সোনালী-৫ম-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

সোনালী (৫ম পর্ব)

সোনালী (৫ম পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

মাঘের শীত। রাত বারোটার পর ভদ্র লোকেরা বাড়ীর বাইরে বের  হয় না। কিন্তু যারা নিশাচর আর জাঁকজমক জীবনে অভ্যস্ত তারা  ছুটে যায় দামী কোন বুনিয়াদী বাড়ীর ড্রয়িং রুমে। তাদের জন্য অপেক্ষায় থাকে মোক্ষীরানী।

সেই মাঘের রাতে কনকন শীতে সোনালী হাতে তুলে দেয়া হলো একটি সাধারণ ভ্যানিটিব্যাগ। সেই ব্যাগে ছিল মোটা অংকের মাদকদ্রব্য যা আমার পক্ষে জানার কথা নয়। কারণ ভ্যানিটিব্যাগটি বিশেষ কায়দা বন্ধ করে দেয়া হতো। এবার আমি সাধারণ যাত্রী। কোনো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ শেষে বাড়ী ফিরছি। সাধারণ বাসে চড়তে হবে।

সেইভাবে আজকের পোশাক পরিধান করেছি। কোথায় নামব তা গাড়ীতে উঠার সময় বলে দেয়া হতো। ছায়ার মত পাহাড়ায় রাখা হতো। গাড়ীর নামসহ নম্বর পর্যন্ত মোবাইলে খুদে বার্তায়  অন্য পার্টিকে জানিয়ে দেয়া হতো, যাতে কোন রকম ভুল না হয়। এতটাই গোপনীয়তা রক্ষা হতো যা আমি নিজেও কখন জানতে পারে নি। এদের কেউ এই কাজে দায়িত্বে থাকতো। নির্ধারিত বাসস্টান্ডে অপেক্ষা করতো একজন বা দুজন লোক।

প্রায় ঘন্টাখানেক গাড়ী চলার পর একটা বাসস্টান্ডে দাঁড়াতেই একজন যুবক এসে আমাকে নির্দিষ্ট সংকেত দিল। প্রথম সংকেত দেয়ার মূহুর্তে আমাকে গাড়ী হতে নামার ইঙ্গিত করলো। কোন কথা না বলে গাড়ী হতে নেমে পড়ি। সঙ্গে সঙ্গে  ভ্যানিটিব্যাগটি হাত বদল হয়ে গেলো। আর সাধারণ একটা ভ্যানিটিব্যাগসহ একখানা পাঁচশত টাকার নোট আমার হাতে গুজে দিয়ে গুড বাই বলেই হাওয়া হয়ে গেল।

আমি তো তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। এরা এতটাই  সুশৃঙ্খলা ভাবতেই এখনো আমার  শরীর শিহরণ দিয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন ওরা তেরোজন

-আচ্ছা, এদের চেহারা কি কখনো দেখেছেন? দেখে কি আন্দাজ করতে পেরেছেন তাদের পরিবার সম্পর্কে?

-জ্বিঁ স্যার। প্রায় তিন-চার বছর এদের সঙ্গে কাজ করেছিলাম। দেখে মনে হয়েছিল এরা ধনী এবং অভিজাত শ্রেণির ঘরের বখে যাওয়া সন্তান। আবার শিক্ষিত বেকার যুবক ছিল। মোটর সাইকেল ব্যবহার করতো। মাঝে মাঝে মোটরকারও দেখেছি।

-এটা তো একেবারে রূপকথার গল্প।

-স্যার, আপনি যে জগতের মানুষ, এর চেয়ে ভয়ংকর একটা জগৎ আছে। সেটা আপনার কাছে রূপ কথার জগৎ। বুঝে উঠার আগেই মুহুর্তের ভেতরে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। বলতে পারেন আমার জীবনের আর একটি অধ্যায় সমাপ্তি ঘটলো। একটা জীবনে কত ঘটনাই না ঘটতে পারে তা নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করে চলেছি।

-আচ্ছা, কি ঘটনা ঘটেছিল সেইদিন?

