সুজানগর-হানাদার-মুক্ত-দিবস
উপজেলার ইতিহাস,  মুক্তিযুদ্ধ,  মুক্তিযুদ্ধে সুজানগর,  সুজানগর উপজেলা

সুজানগর হানাদার মুক্ত দিবস

সুজানগর হানাদার মুক্ত দিবস

 

সুজানগর থানা দখল এবং আমার আহত হওয়া

মো.-জহিরুল-ইসলাম-বিশু
মো. জহিরুল ইসলাম বিশু, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা

১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর। রাতে বকুল ভাই আর ইকবাল ভাই সুজানগর এলেন, সঙ্গে আরো ১৫ জন মুজিব বাহিনী এবং মকবুল হোসেন সন্টুসহ কয়েকজন এফএফ মুক্তিযোদ্ধা। থানা আক্রমণের জন্য আমি আর দুলাল ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসার পর থেকেই পরিকল্পনা করছিলাম। সেই পরিকল্পনার সব বিষয় যেমন, ক’টার সময় আক্রমণ করলে ভালো হবে, বাঙ্কার থেকে শত্রুরা কখন বের হয়, হাতে আঁকা ম্যাপে দেখিয়ে কোথায় কোথায় পজিশন নিতে হবে সব বকুল ভাইকে দেখালাম। সুজানগর থানা এবং তার পাশে সুজানগর হাইস্কুলে তখন অবস্থান করছে রাজাকার ও মিলিশিয়া মিলে প্রায় দু’শত শত্রু। সবকিছু দেখে বকুল ভাই থানা আক্রমণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিলেন।

১০ ডিসেম্বর শুক্রবার আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাত ন’টায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বাড়িতে সমবেত হওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত হলো। বাড়িটি ছিল সুজানগর থানা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত মুক্তিযোদ্ধা মো. সাজেদুর রহমান ছাদেক, পিতা মো. আয়েন উদ্দিন শেখের বাড়িতে। ছাদেকের ছোট চাচা ইসমাইল হোসেনও একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি আর দুলাল দলবল নিয়ে ৯ ডিসেম্বর রাতেই ছাদেকদের বাড়িতে চলে এলাম। দু’জনে বসে থানা আক্রমণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে ফেললাম।

১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ছাদেকদের বাড়িতে সমবেত হতে শুরু করলো। রাত আটটায় বকুল ভাই এসে পৌঁছলেন। রাত ন’টার মধ্যে প্রস্তুত অবস্থায় সেখানে প্রায় তিনশ মুক্তিযোদ্ধা জমায়েত হলো। রাত বারোটার মধ্যে সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ। আমি উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের মোট সাতটি গ্রুপে ভাগ করে দিলাম। সাত গ্রুপের জন্য সাতজন কুরিয়ার আগে থেকেই আমার ঠিক করা ছিল, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের পজিশনের নির্দিষ্ট স্থান দেখিয়ে দেবে। কারণ মুখে বলে দিলে কেউ ভুল স্থানে পজিশন নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারে। তখন থানার পাশে বিভিন্ন পজিশনের অবস্থান সম্বন্ধে আমি যতটুকু জানতাম, আর কারো পক্ষে এসব জানার অবস্থা ছিল না।

আরও পড়ুন নাজিরগঞ্জে পাকবাহিনীর ফেরী ধ্বংস

যুদ্ধের প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন রফিকুল ইসলাম বকুল, সব বিষয়ে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। আমি আর দুলাল, ইকবাল ভাই, সন্টু ভাই, শামছুল রাজ্জাক, নুর এবং সামাদ ভাইয়ের নেতৃত্বে সব মুক্তিযোদ্ধাকে সাত গ্রুপে ভাগ করা হলো। কে কোন পজিশনের দায়িত্বে থাকবে, কোন গ্রুপের কুরিয়ার কে, কীভাবে যুদ্ধ শুরু হবে, পাবনা থেকে সেনাবাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট (Reinforcement) করলে কী করতে হবে, গানবোটে নদী দিয়ে এলে কীভাবে প্রতিহত করতে হবে, আমরা পাশাপাশি দু’দিক থেকে আক্রমণ করবো, অপর দু’দিক খোলা রাখবো, যেন শত্রুরা বের হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। বিস্তারিত সবকিছু আমি প্রায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝিয়ে দিলাম।

