সোনালী-সকাল-১ম-পর্ব
গল্প,  সাহিত্য

সোনালী সকাল (১ম পর্ব)

সোনালী সকাল (১ম পর্ব)

মোহাম্মাদ শাহ্ আলম

 

ছেলের বাবা বললেন, এক হাতে যৌতুকের টাকা আরেক হাতে ছেলে, নইলে না। মেয়ের বাবা যতোটা অনুনয়ে অনুযোগ প্রকাশ পায়, তার সাধ্য সাধনায় নিজেকে ক্ষুদ্রতম প্রতিপন্ন করে বললেন,
_এতোটা নির্দয় হলে চলে না। ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবুন, এক্ষেত্রে আমার এতটুকু দোষ খুঁজে পাবেন না। হরতালটা এমন অকস্মাৎ ঘটবে কে তা জানতো, বলুন? নইলে মাত্র পঁচিশ লক্ষ টাকা, ব্যাংক থেকে যখন তখন তুলতে পারতাম। কিন্তু এখন তো ব্যাংক বন্ধ। তবে ভাববেন না। আগামিকাল নয়টার মধ্যেই পুরোটা পেমেন্ট পেয়ে যাবেন।
ছেলের বাবা উচ্চ স্বরে হেসে বললেন,
_আমাদের বাংলা ভাষায় একটা কথা আছে ‘আজ না কাল, না দেবার তাল’। তা আমার এতো বেশি কথার প্রয়োজন নাই। আমি সোজা মানুষ, সোজা বুঝি। শৈশব থেকেই আমি বাস্তববাদী লোক। বিশ্বাসের সঙ্গে আমার এতোটুকুও সখ্যতা নেই। বরং বিশ্বাসের হেয়প্রতিপন্ন রূপ, আমি আমার জন্মদাতা পিতৃপুরুষকেও দেখিয়ে দিতে কার্পণ্য করিনি। তাতে অন্য বাবাদের মতো বাবা আমাকে আহ্লাদে ‘চামার’ সম্বোধন যদিও করেননি, তবে পৈতৃক সম্পদ রক্ষায় আমার যোগ্যতাকে মৃত্যুর কিছু পূর্বে, লক্ষ টাকার পালঙ্কের মখমলের চাদরে শুয়ে এক নম্বরে রেখেছিলেন। বাবার পরকালটা আনন্দে কাটুক আমিও চাই। কিন্তু আমি আবার বাকির লোভে নগদ পাওয়া মোটেই ছাড়তে রাজি নই। যাক! আর কথা নয়, এবার টাকা দিন আর বিয়েটাও হোক। কিন্তু দয়া করে আমাকে বিশ্বাস অবিশ্বাসের মধ্যে টানবেন না। আমি জানি, এই বিশ্বাস শব্দটা শেষে অদেখা ঈশ্বর পর্যন্ত টেনে নেবে, সেটা আমার অভিপ্রেত নয়।

