সোনালী সকাল (২য় পর্ব)
সোনালী সকাল (২য় পর্ব)
মোহাম্মাদ শাহ্ আলম
বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
_এতো দেরি করলি কেনরে?
_(মিতা) আর শুনো না বাবা। বর কনের বিদায় পর্যন্ত বাধ্য হয়ে থাকতে হলো।
_ঠিক আছে। কিছু খেতে হয় যদি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।
_না বাবা, খেতে হবে না। খুব ঘুম পাচ্ছে।
এরই মধ্যে পনেরো দিন গত হয়ে গেল। বর বধুর শুভদৃষ্টি অসমাপ্তই রয়ে গেল। দুজনার মনেই একই কৌতূহল। যাকে বিয়ে করলাম তার চেহারা চরিত্র কেমন? এই যে কৌতূহল, তা সেখানেই সীমাবদ্ধ রইলো না। তারা উভয়েই অনিদ্রা আর আহারে অরুচি জানিত রোগে ভূগতে লাগল।
সকাল দেবদাস সেজে বের হল, ছিপ বড়শি নিয়ে মাছ ধরতে। অবশ্য মাছ ধরার একটা বাতিকও আছে তার। আর সে বাতিক শৈশবে মামাবাড়িতে মামার কাছ থেকেই পেয়েছে। ছোট বেলা মামাবাড়িতে গেলেই, মামার একটা আদর্শ সাগরেদ হিসেবে সারাদিন তার পিছু লেগে থাকত সে। আর মামাও ভাগ্নেকে বশে রাখার উপায় হিসেবে, উঁচু গাব গাছ থেকে গাব অথবা পেয়ারা পেড়ে সে সব ঘুষ হিসেবে উপস্থিত করত।
সে সকল সুখের দিনগুলির কথা ভাবতে গেলেও চোখে জল আসে। আহ! সেই বাদাই নদী। আর তার সুস্বাদু মাছ! এখন যেন সে সব রূপকথার মতো। কেউ বিশ্বাস করবে না। মামা মাছ ধরতে ব্যস্ত আর সকাল কাদা মাটি নিয়ে গায়ে মেখে গড়াগড়ি দিয়ে মজা করছে। পরিশেষে টলটলে পানিতে ঝাঁপা-ঝাঁপি করে মামার শাসনহীন সান্নিধ্যে তার মজার অবধি থাকতো না। আজ বড় অশান্তির দিনে সেই বলগাহারা দিনগুলির কথা খুব মনে পরল। তাই তার মনে হলো এ অশান্তি দূর করতে শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত সেই বাদাই নদীর পাড়ে যদি অতীতের কিছু ছিটে ফোঁটা পাওয়া যায়, তার অন্বেষণে বাধা কোথায়? তাই সে পরের দিন প্রত্যুশেই সকলকে না জানিয়ে মাছ ধরতে বের হলো।
আরও পড়ুন গল্প হলেও সত্য
আর এদিকে সোনালি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। সেজন্য সবাই চিন্তিত হয়ে উঠল। কিছু দূরেই মামাবাড়ি। একটি মাত্র বোনের একটি মাত্র মেয়ে। তার এই অবস্থা চার মামার কানে যেতেই তারা রই রই করে এসে আদরের ভাগ্নিকে হাইজ্যাক করে তুলে নেওয়ার মতো ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। ছোট মামা নিরব বলল,
_তোর যত কষ্টই থাক, আমাদের কাছে তা নস্যি। একবার চল আমাদের বাড়িতে, দেখবি দু মিনিটেই চাঙ্গা হয়ে উঠবি।
এই বলে তারা ভাগ্নিকে গাড়িতে তুললেন। কিছুটা পথ পেরুতেই মামাদের গাড়ির সামনে দিয়ে একজন বড়শি ওয়ালা মাছ নিয়ে যাচ্ছে। পাঁচটা ইয়া বড় বাইন মাছ, একটা রিটে মাছ, দুটো কাউনে মাছ।
বড় মামা গৌরব বললেন,
_ড্রাইভার গাড়ি থামাও। গাড়ি থামলো। মাছ ওয়ালা মানে সকালও থেমে গেল।
সেই কাকভোরে বেচারা বাড়ি থেকে বের হয়েছিল আর এখন বিকেল চারটে। সারাদিনের অভূক্ত মুখখানা রোদে পুড়ে যেন ছাই বর্ণ হয়ে গেছে। তার উপর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি-মোচ! কিছুতেই দেখে মনে হবে না একটা শিক্ষিত ভদ্রজন সে।
_ কিহে; মাছগুলো বিক্রি করবে?