রাত একটা থেকে একের পর এক গ্রুপ পাঠানো শুরু হলো। ৫০ জনের একটি গ্রুপ পাঠানো হলো বাজার থেকে একটু দূরে পজিশন নিতে, যাদের কাজ হলো পাবনা থেকে আর্মি এলে তাদের আক্রমণ করা এবং থানা থেকে আর্মি, রাজাকার বা মিলিশিয়া ওদিকে পালানোর চেষ্টা করলে তাদের আক্রমণ করা। ৫০ জনের আরেকটি গ্রুপ চলে গেল থানা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার সাতবাড়িয়া দিকের পজিশনে, তাদের কাজ নদীপথে যদি পাকিস্তানি বাহিনী আসে তাদের প্রতিহত করা। বাকি গ্রুপগুলো তাদের নির্দিষ্ট পজিশনে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আর দুলাল গ্রুপ নিয়ে সব শেষে রওনা দিলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল, অল্প কিছুক্ষণ যুদ্ধের পরই শত্রুরা আত্মসমর্পণ করবে। ওদের পিস্তলগুলো যেন আমি প্রথমেই নিয়ে নিতে পারি, সে জন্য থানার খুব কাছের পজিশন আমি আর দুলাল বেছে নিয়েছিলাম।

আরও পড়ুন  একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলি

ভোর রাতে  আমাদের যুদ্ধ শুরুর সিগন্যাল বোমা বিস্ফোরণ করা, যার দায়িত্ব নিয়েছিল ইকবাল ভাই। সেই বোমা হঠাৎ অসময়ে বিস্ফোরণ হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো তুমুল গোলাগুলি। তখন প্রায় ভোর চারটা, অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর শনিবার। আমার গ্রুপ পজিশনে যাওয়ার আগেই হঠাৎ ইকবাল ভাই বোমা ব্রাস্ট করে যুদ্ধ শুরুর সিগন্যাল দিয়ে দিল। গোলাগুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো সারা এলাকা। চারদিক অন্ধকার, থানার বিল্ডিং ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমাদের দ্রুত অনির্ধারিত স্থানেই পজিশন নিতে হলো। দুঃখে, যুদ্ধের শুরুতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল, কেন যে ইকবাল ভাইকে বোমাটি দিতে গেলাম। শত্রুরা বাঙ্কার থেকে বের হওয়ার পরে যুদ্ধ শুরু হলে খুব বেশি এক ঘণ্টা আমাদের যুদ্ধ করতে হতো, এরপরই শত্রু আত্মসমর্পণ করতো। কিন্তু এখন হয়ে গেল উল্টো, গোলাগুলি চলছে, সময় গড়িয়ে সকাল হয়ে গেল। যত বেলা বেড়ে যাচ্ছে ততই যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে শুরু করলো।

অন্ধকার কেটে যাওয়ার পর দেখি আমি, দুলাল, হাই, তোফা, সামাদ ভাই, কাদেরসহ আমাদের গ্রুপ থানার একটি বাঙ্কারের এত কাছে যে শত্রুর সঙ্গে কথা বলা যায়। বিল্ডিংয়ের ছাদের ওপরে দেয়াল দিয়ে খুব মজবুত করে দুটি বাঙ্কার তৈরি করেছে দু’পাশে। সেখান থেকে আমাদের দিকে তাক করে বারবার গুলি করছে শত্রুরা। আমরা ওদের উদ্দেশে যে গুলি করছি তা গিয়ে বাস্কারের দেয়ালে লাগছে। এতে তেমন কোনো ফল হচ্ছে না। একদিকে নিচে শত্রুর বাঙ্কার আমাদের একদম কাছে, আবার ওপরের বাঙ্কার থেকে গুলি। আমাদের জন্য একটি বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি হয়ে গেল। ওপরের বাঙ্কারে গুলি করতে গেলে ওরা নিচের বাঙ্কার থেকে আমাদের গুলি করতে পারে। আবার নিচের বাঙ্কারে গুলি করতে গেলে ওরা ওপর থেকে গুলি করতে পারে।