আরও পড়ুন একজন অনন্যা

মেয়ের বাবার সব ভাষাই ফুরিয়ে গেল। তবে অন্তরের শেষ জ্বালাটা মেটানোর জন্য তিনি ধরা গলায় বললেন,
_বুঝতে পারলাম। আপনি শুধু নিরসই নন, বরং পাষাণও বটে। ছেলের বাবা কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে বললেন,
_কিন্তু আমার দুঃখটা কি জানেন? এতো বড় বিচক্ষণ জ্ঞানী সমঝদার হয়েও বুঝতে পারলেন না, হাঁড়িতে রস দেবার পরিবর্তে কাঁটা ফোটানোর উদ্দেশ্যে দাঁত খিঁচানো সহজাত ধর্মের পরিপন্থি। আর ও হ্যাঁ, আরো একটা কথা বলেছেন, আমি নাকি পাষাণ! কিন্তু কেন তা হয়েছি তা একবার জানতে চাইবেন না?
মেয়ের বাবা উদগত ক্ষোভ অব্যাহত রেখে বললেন,
_বুঝতে পেরেছি। আপনার ফোকলা মুখে কিছুই আটকাবে না। তবু বলুন না। অপেক্ষা কিসের?
_না, না। বলবো তো অবশ্যই। কারণ সত্য কথা বলতে আমি সংকোচ বা সম্ভ্রমের ধার মোটেই ধারি না। ছেলে আমার ডাক্তারি পাশ দিয়ে বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। ব্যাপারটা সহজে হয়নি। আমার মধ্যে যতোটা রস ছিলো, ছেলেকে পড়াতে নিঃশেষ হয়ে হৃদয় নামের বস্তুটা শুকিয়ে পাষাণই হয়েছে বটে। আর এটা আমার বিশেষভাবে প্রত্যাশিত। একটা কথা বলে রাখি। আমাকে কাঁটা ফোটানোর চেষ্টা করবেন না। কারণ ফলটা কিন্তু ভালো হবে না। আমি আবার জেতার ব্যাপারে বেফাঁস কিছু বলতেও কসুর করি না।
_শুনে খুশি হলাম যে, ভদ্র সমাজের পরিত্যাজ্য উচ্ছিষ্টই আপনার কাছে যথেষ্ট সমাদৃত। বললেন ফল ভালো হবে না! কী করে আর হবে বলুন? গাছের জাতটা যদি বিষের হয়, তার ফলটা আর কি করে অমৃত হয়?
_ঠিক আছে। আর ফল ফল করে বিফল চিন্তায় আমার কাজ নেই। এবার সসম্মানে বেড়িয়ে গেলেই ভালো হয়। ছেলের বাবা উচ্চস্বরে বরযাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলল,
_হে মেন, সবাই চলে এসো। বাবার আদেশকে উপেক্ষা করার দুঃসাহস না দেখিয়ে বরও বরযাত্রীদের সঙ্গে বেড়িয়ে গেল। সবার শেষে ছেলের বাবা গেট পাড় হওয়ার পূর্বে মেয়ের বাবাকে উদ্দেশ্য করে চাপা কণ্ঠে বিদ্রুপের সুরে বলল,
_ফাঁকি দিয়ে আমার ছেলের গলায় মেয়েটাকে ঝুলিয়ে দেওয়ার জোচ্চুরিটা শেষ পর্যন্ত আর সফল হলো না। তাই না?
মেয়ের বাবা দ্বারওয়ানকে চিৎকার করে বললেন,
_গেট বন্ধ করে দাও।

আরও পড়ুন গল্প লালু

সারা গা ভর্তি গহনাপত্র আর মেহেদিরাঙা হাতে একজন স্বামীকে ধরার সাধনা সব গোল্লায় গেল সোনালীর। শুধু এ মূহুর্তে অপার পারিপাট্যে তার লাজলতিকা দেহ বল্লরী দূর্লভ জীবন বল্লভের নিরাশক্তে অর্থহীন হয়ে উঠল। এ সময় তার মনে হলো যে, এই অর্থহীন জীবনটা আর না রাখাই ভালো। তাই সে ক্ষিপ্র গতিতে আসন ত্যাগ করে, ধুপধাপ শব্দ তুলে উপর তলায় উঠতে লাগলো। ব্যাপারটা মিতার আদৌ ভালো লাগে নাই। ওর মনে সন্দেহ জাগল। তাই সে অন্যান্য বান্ধবীদের বলল,
_তোরা একটু বোস। আমি আসছি।
মিতা হালকা পাতলা মেয়ে, সে অতি সহজেই সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠল। ততক্ষণ সোনালী উপর তলার বারান্দার রেলিংয়ের উপর বসে আঁচলটা সেরে নিচ্ছে। এমন সময় মিতা চিৎকার করে বলল,
_এই সোনালী কি করছিস? পাগল হয়েছিস! না,না। আগে নিচে নাম। আত্মহত্যা করতে হবে না। বরং এমন ছেলের চৌদ্দ গোষ্ঠীর মুখে ঝাঁটা মেরে এবার তুই আমার কথা শোন। আমার মেঝভাইকে দেখেছিস কোনোদিন? দেখিসনি তো? তা বেশ। তোকে দেখতে হবে না। আমার কথা বিশ্বাস কর। ওই টিভি সিনেমার শাহরুখ-সালমান খান আরো হাজারটা নায়কের চেহারা এক জায়গায় করলেও আমার মেঝোভাইয়ের চেহারার সমান হবে না। তুই শুধু বল আমার ভাইকে বিয়ে করবি কি না? তিন মাসের মধ্যে ডাক্তারি বিদ্যের বড় ডিগ্রি বিদেশ থেকে নিয়ে আসবে। বিয়েটা হবে বাবা মার অজান্তে। আজই! এখনই। তোদের দেখাশোনা ফুলশয্যা এসব কিচ্ছুটি হবে না। মেঝো ভাইকে আমি এক্ষুণি ফোন করছি দাঁড়া।
মিতা ফোনে বলল,
_মেঝোভাই তুই যেখানে যে অবস্থায়ই থাকিস আমার বান্ধবী সোনালীদের বাড়িতে চলে আয়। ওপর পাশ থেকে মিতার মেজোভাই মানে সকাল বারবার চিৎকার করে বলল,
_হ্যালো মিতা, তুই ঠিক আছিস তো? কিন্তু সে সব কথার একটা বর্ণ অবধিও মিতার কাছে পৌঁছাল না। সোনালী বলল,
_তোর কথায় আমার সাড়ে ষোল আনা বিশ্বাস আছে।
_তা হলে যেখানে বসেছিলি, সেখানেই বসে থাকগে যা।

