হাইবাত-জান-চৌধুরী
দুলাই,  দুলাই (গ্রাম),  সমাজসেবক

হাইবাত জান চৌধুরী

হাইবাত জান চৌধুরী

কৃষ্ণ ভৌমিক

 

হাইবাত জান চৌধুরী ইতিহাসের মহিরুহ। তিনি ভারত স্রষ্টা জওহর লাল নেহেরু, সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের মতো নেতাদের স্বচক্ষে দেখেছেন।  আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর জেনারেল শাহ নেওয়াজ ও কর্ণেল ধিলনের মত সামরিক কর্মকর্তার সাহচার্য পেয়েছেন । নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কনফারেন্সে অংশগ্রহণের স্মৃতি তিনি এখনও ভুলেননি। পাকিস্তানি বন্দিশিবিরের চার বছরের মানসিক নির্যাতনের স্মৃতিও আজ তাঁর চোখের উপর ভাসছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কলকাতা দাঙ্গায় জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচার স্মৃতি ধূসর হয়নি।

জন্ম: হাইবাত জান চৌধুরী ১৯২৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন দুলাইয়ের প্রখ্যাত মুসলিম জমিদার আজিম চৌধুরীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

পারিবারিক জীবন: হাইবাত জান চৌধুরীর বাবা আব্দুল সোবাহান, মা সৈয়দা রাবেয়া চৌধুরাণী। তাঁর মা ছিলেন বগুড়ার মহাস্থানগড়ের হযরত শাহ সুলতান মাহি সওয়ারের বংশধর। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। তাঁর বড় ছেলে বাংলাদেশ বিমানের সিনিয়র ক্যাপ্টেন। বড় মেয়ে আমেরকিা প্রবাসী। ছোট মেয়ে ইউনিসেফের ডেনমার্কের বড় কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন দুলাইয়ের প্রখ্যাত মুসলিম জমিদার আজিম চৌধুরী

শিক্ষাজীবন: হাইবাত জান চৌধুরী পাবনা জিসিআই স্কুল থেকে  ম্যাট্রিকুলেশন  পাশ করেন। ১৯৪৩ সালে সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রী নেন। ভারত উপমহাদেশে স্বাধীনতালাভের প্রাক্কালে তিনি ঢাকায় ফেরেন। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার হিসেবে যোগদান ও কমিশন লাভ করেন। তিনি কলকাতায় বিএসসি পড়াকালে ভারতস্রষ্টা পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল, ভুলা ভাই দেশাইকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন। কলকাতা ধর্মতলার পাশে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে নিখিলভারত কংগ্রেস কমিটির মিটিংয়ে বিখ্যাত এ নেতারা আসেন। সে মিটিংয়ে তিন উপস্থিত ছিলেন। তিনি বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী কানন দেবীর সাথেও সাক্ষাত করেন। তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) কলকাতায় প্রত্যাবর্তনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির থাকা। নেতাজি সুভাস বসুর বড়ভাই শরৎ চন্দ্র ছিল তাঁর বন্ধু। তাঁর বাড়িতেই আজাদহিন্দু ফৌজের মেজর জেনারেল শাহ নেওয়াজ, কর্ণেল ধিলেন, কর্ণেল রশিদসহ বাঘা বাঘা সামরিক কর্মকর্তাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়।

আরও পড়ুন ড. এ বি মির্জ্জা মোঃ আজিজুল ইসলাম

বঙ্গবন্ধু ও হাইবাত জান চৌধুরী: বেঙ্গল চীফ মিনিস্টার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী মুসলিম লীগের ডাইরেক্ট এ্যাকশনের ঘোষণা দেয়ার পর কলকাতায় শুরু হয় ইতিহাসের জঘন্যতম দাঙ্গার তান্ডব। তিনি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসির ছাত্র। কলকাতা সরকারি টেইলর হোস্টেলে থাকতেন। সে সময় মুসলিমদের জন্য তিনটি সরকারি হোস্টেল ছিল। কারমাইকেল হোস্টেল, টেইলর হোস্টেল ও বেকার হোস্টেল। তাঁর হোস্টেলের সামনে ছিল বেকার হোস্টেল।

সে হোস্টেলে থাকতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ইসলামিয়া সিটি কলেজে আইএসসি পড়তেন। তিনি তখন ছাত্রনেতা। তার সাথে বেশ সখ্যতা জমে ওঠে। শুক্রবার জুমার নামাজের জন্য বঙ্গবন্ধুসহ কয়েক বন্ধু মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হন। নামাজ শেষে মসজিদে তাদের মিটিং ছিল। কিন্তু তারা মসজিদ পর্যন্ত যেতে পারলেন না। তার আগেই শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা। তাদের উপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। একদল উগ্রপন্থী হিন্দু যুবক তাদেরকে ধাওয়া করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তারা দৌড়ে এক হিন্দুবন্ধুর বাড়িতে ঢুকে পড়ে। সেখানেও তারা নিরাপদ ছিলেন না। এরপর হিন্দুবন্ধুটি তাদের বাড়ির পিছনের সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে প্রাণ বাঁচাতে বললে তারা সেভাবেই পালায়। তারা পালানোর সময় দেখতে পায় রাস্তায় যেখানে সেখানে পড়ে আছে লাশ আর লাশ। এদিন কোলকাতার রাস্তায় শত শত হিন্দু মুসলমানের রক্তের স্রোত বয়ে যায় সেদিনের স্মৃতিস্মরণ করতে গিয়ে তিনি যেন বার বার কেপে ওঠেন।

