্ধে রেখেছিল অশেষ অবদান। তারপর দেশের মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে সামান্য যোগাযোগ বেড়েছে তাদের, কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘোরেনি।
২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের এক শীতের সকাল। একটা লঞ্চ এসে ভিড়লো চর হাফেজিয়ার ঘাটে। স্যুট টাই পরা এক যুবক লঞ্চ থেকে নেমে এসে একজন গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করলো, বলতে পারেন হুজুরের বাড়িটি কোথায় ছিল?
গ্রামবাসী উত্তর দিল, ঐ ওধার।
যুবকটি বললো, আমার সঙ্গে চলেন। একটু দেখিয়ে দিবেন।
যুবক লোকটির সঙ্গে গিয়ে একটি কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়ালো। সেখানে কে বা কারা বাস করে। সে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে লঞ্চে ফিরে এসে সঙ্গীদের সঙ্গে কিছু শলাপরামর্শ করলো। তার সঙ্গে রয়েছে আরো নয়জন যুবক আর একজন যুবতী।
আরও পড়ুন গল্প হাতের চুড়ি
এদিকে ঘাটের লঞ্চকে কেন্দ্র করে গ্রামের লোকের কৌতূহল বাড়লো। তারা ভাবলো হয়তো এরা সরকারের লোক। ব্রিলিফ দিতে এসেছে। জনতার ভিড় বাড়তে থাকলো।
যুবক তাদের উদ্দেশ্য করে বললো, শোনেন, আমরা গরীব মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করি। সবাই যাতে খেয়ে পরে বাঁচতে পারে- তাদের সন্তানেরা লেখাপড়া করতে পারে। তার ব্যবস্থা করে দিই। আপনাদের এই গ্রামে আমরা কাজ করতে চাই। আপনাদের দুঃখ দূর করতে চাই। আপনারা যদি চান তাহলে আজ থেকেই কাজ করতে পারি।
দুঃখ-কষ্টে যাদের জীবন গড়া তাদের কাছে আশার বাণী অনেক কিছু। নদীর পাড়ে দাঁড়ানো সহজ সরল মানুষগুলো একযোগে তাদের সম্মতি জানিয়ে দিল।
যুবকের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ধন্যবাদ জানিয়ে সে বললো, তাহলে আমাদের একটু কাজ করে দিন। আপনাদের মধ্য থেকে দশজন লোক লঞ্চে উঠে আসেন। যেসব মালপত্র নামাতে বলি, তা নামিয়ে হুজুরের বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় জমা করেন। পরের কাজ পরে বলে দেব। এজন্য আপনারা উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবেন।
ঘণ্টা চারেক অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্দিষ্ট জায়গায় দু’টি বড় বড় তাঁবু খাটানো হলো। তারমধ্যে চেয়ার টেবিল সাজানো হয়েছে। যুবকের নির্দেশে তার দলের একজন তাঁবুর সামনে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিল।
দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকাল হতে চলেছে। যুবকটি উপস্থিত লোকদের বলে দিল, কাল থেকে পুরাদমে কাজ চলবে। সন্ধ্যায় গ্রামের সবাইকে এখানে আসতে বলবেন। আপনাদের গ্রামের মাতুব্বর সাহেবও যেন আসেন।
যুবক তার সঙ্গীদের নিয়ে লঞ্চের উদ্দেশে রওনা হলো।
সন্ধ্যা নামতেই চর হাফেজিয়ার মানুষ জীবনে প্রথমবারের মতো দেখতে পেল একটি বিশেষ জায়গায় আলোর রোশনাই। ভট ভট্ করে শব্দ ভেসে আসছে সেখান থেকে। ঝলমলে আলোয় তাঁবু দু’টি স্পষ্ট চোখে পড়ছে। উৎফুল্ল জনতা ক্ষণিকের মধ্যে এসে ভিড় করলো তাঁবুর খোলা প্রান্তরে।
আরও পড়ুন গল্পটির-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্বর
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
হাইয়া আলাল ফালাহ্ (৪র্থ পর্ব)