সকাল বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রয়েছে। গাড়ি থেকে অবতরণরত মেয়েটার দিকে। আরে! একি দেখছে সে! একি মানবি নাকি স্বর্গের অপ্সরা? এত রূপ হয় কি করে?
এদিকে মামা বলেই যাচ্ছেন,
_কিহে; মাছগুলো বিক্রি করবে নাকি?
কিন্তু সে প্রশ্নের কোন উত্তর হচ্ছে না।
ছোট মামা নিরব বলল,
_তুমি যাই বল বড় ভাই, এ ছেলে নিশ্চয় বোবা। নইলে প্রশ্ন করেই যাচ্ছ করেই যাচ্ছ অথচ কোন উত্তর নেই।
মেঝ মামা এতক্ষণে সামনাসামনি এসে বলল,
_এই ছোট। শোন, বলি ওভাবে হবে না। তোরা যাই বলিস। বোবারা কি কানে শুনতে পায়? বরং এই দেখ আমি আকার ইঙ্গিত করে ওর কথা নিচ্ছি।
আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা
এদিকে সকাল শুধু সোমত্ত সুন্দরি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার গায়ে যেন রূপ ধরছে না। তার সে রূপ চারদিকে জ্বলন্ত উনুনের খইয়ের মত ছড়িয়ে যাচ্ছে। বেচারা সকাল সেই রুপ গিলেই চলেছে। মেয়েটা লজ্জা পেল। লজ্জায় তার কানের মূল শেকড় পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল।
এদিকে নিরব বলল,
_এই-এ-আ-ই ইত্যাদি শব্দ তুলে বিচিত্র অঙ্গ ভঙ্গিতে প্রকাশ করল মাছ বিক্রি হবে কিনা।
সকাল মুচকি হেঁসে ইশারায় ঠোঁটটা এদিক ওদিক করে এমন ভাব দেখালো যে, ভদ্রলোকদের কাছে মাছের টাকা পুরোটা নেই।
বড় মামা রাগ করে বললেন,
_এই তোমার মাছের দাম পাঁচ হাজার টাকা। দেবে কি?
সকাল মুচকি হেসে বোবাদের মত ইশারায় প্রকাশ করল আরো পাঁচশ লাগবে। বড় মামা সেটাই কবুল করলেন। কিন্তু চার ভায়ের মোট টাকা যোগ করে হল মাত্র চার হাজার দুইশত আঠারো টাকা পঞ্চাশ পয়সা।
সোনালি বলল মামা আমার কাছে পাঁচশ টাকা আছে।
বড় মামা হতাশ হয়ে বললেন,
_তাতেও তো হচ্ছে নারে।
ছোট মামা বলল,
_ও মাছের দাম খুব বেশি হলে চার হাজার টাকা। তুমি বেশি বলে ফেলেছ।
বড়ভাই বিরক্তিতে চোখ পাকিয়ে বললেন,
_চুপ করো। মাছের দোকানে গেছো কোন দিন? গেলে বুঝতে, কিন্তু ও সব কথা থাক। এবার কি করা যায় সেটাই একটু ভাব না? আচ্ছা ছোট একটা কথা ভাবছি বলব? মানে….