আরও পড়ুন কৃষি বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন

মেজর জেনারেল শাহ নেওয়াজ ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেকেন্ড ইন কমান্ড। সুবাস বোসের পরই তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যাক্তি। হাইবাত জান চৌধুরী তাদের সাথে দুপুরের খাবারও খেয়েছিলেন। আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনার স্বাক্ষী ছিলেন হাইবাত জান চৌধুরী। ১৯৪১ সালে সিরাজগঞ্জে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কনফারেন্সে তাঁর অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছিল। এ কনফারেন্সে ভারতবর্ষের প্রায় সব নেতাই এসেছিলেন। এম.এ জিন্নাহ, লিয়াকত আলী, খাঁজা নাজিম উদ্দিন, শহীদ সোহরওয়ার্দী, এম.এ ইস্পাহানি, আবুল কাশেমসহ খ্যাতনামা অনেক নেতাই উপস্থিত ছিলেন। হাইবাত জান চৌধুরী দু’জন সহপাঠিকে নিয়ে সাইকেলযোগে এ কনফারেন্সে উপস্থিত হন। কনফারেন্স চলে ৭ দিন। এ কনফারেন্সের স্মৃতি তাঁর মনে আজও জ্বল জ্বল করছে।

মুক্তিযুদ্ধ: মহান মুক্তিযুদ্ধে তার পূর্ণসমর্থন থাকলেও তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এ দুঃখ তাঁকে এখনো যেন মনে করিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত সকল ফৌজি, অফিসারসহ সিভিলিয়ান অফিসারদের সাথে তাকেও স্বপরিবারে বন্দি রাখা হয়। প্রতিমূহুর্তে তাদের উপর মানসিক নির্যাতন চালানো হতো। চার বছর বন্দীজীবন কাটানোর পর ১৯৭৪ সালে তাদেরকে দেশে পাঠানো হয়।

কর্ম জীবন: স্বাধীন দেশের বিমানবাহিনীতে গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে বিমানবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘে যোগ দেন। ১৯৯০সালে পর্যন্ত এ্যাশিয়ান প্যাসিফিক চীফ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিমান বাহিনীতে চাকরিকালীন দেশের জন্য অনেক অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে থাকাকালীন মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি ইনচার্জ হিসেবে সামরিক বেসমারিক ১১ সদস্যকে নিয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের ১১টি ক্যাম্পে আনেন। এরপর জাতিসংঘের সমন্বয়কারী ও অস্থায়ী প্রতিনিধি বার্নার্ড জাগবিনকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৭৭-৭৮ সালের মধ্যে মিয়ানমার সরকারের সাথে আলোচনা করে প্রথমবার রোহিঙ্গাদের সে দেশে পাঠান। তিনি চাকরিজীবনে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে ছিলেন। তিনি বিএফ শাহিন কলেজের সেক্রেটারী ছিলেন ৫ বছর। বাংলাদেশ চা-বোর্ডের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ড. ইউনুছের ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে প্রথম ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পটি তারই সহায়তায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

আরও পড়ুন অধ্যাপক ডা. রুহুল আবিদ

লেখালেখি: হাইবাত জান চৌধুরী লেখক, কলামিস্টও বটে।  ইংরেজি সূরা ফাতিহার “দ্যা গ্রেট ওয়ে টু দ্যা হলি কোরআন” নামক একটি বই লেখেন। যা মুসলিম সমাজে ব্যাপক সমাদ্রিত হয়। তিনি ডেইলি স্টার, ইনডিপেন্ডেন্ট, বাংলাদেশ টাইমস, দি ডেইলি সানে ৮০ থেকে ৯০ টি আর্টিকেল লিখেছেন।

এ বয়সেও তিনি মনের দিক দিয়ে যেন তরুণ। এখনো তিনি স্বপ্ন দেখেন সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য কিছু করার। তাঁর পরিকল্পনা রয়েছে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য মহিলা আশ্রম করার। তাঁর স্ত্রী কিডনীরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুযন্ত্রনা তিনি আজও ভুলতে পারেননি। তাঁর পরিকল্পনা দরিদ্র কিডনী রোগীদের অল্পব্যয়ে ডাইলোসিস করার জন্য আধুনিক ডাইলোসিস হাসপাতাল নির্মাণ করা। তিনি এখন নিভৃতে সমাজের অসহায় দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা সেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে অসুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে চলছেন।

তিনি ঢাকার গুলশানের বাড়িতে নিরবে নিভৃতে জীবন কাটাচ্ছেন।

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!