বেশ কিছু সময় নীরব থেকে বললো,

-স্যার যদি কিছু মনে না করেন, এককাপ চা খেতে পারি?

-ঠিক আছে।

ঠিকই, তাই তো। সোনালী তার জীবনের উত্থান- পতনের কাহিনী বলতে বলতে  ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এখানে জীবনের উত্থান বলতে কিছুই নেই, আছে শুধুই পতন আর গঞ্জনা। চা- পানের পর আরম্ভ করলো।

-ভ্যানিব্যাগটা হাত বদল হওয়ার প্রায় পাঁচ-ছয় মিনিট সময় কেটে গেছে। ঢাকাগামী বাসে উঠার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ ঝড়ের মত তিনজন যুবক এসে আমার নাকে-মুখে ঘুঁষির পর ঘুঁষি মারতে শুরু করলো। এক সময় মাটিতে পরে যাই। এরপর পেটে এবং তলপেটে লাথি মারতে শুরু করে। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন জ্ঞান ফেরে তখন একটা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। তলপেটে ব্যান্ডিজ। ব্যাথায় শরীর নড়াচড়া করার কোন শক্তি নেই। পরে জেনেছি বড় ধরণের অপারেশন করা হয়েছিল। নার্স বলেছিল, আমি নাকি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। শুনে হেসেছিলাম।

আরও পড়ুন অন্তর্জাল ও মৃত্যু

-কেন?

-কেন আবার। আমার আবার নতুন জীবন। হিজড়ের জীবন। এবার হয়ত রাস্তার পাশে অথবা কোন একটা গাছের নিচে বসে বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষে করে নতুন জীবন যাপন করতে হবে।

-হাসপাতালে আপনাকে কারা ভর্তি করেছিল?

-জানেন, পুলিশকে আমরা যতই খারাপ বলি না কেন তারাই আমাকে বাঁচিয়েছিল। অনেক পুলিশকে দেখেছি অসহায় মানুষকে তারা নিজের পকেটের টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। রাতের আঁধারে কত ঘটনাই না ঘটে, তা স্বচক্ষে দেখেছি। বলুন, পুলিশ কতটা শামাল দিবে। আমাকে সাহায্য করেছিল বলেই  তাদের সাফাই গাইছি তা নয়। ভাল-মন্দ নিয়েই তো সমাজ। স্যার অনেক কিছু দেখেছি। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারি নি। কারণ এই সমাজে আমাদের কোন নাগরিক অধিকার নেই। পরে একটা এনজিও’র কাছে হস্তান্তর করেছিল। তারাই আমাকে বেঁচে থাকার পথ দেখিয়েছে। কর্মসংস্থান করে দিয়েছে। আর এই যে দোকানটা দেখছেন, এটা তারাই দিয়েছে। আর পেয়েছি বাবা-মা যারা আমাকে মানুষ হিসেবে বুকে টেনে নিয়েছে। খুব ভাল আছি।

-আচ্ছা, সোনালী আপনাকে এত বড় ক্ষতি করেছিল তারা কারা? কিছু জানার চেষ্টা করেছিলেন কখনো?

-জ্বিঁ। সেইদিন আমি যে ব্যাগটা বহন করেছিলাম, আমার মনে হয়েছিল সেই ব্যাগে অনেক মূল্যবান সম্পদ ছিলো। হয়ত অন্য কোন শক্তিশালী পার্টি জেনে যেতে পারে, তার জন্য নিজেদের লোক দিয়ে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। আবার এটাও তাদের ধারণা হতে পারে, আমার পরিচয় দ্বিতীয় কোনো পার্টি জেনে গেছে। অনেক বছর এদের সাথে ছিলাম। এদের মেজাজ-মর্জি বুঝা খুবই কষ্টকর স্যার। আবার এমন হতে পারে আমাকে ধরে নিয়ে গোপন আস্তানার খোঁজ নিতে পারে। জানি না স্যার। সবই আমার ভাগ্য।

আরও পড়ুন সোনালী গল্পের-
১ম পর্ব
২য় পর্ব 
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সোনালী (৫ম পর্ব)

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!