এরকম অবস্থায় দুলালের কাছে থাকা একটি এনারগা রাইফেল গ্রেনেড (ছোট্ট রকেটের মতো) নিলাম। আমার এসএলআরের ব্যারেলের সঙ্গে লাগিয়ে (বুলেট ছাড়া গুলি দিয়ে যা এর সঙ্গেই লাগানো থাকে) ফায়ার করলাম কিন্তু ছাদের বাঙ্কারের কাছে পৌঁছলো না, বিল্ডিংয়ের আগেই মাটিতে পড়ে বিকট শব্দে ব্রাস্ট হলো।

আরও পড়ুন  পাবনায় প্রথম শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল

চিন্তা করে দেখলাম এভাবে শত্রুদের এখানে ঘায়েল করা যাবে না। আরসিএলগান ব্যবহার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ এই গানের রেঞ্জ এক হাজার গজ, এটা দিয়ে আগে ওপরের দুটি বাঙ্কার ভেঙে ফেলি। সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে পজিশনে থাকতে বলে, আমি আর দুলাল গানটি আনতে চলে গেলাম। যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি এক বাড়িতে হেলালের দায়িত্বে ছিল ওই গান এবং গানের পাঁচটি শেল। গোলাগুলির মধ্যে ত্রুলিং করে বেশ কিছুদূর গিয়ে নিরাপদ স্থানে উঠে দাঁড়ালাম। একজন যোদ্ধাকে ডেকে হেলালকে দ্রুত আরসিএলগানটি নিয়ে আসার জন্য খবর দিতে বললাম। দেখলাম গ্রামগঞ্জের লোকজন প্রচুর রুটি, খিচুড়িসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে এসেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।

আমাকে দেখে ইকবাল ভাই আর সন্টু ভাই এগিয়ে এলেন। আমি ইকবাল ভাইকে জিগ্যেস করলাম, আপনি রাতেই বোমা বিস্ফোরণ ঘটালেন কেন? আপনাকে বলেছিলাম ফজরের নামাজের আজান দেয়ার পরে শত্রুরা বাঙ্কার থেকে বের হবে, তখন বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে। ইকবাল ভাই বললেন, আমাকে একজন বললো এটা হাতে তৈরি বোমা ঠিকমতো ফুটবে না। আমি পরীক্ষা করার জন্য যেই ছুঁড়েছি অমনি ব্রাস্ট হয়ে গেল।

আমি, ইকবাল ভাই, সন্টু ভাই এবং দুলাল দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছি তখন আমি ছিলাম একটি আমগাছের পাশে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ কয়েকটি গুলির শব্দ কানে আসতেই কী মনে করে ডাইভ দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছি। অন্যেরা দাঁড়িয়েই আছে। শত্রুর নিক্ষেপ করা একটি গুলি আমগাছে এসে গেঁথে গেল। সবাই মিলে দেখলাম আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক সেখানেই আমার বুক সোজা গুলি গিয়ে গাছে গেঁথে গেছে। কী আশ্চর্য ব্যাপার, কেনইবা আমি ডাইভ দিয়ে মাটিতে লাইং পজিশনে চলে গেলাম আর সবাই দাঁড়িয়ে থাকলো। আবার গুলি লাগবে তো লাগলো আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানেই। একমাত্র আল্লাহতায়ালার অসীম দয়া ছাড়া ওই ঘটনায় আমার বাঁচার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।