ছোট মামা বলল,
_আরে ভাবছো কেন বড় ভাই? বলেই ফেল না।
বড়মামা বোবাটার কাছাকাছি হয়ে হাত পা নেড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বললেন,
_শোন, এই টাকাটা নাও। আর বাদ-বাকি টাকা, গাড়িতে ওঠো বাড়ি থেকে নিয়ে নেবে। আরে ভেব না তোমাকে আরো দুশো টাকা সম্মানিও দেওয়া হবে।
অবশেষে সেটাই হলো। সোনালির মামা বাড়িতে সবাই মাছ দেখে ভীষণ খুশি। হবে না কেন, এ যে বিলুপ্ত প্রায় মাছ। এগুলো বয়স্কদের হারানো বন্ধুর মত। এই পূণর্মিলনের আনন্দ বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের মাছগুলোর প্রতি গলবস্ত্র করে প্রত্যক্ষ করালো।
আরও পড়ুন গল্প স্বপ্ন জল
বাড়ির বৃদ্ধা গৃহণী লাঠিতে ভর দিয়ে সকলের সামনাসামনি এসে বললেন,
_তুমি কিন্তু কটা ভাত খেয়ে যেও বাবা। আহারে! গরীব মানুষ! অভাবের কারণেই এতো ভালো মাছগুলো বিক্রি করছো। খানিকটা বাড়ির জন্যও নিয়ে যেও। আগে একটু নেয়ে নাও বাবা।
ছোট ছেলে বলল,
_মা, ছেলেটা কথা বলতে পারে না। মানে বোবা।
মা আহত কণ্ঠে বললেন,
_বলিস কিরে! আহা এত সুন্দর ছেলে, কথা বলতে পারে না?
তিনি চিৎকার করে বললেন,
_ও বউমারা! ছেলেটাকে যত্ন করে খাইয়ে দিও! তার আগে ওর একটু নাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও দিকিনি।
সোনালি বলল,
_আমি গোসলখানাটা দেখিয়ে দিচ্ছি, চলো।
এরপর সোনালি সকালের একটু কাছাকাছি এসে নাক চেপে একটু পিছিয়ে এসে বলল,
_সারা গায়ে মাছের গন্ধ নানী। সাবান দিয়ে ভালো করে গা রগড়াতে হবে। এই বেচারা বোবা, এসো আমার সঙ্গে।
নানি খুব খুশি হয়ে সোনালিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
_সোনাই আমার লক্ষ্মী বোন। পাগল ছাগলের প্রতি দয়া দেখানো অনেক ভালো কাজ।
বাড়ির ছোট মেয়ে বলল,
_এই সোনা আপু। পাগলকে ভালোবাসা গেলেও কিন্তু ছাগলকে নয়। পাশের বাড়ির ছাগলটা আমার গোলাপ গাছটা মুড়িয়ে খেয়েছে। এবার এলে ওকে জবাই করব।
বড় মামি বললেন,
_এই সোনাই! তোর মামার রেখে দেওয়া লুঙ্গি পাঠিয়ে দিচ্ছি। বেচারা নেয়ে পরবে তো?
সোনালি বোবাটাকে বার বার পিঠে লেগে থাকা কাদা ইশারায় দেখিয়ে দিচ্ছে কিন্তু কিছুতেই সে বেচারা তা বুঝতে পারছে না।
তাই কোন দিশা না পেয়ে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেই হাত লাগিয়ে পিঠটা ঘসে দিল।
এতে একটু মুচকি হাসল বোবাটা।
সোনাই চোখ গরম করে বলল,
_দুষ্টমি হচ্ছে বুঝি?
আরও পড়ুন গল্প কবর
এরপর খাওয়া দাওয়া হলো। বড়মামা টাকা গুনে বোবাটার হাতে দিতে যাচ্ছে, কিন্তু সে কিছুতেই টাকা নিতে চাইল না। বেশি জোর করলে সে কান্নার সুরে এ বাড়ি থেকে না যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছে। আবার একথাও সে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে, তার আপন বলতে এ সংসারে আর কেউ নেই। যদি তারা তাকে আশ্রয় দেন তবে বাড়ির সব কাজ করে দেবে সে।
বাড়ির কর্তী বললেন,
_আহা! ও এখানে থাকতে চাইছে তা থাকুক না। যখন মনে হবে চলে যাবে। তবে এখন আর ওকে তাড়িয়ে দিস নে।
মায়ের আদেশ! বাড়ির কেউ আর দ্বিতীয় কথা বলার সাহস করল না।
ছোট ছেলে বলল,
_ওকে কি বলে ডাকা যায়? একটা নাম তো দরকার-
মা বললেন,
_তাই তো! একটা নাম না হলে চলে?
বড় বউ হাসতে হাসতে সেখানে এসে বলল,
_ভাববেন না মা। আজ রবিবার না? তা ওর নাম রবি হলে কেমন হয়?
সবাই সহসা হাত তালি দিয়ে বলল,
_খুব ভালো! খুব ভালো! এই না হলে বাড়ির বড় বউ।
আরও পড়ুন সোনালী সকাল গল্পের-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সোনালী সকাল (২য় পর্ব)