সোনালী (২য় পর্ব)
সোনালী (২য় পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
মেয়েটির নাম সোনালী। সে পদ্মা নদীর দক্ষিণ পাড়ের মেয়ে। বিশ-ত্রিশ খানা বাড়ী নিয়ে ছোট গ্রাম। পদ্মার ভাঙ্গনে ঝড়-বৃষ্টি আর নিত্যদিনের দূর্যোগ মাথায় নিয়ে জীবন যাপন করে এই পদ্মাপাড়ের গরীব অসহায় মানুষগুলো। এলাকার অবস্থাসম্পন্ন কৃষকের বাড়ীতে এই দরিদ্র পুরুষ-মহিলারা কাজ করে। এটাই তাদের একমাত্র জীবিকা। মাঝে-মধ্যে যৎসামন্য সরকারি ত্রাণ পেয়ে থাকে। অতি কষ্টে দিন অতিবাহিত করে এই পদ্মাপাড়ের লোকজন।
আর সোনালী সেই অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। তিন বোন-ভাই নিয়ে তাদের অভাবী সংসার। বাবা আর বড় ভাই অন্যের বাড়ীতে কাজ করে। মা সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করে। সোনালী পাড়ার সমবয়সী ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সারাদিন হইহুল্লা করে সন্ধ্যায় বাড়ী ফেরে। মার কাছে বকাঝকা খেতে হয়। তাতে সোনালীর কিছু আসে-যায় না। বয়স আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। চেহারায় চাঁদের আভা লাগতে শুরু করেছে। বয়স বার তো হবেই। তবে পুষ্টিহীনতার কারণে বয়স বুঝার উপায় নেই। মনে-দেহে পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। কন্ঠস্বর বদলে গেছে। খেলার সাথী ছেলেরা দূরে দূরে থাকে। সোনালী টের পাচ্ছে এখন সে ছেলেদের চেয়ে আলাদা। তাই ছেলেরা তাকে এড়িয়ে চলতে শুধু করেছে। গরীব ঘরের জন্ম হলে কি হবে। সোনালীর গায়ের রং কাঁচাহলুদের মত আর আর্কষনীয় চেহারা। বাড়ীর বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। উড়ন্ত পাখী খাঁচায় বন্দি হয়ে গেল। সারাদিন সহপাঠীদের নিয়ে চরে দৌড়াদৌড়ি করা চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে গেল। ছন্দ পতন হলো সোনালীর কিশোরী মনের রঙিন স্বপ্ন। হঠাৎ একদিন মা বললো,
-সোনালী, আমার কাছে আয়ে বয়তো মা।
সোনালী কোন কথা না বলে সে তার মায়ের পাশে গিয়ে বসলো।
-বলো, কি কইবা?
সোনালী মা আমার, এখন বড় হইয়া গ্যাছো। ছেলেদের সাথে চরে আর যাওন কাম নেই।
-ক্যান, মা?
-পাড়ার মানুষেরা নানান কিছিমের কতা কয়।
সেইদিন হতে সোনালীর সোনালী ডানা ঝাপটানো শেষ হয়ে গেলো। ঘরে তার মার সাথে গৃহস্থলীর কাজে সাহায্য করে। কিন্তু মন পড়ে থাকে পদ্মা পাড়ের বিস্তৃর্ণ ধূ-ধূ বালুরাশির ওপর।
আরও পড়ুন গল্প পক্ষিরাজের ডানা
সময় চলে যাচ্ছে তার গতিতে। চৌদ্দ বছর বয়সে পা দিয়েছে সোনালী। হঠাৎ আবার একদিন বিকেলে তার মা ডেকে কাছে বসিয়ে সংসারের অভাব অনটনের কথা বলতে থাকে। তার বিয়ে দিতে হবে। আকস্মিক জিজ্ঞাসা করে।
-হ্যারে সোনালী, তোর কি মাসিক হয়?
সোনালী আকাশ হতে পরে।
-মা, সেটা আবার কি?
মা এ নিয়ে আর কোন কথা বাড়ায় নি। গ্রাম্য-কবিরাজের সাথে কথা বলে। মার মনে দুঃশ্চিন্তা গেঁথে গেলো। এই বয়সেই তো মেয়েদের মাসিক হয়। আর বছর খানেক পর বিয়ে দিতে হবে। মেয়েদের দূর্ভাগ্য আর দুর্যোগে ভরা জীবন। তারপর অসহায় গরীব ঘরে জন্ম। বিয়ের পর স্বামীর ঘর এবং সন্তান জন্ম দেয়া। শুধু সন্তান জন্ম দিলেই চলবে না, বংশ রক্ষা করার জন্য পুত্র সন্তান চাই। সব কিছুই দায়- দায়িত্ব একজন স্ত্রীর। সংসারে নির্দোষ পুরুষ নামে মানুষগুলো। জানেন, গ্রামের দরিদ্র ঘরে মেয়ে হলে কি হবে সে খুব বুদ্ধিমতী। বেঁচে আছে কিনা জানি না। বলতো মেয়েদের জীবনটা আলু তরকারীর মত। সব জায়গায় মানিয়ে চলতে হয়। কিন্তু জীবনের শেষ বেলায় মরার পর স্বামীর কবরের পাশে কবর হয় আবার নাও হতে পারে। আবার বিয়ের পর যে স্বামীর কোন ভালবাসা পায় নাই, মরণের পর স্বামীর পাশে চিরনিদ্রায়।
স্যার, কথাগুলো আমার ভাষায় আপনাকে শুনালাম। নিয়মিত কবিরাজী ঔষধ খেয়ে যাচ্ছি কিন্তু ফলাফল শূন্য। মা দুঃশ্চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারে না। আবার মেয়েলি বিষয় নিয়ে বাবার সাথে কথা বলতে পারে না। লজ্জার বিষয়। কে যেন মাকে বলেছে অনেক সময় একটু দেরীতে মেয়েদের মাসিক হয়ে থাকে। মা কিছুটা চিন্তামুক্ত হলো। তবু তো মার মন।
আরও পড়ুন গল্প খোয়ার
হঠাৎ একদিন বিকেলে বড় খালার ছেলে হাজির। বয়স বিশ তো হবেই। এই খালাতো ভাইটি বখাটে ধরণের এবং নেশাখোর। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। হাজার খারাপ হোক বোনের ছেলে তাকে তো বের করে দেয়া যায় না। আমার একটা ছাগল ছিল আর সেটা ছিল বড্ড পাঁজি। সন্ধ্যার পর ছাগলটি বাড়ীতে দেখতে না পেয়ে খোঁজ করার জন্য ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ীর বাইবে বের হই। কিন্তু কোথাও ছাগলটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ খালাতো ভাই এসে হাজির।
-সোনালী, তোমার ছাগলটা গোয়াল ঘরের পিছনে দেখে আসলাম।
-তা কিরে হয়? ঔখানে কেন যাবে?
-আরে আগে যায় নি। এখন যেতে পারে। গিয়ে দেখে আসতে পার।
খালাতো ভাইয়ের কথা বিশ্বাস করে গিয়ে দেখি গোয়াল ঘরে পিছনে কোন ছাগল নেই। পিছনে ছোট ভাইটি নেই। ওর খারাপ মনোভাব বুঝিতে পারিনি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে মিথ্যে বলে ফাঁদে ফেলেছিল। হঠাৎ খ্যাপা কুকুরের মত আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরলো।
আরও পড়ুন সোনালী গল্পের-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সোনালী (২য় পর্ব)