আরও পড়ুন বীর প্রতীক আজিজুর রহমান

ইতোমধ্যে একজন দৌড়ে এসে খবর দিল, নূরুল ইসলাম নূর মাথায় গুলি লেগে শহীদ হয়েছে। নূরের পাশেই ছিল অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু এবং হাবিব, ওরা একটুর জন্য বেঁচে গেছে (নূরের মরদেহ একটি বাঙ্কারের খুব কাছে ছিল, ১৩ তারিখ গভীর রাতে পিন্টু আর হাবিব গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃতদেহ সেখান থেকে নিয়ে আসে)। সুজানগর যুদ্ধের প্রথম শহীদ নূর। খবরটি শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। ইতোমধ্যে হেলাল গানটি নিয়ে এলো। ইকবাল ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আরসিএলগান আর তিনটি শেল নিয়ে আমি দুলালসহ আরো কয়েকজন যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের পজিশনের দিকে রওনা দিলাম।

চারদিকে তুমুল গোলাগুলি হচ্ছে, হেঁটে চলাফেরা একদম নিরাপদ মনে হচ্ছে না। যে কোনো সময় শত্রুর গুলি এসে লেগে যেতে পারে। আমি আর দুলাল হেলালের কাছ থেকে গান এবং শেলগুলো নিয়ে থানার ছাদের ওপরের দুটি পাকা বাঙ্কার ভাঙার জন্য আমাদের পূর্বের পজিশনে যেতে চাইলাম কিন্তু গোলাগুলির মধ্যে সেখানে যাওয়া আর সম্ভব হলো না। একটি বাড়ির পাকা মেঝের (ডোয়া) পাশে আরসিএলগানটি সেট করলাম। এখান থেকে ছাদের ওপরের শুধু একটি বাঙ্কার দেখা যাচ্ছে। দুলাল রাইফেল তাক করে খেয়াল রাখছে শত্রুর কোনো বাঙ্কার থেকে আমাদের দিকে কেউ লক্ষ্য করছে কিনা। এদিকে আমি কামানের টার্গেট ঠিক করে ফায়ার করতেই বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে গেল সমস্ত এলাকা।

ওই বাঙ্কারের বেশকিছু অংশ উড়ে গেল, বান্ধার থেকে গুলির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম শুধু বাঙ্কার ভাঙেনি এর ভেতরে যারা ছিল তারাও মারা গেছে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে হঠাৎ এধরনের কামানের গোলার বিকট শব্দে শত্রুরা যেন ভয় পেয়ে গেল। ওই বাঙ্কার থেকে গুলি বন্ধ হলেও অন্যান্য স্থান থেকে তুমুলভাবে গোলাগুলি শুরু করলো তারা।

আরও পড়ুন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ গোলাম সারোয়ার খান সাধন

এখন বাকি রইলো আরেকটি বাঙ্কার। কিন্তু এখান থেকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। এদিকে সরে এসে আমি আর দুলাল আগের পজিশনের প্রায় কাছাকাছি স্থানে একটি ঘরের দেয়ালের পাশে গানটি সেট করলাম। আরসিএলগানের ব্যারেলের ওপর মাথা রেখে বাইনোকুলার দিয়ে দোতলার বাঙ্কারে টার্গেট ঠিক করলাম। এই গানের সামনের দিকে একটি এবং পেছনের দিকে দুটি স্ট্যান্ড (পায়া) আছে, যার ওপর গানটি মাটি থেকে উঁচুতে থাকে। ট্রিগার হাতের ডান দিকে, এক ফুট লম্বা হয়ে শেষ মাথায়।  ফায়ারের নিয়ম হলো, গানের ওপর মাথা রেখে এর সঙ্গে সংযুক্ত বাইনোকুলার দিয়ে দেখে নিচের সামনের স্ট্যান্ডের হুইল ঘুরিয়ে টার্গেট ঠিক করতে হয়। অত্যন্ত শক্তিশালী দেড় ফুট লম্বা বাইনোকুলারের মধ্যে বিভিন্ন হিসাবের চিহ্ন দেয়া আছে যা দিয়ে দূরত্ব নির্ণয় এবং সুনির্দিষ্ট টার্গেট ঠিক করা সম্ভব হয়। টার্গেট ঠিক করে ডানদিকের ট্রিগারে হাত দিয়ে চাপ দিলেই ফায়ার হয়ে যায়।

