হাইব্রিড
গল্প,  শফিক নহোর (গল্প),  সাহিত্য

হাইব্রিড

হাইব্রিড

শফিক নহোর

 

সস্তা দরে ধানের মৌসুমের সময় কিছু ধান কিনে রাখলে ভালো পয়সা পাওয়া যাবে। চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করলাম। কিছু একটা করা দরকার। আমরা কৃষক মানুষ। এত টাকা পয়সা পাবো কোথায়, যে বড় ব্যবসা করব। তাই তিনটা ছাগল, আর কিছু হাঁস-মুরগি বিক্রি করে যে টাকা হল, তা দিয়ে ধান কিনে রেখে দিলাম। কিছুদিন পর বিক্রি করতে গেলাম বাজারে, ধানের ভালোই দাম। নাদের কাকার কাছে লাভে বিক্রি করে দিলাম। বাজান খুশি। বলছে , বেশ ভালোই হয়েছিল ধান কিনে রেখে। কৃষি কাজের পাশে অন্য কিছু করতে পারলে ভালো। অভাব সহজে দেখা দেবে না। মানুষ যে কাজ-ই করুক না কেন, পাশাপাশি অন্য কিছু করা দরকার। তা না হলে আমরা উন্নতি করতে পারব না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি না হলে আমাদেরও উন্নতি হবে না। কৃষিকাজ আজকাল কেউ তেমন একটা পছন্দ করে না।

 “চাষা কোনো মানুষ হল।” সবাই খারাপ নজরে দেখে। বাজানকে বোঝালাম যে কৃষিকাজ মানুষ যত-ই খারাপ বলুক না কেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে হাইব্রিড ধান চাষের বিকল্প নেই। আব্বাকে বুঝাতে গেলেই সমস্যা, বেয়াদব ছেলে বেশি বুঝে। এ বলে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে অনেক দিন। আমি বই পুস্তক পড়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে যা বুঝলাম, হাইব্রিড ধান চাষ না করলে আমরা কৃষক মানুষ ভালভাবে সংসার চালাতে পারবো না। সব ধরনের কৃষিকাজে উন্নতজাতের বীজ ব্যবহার করতে হবে এক কথায়।

আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ

_কিছুদিন পরে আব্বাকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। টেলিভিশন দেখাতে, টিভিতে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। বাবাকে বললাম, দেখো টিভিতে কৃষিভিত্তিক কত সুন্দর অনুষ্ঠান হয়। বাবা তো এত দিন জানত টেলিভিশন দেখা পাপ। বাবাকে আমি বুঝিয়েছি, টেলিভিশনে ভালো কিছু দেখা পাপ না। টেলিভিশন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। বাবা এখন চলছে, হাইব্রিড দুনিয়া, সবকিছু হাইব্রিড। কৃষিতে হাইব্রিড ফসল চাষ না করলে লোকসান গুনতে হবে। শুধু ধান চাষ না। মাছ চাষ, গরু, ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি। কৃষি জাতীয় যাবতীয় সবকিছুই এখন হাইব্রিড চাষ করতে হবে। অল্প টাকায় বেশি লাভ। বাবা পুলকিত হলো। এবার নতুন ধান চাষ করছি মাস আল্লাহ্ দারুণ ফলন হয়েছে। থানা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি আমরা।

টুম্পার আব্বা সারা দিন, টুম্পার মায়ের লগে ক্যাচাল বাধাবে, ঘ্যান ঘ্যান করবে। কানের কাছে এতকিছু ভাল লাগে। সংসারে অভাব, বড় মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছে না। এনজিও থেকে ঋণ নেওয়া আছে। তা পরিশোধ করতে পারছে না। চারদিকে অভাব আর অশান্তি। হাতেম কাকাকে কৃষিকাজ করে বললাম, আপেলকুলের গাছ লাগাতে। আমার লগে জিদ করে দেশি বড়ই গাছ লাগাইছে, ফলন তো দূরের কথা গাছে ফুলও আসে নাই। দেশ কি আগের মত আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগের মত কোনো কিছুই হয় না। বেশ ক’বছর হলো নারকেল গাছে ডাব ধরছে না। লোকজন বলাবলি করছে, মোবাইল ফোনের টাওয়ারের জন্য নারকের গাছে ডাব ধরছে না ইদানীং।

_কাকা আমি তা বলতে পারব না, মিন্টু হাজারীকে দেখলাম পেপার কিনছে। আমাকে বাড়িতে দিয়ে যেতে বললো। আমি যাওয়ার সময় একটু পড়ে দেখলাম। মোবাইল ফোনের টাওয়ার রেডিয়েশনের কারণে মানুষের টিউমার, আলঝেইমার, ব্রেইন টিউমার, ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, নিদ্রাহীনতা ,উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও গর্ভপাতসহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে। সেখানে তো গাছে ডাব ধরবে না তা লেখা দেখলাম না। না জেনে কোনো বিষয়ে গুজব ছড়ানো অন্যায়।