আরও পড়ুন গল্প রাজামারা

এরপর মিতা সোনালীর বাবার সঙ্গে কথা পাকা করে ফেলল। সকাল মিতাকে বহাল তবিয়তে দেখে বলল,
_সে কিরে এমন সংবাদ কেউ দেয়? পড়ি কি মরি করে ছুটে এসেছি। এবার বল কি খবর?
_একটা জীবন তোকে বাঁচাতে হবে।
সকাল আহম্মকের মত মিতার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে বলল,
_মানে! কি বলছিস? আমার মধ্যে এতোটা কি গুণ দেখলি যে আমি একটা জীবনও বাঁচাতে পারি? তুই ভুল করছিস, অত বড় মহাপুরুষ আমি নই। বরং শিগ্রই বাড়ি ফিরে চল, নইলে বাবা দুটো কানই টেনে ছিঁড়বে। চল চল।
হঠাৎ পাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে বাড়ির বড় বউ মা বলল,
_চল বললেই তো চলে যাওয়া যায় না ভাই। লক্ষ্মী ছেলের মত আমার সঙ্গে এসো। তোমাকে তুমি বললাম এতে কিছু মনে করো না। কারণ বয়সেও একটু ছোট হবে নিশ্চয়ই। আবার নতুন সম্পর্কের সূত্র ধরেও নিশ্চয়ই ছোট। তা আর কথা নয়, এ বেলা আর দাড়ি কামানো নয়, বরং চিরকালীন প্রথা হিসেবে গোসল তো করাতেই হবে।
সকাল কিছু বলার আগেই তার হাত অন্য হাতের কব্জায় চলে গেল। তারপর রাত দশটার সময় তাকে গায়ে সাবান মেখে কয়েকজন মহিলা মিলে গোসল করিয়ে দিল। তারপর ১২টা ২৯ মিনিটে বিয়েটাও হয়ে গেল।
আর চুক্তি অনুসারে বর কনের বিয়ে হলো ঠিকই, কিন্তু কেউ কাউকে চোখের দেখা দেখতে পেল না। সকাল আর মিতা বাড়িতে চলে এলো।

আরও পড়ুন সোনালী সকাল গল্পের-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সোনালী সকাল (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

‘আমাদের সুজানগর’ সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত একটি অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন। সংগঠনটি সুজানগর উপজেলার কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে নিয়মিত ম্যাগাজিন প্রকাশ, বইমেলা ও সৃজনশীল মেধা বিকাশে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন আয়োজন করে আসছে। এছাড়া গুণিজনদের জীবন ও কর্ম নিয়ে ধারাবাহিক লাইভ অনুষ্ঠান ‘অন্তরের কথা’ আয়োজন করে থাকে। ‘আমাদের সুজানগর’ সংগঠনের মুখপত্র হলো ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিন, যা সুজানগরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, গুণিজনদের জীবন সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রচার করে থাকে। এছাড়া সুজানগর উপজেলার কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি প্রকাশ করে থাকে। ওয়েব অ্যাড্রেস: www.amadersujanagar.com মেইল অ্যাড্রেস: editor.amadersujanagar@gmail.com

error: Content is protected !!