আরও পড়ুন গল্প সোনালী

_কাকা তোমার ধারণা ঠিক হতেও পারে আবার নাও পারে । তোমারে কই কি চাচিরে নিয়ে কত্ত কষ্ট করো, এবার তোমার বাড়ির আঙিনায়, হাইব্রিড মুলা , ফুলকপি,পাতা কপি চাষ করো দেখবে লাভ হবে। কৃষিকাজ করেই যদি খেতে হয়। ভালো ভাবে কৃষিকাজ করেই খাও। তাছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক কৃষির উপর ঋণও দেয়। কাকা হাইব্রিড চাষ করলে ফলন বেশি তাতে লাভ ও বেশি। কৃষক মানুষ আমরা , আমাগো কি বুদ্ধি আছে জাহাজ বানানোর , টুম্পাকে স্কুলে যেতে দিচ্ছো না ক্যান? মেয়েদের লেখাপড়া তো ফ্রি, কোন টেহা পয়সা লাগবো না। স্কুল থেকে টেহা পাইবো, আমগো সংসারে কী কোন অভাব আছে এখন। আমার বাজান তো এখন কৃষিকাজ করেই না। কাজের লোক আছে তারাই করে। গঞ্জে বাবা আর আমি দোকান নিচ্ছি। অস্ট্রেলিয়ান গরুর খামার করছি। বাজারে দই-মিষ্টির দোকান দেবো ভাবছি।

_কও কি? সামাদ মিয়া, জি চাচা। তোমাগো এত কিছু হইলো। আমি তো কৃষিকাজ করে কিছুই করতে পারলাম না। দিনদিন সংসারে অভাব বাড়ছে। বড় মেয়েটা সেয়ানা হয়ছে, বিয়ে দিতে হবে। যৌতুক  না দিতে পারলে ঘটক বলছে, বিয়ে নাও হতে পারে।

_এমন ভাবে ছেলে পক্ষ বলল। জমাইয়ের দোকান আছে । বাড়ি থেকে দোকান দূরে একখান মোটরসাইকেল হলে ভালো হয়।

_তোমার মেয়ের বিয়ের কথাটা আমি বরপক্ষকে গিয়ে বলবো। তারা না, করবে না আশা করি। তোমার মেয়ে সুন্দরি, পাঁচ ক্লাস লেখাপড়া জানে। তুমি যদি সম্মতি দাও তাহলে ছেলেকে একদিন আসতে বলি। তোমার মেয়ে দুধেভাতে থাকবে।

ঘটককে বলছি, আমি একটু ভেবে নেই।

আরও পড়ুন সময়ের পাঁচফোড়ন

_সামাদ মিয়া তোমার লগে এটা কথা ছিল,

_তুমি এত লজ্জা পাচ্ছো কেন?’ নতুন চরের জমিটা বিক্রি করতে চাই। তোমার বাবাকে একটু বলো,

_কিনবো কি না। জি চাচা বাজানকে বলবো।

_কাকা হঠাৎ জমি বিক্রি করবে কেন?’

_শেফালির বিয়ের কথা হচ্ছে, খরচ আছে। ছেলে মোটরসাইকেল চায়। আমার তো দু’মেয়ে ছাড়া দুনিয়াতে কেউ নাই। বয়স হয়ে গেছে মাঠে খাটুনির কাজ করতে পারি না।

_হাকেম কাকা, চিন্তা করও না, বাজানকে বলে। আমি একটা রাস্তা বের করব।

_চাচা সংসার চলবে কি ভাবে ,”সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত যারা নিতে পারে না। তারা কোনদিন উন্নতি করতে পারে না।”

নাটকীয় ভাবে মিনুর সঙ্গে আমার বিয়ে পরের দিন। বাবা খুব পছন্দ করে, মিনুরে পুত্রবধু করে ঘরে আনছে। তা আমি কোনদিন ঠাহর করতে পারি নাই। মনে মনে আমি ও মিনুকে খুব পছন্দ করতাম। বাজারে নতুন দোকান দিয়েছি, মাঠে কৃষিকাজ সব কিছু মিলে বেশ ভালই যাচ্ছে আমাদের সংসার।

সামাদ মিয়ারে ধন্যবাদ সে আমারে সৎ পরামর্শ দিয়েছিল, হাইব্রিড সফল চাষ করবার জন্য। আমি তাই করছিলাম। আমার সংসারে এখন অভাব নাই। সত্যিই দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। বিজ্ঞান উপযোগি কৃষি স্বনির্ভর-সব কিছু ব্যবহার করতে হবে।

আমাদের পুরানো চিন্তা ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। টুম্পা নতুন জামা পরে আজ স্কুলে যাচ্ছে। আমি নিজেই খুশি হয়ে মেয়ের জামাইকে মোটরসাইকেল কিনে দিলাম। আজ আমার মত খুশি কৃষক এই গ্রামে একজনও নেই।

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

হাইব্রিড

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী মো. আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ সাহিত্য সংকলনের সম্পাদক এবং ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ সালের ১৫ জুন, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!