ফায়ারের সময় এ গানের শেলের বারুদ শেলটিকে সামনে নিক্ষেপ করে দিয়ে এর ফ্রেম গানের পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। যার ফলে এ গান ফায়ারের সময় কোনো ধাক্কা দেয়ার ক্ষমতা থাকে না। ৩০ কেজি ওজনের আরসিএলগানটি সাত ফুট লম্বা, এর ব্যারেল চার ইঞ্চি ডায়ামিটার এবং পেছনের চেম্বার আট ইঞ্চি ডায়ামিটার। প্রতিটি শেলের ওজন পাঁচ কেজি। ফায়ারের সময় অত্যন্ত শক্তিশালী ফ্রেম বের হওয়ার কারণে এর পেছনে ৮০ ফুটের মধ্যে কেউ থাকলে তার মৃত্যু হতে পারে। তাই খুব চিন্তা করে পজিশন নিতে হয় এবং ফায়ার করতে হয়।

ছাদের ওপরের বাঙ্কারে গানের টার্গেট যখন ঠিক হয়ে গেছে হঠাৎ তখনই আমার চোখ পড়েছে নিচের বাঙ্কারে। দেখি নিচের ওই বাঙ্কার থেকে এক শত্রু আমার দিকে রাইফেল তাক করেছে। আমি তাড়াতাড়ি দেয়ালের আড়ালে সরে গেলাম। দুলালকে বললাম, তুই দেয়ালের ওই পাশে গিয়ে নিচের বাঙ্কার কন্ট্রোল কর, আমি সুযোগ বুঝে ফায়ার করে দেবো। দুলাল আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে সেই আগের পজিশনে চলে গেল। তখন ১১ ডিসেম্বর শনিবার সকাল ঠিক সাড়ে দশটা।

আরও পড়ুন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড প্রসাদ রায়

এখন গান ফায়ার করতে হলে আমাকে মাথা বের করে গানের ওপরে রেখে ফায়ার করতে হবে। কিন্তু এটা করতে গেলে নিচের বাঙ্কার থেকে আমার মাথায় গুলি করে দিতে পারে। একটু অপেক্ষা করে চিন্তা করলাম টার্গেট তো ঠিকই আছে, দেয়ালের আড়াল থেকে মাথা বের না করে শুধু হাত বের করে ট্রিগার টিপে দিই। চিন্তা করার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত আমার ডান হাত বের করে ট্রিগার টিপে দিলাম। দোতলার বাঙ্কারের বেশ কিছু অংশ ভেঙে উড়ে গেল, দু’জন শত্রু দেয়ালের ভাঙা অংশসহ নিচে মাটিতে পড়ে গেল। অবস্থা দেখে মুক্তিযোদ্ধারা স্লোগান শুরু করে দিল। অন্যান্য বাঙ্কার থেকে শত্রুরাও আমাদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করলো।

এদিকে আমি যখন দেয়ালের পাশ থেকে হাত বের করে আরসিএলগানটি ফায়ার করেছি, ঠিক একই সময় নিচের বাঙ্কার থেকে গুলি এসে কখন যে আমার ডান হাতের বাহুতে লেগে গেছে প্রথমে আমি তা বুঝতে পারিনি। ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ দেখি আমার ডান হাত খুব জোরে কাঁপছে। দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে হাতের দিকে তাকিয়েই দেখি জামার হাতার কিছু অংশ ছিঁড়ে গেছে। এর কয়েক সেকেন্ড পরে দেখি রক্তে আমার জামাকাপড় সব ভিজে যাচ্ছে। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা, অসহায় এক অনুভূতি। চারদিকে চরম গোলাগুলির শব্দের মধ্যে আমি চিৎকার করে দুলালকে বললাম, আমার হাতে গুলি লেগে গেছে। তুমুল গোলাগুলির মধ্যে কারো পক্ষে এগিয়ে এসে সাহায্য করা তখন সম্ভব হচ্ছে না।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এখান থেকে সরে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া দরকার। কারণ যেভাবে রক্ত ঝরছে তাতে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকা যাবে না। যাতে বেশি রক্তক্ষরণ হতে না পারে সেজন্য আমার মাজায় থাকা গামছা দিয়ে তাড়াতাড়ি হাতের ক্ষতস্থানে কোনোরকমে পেঁচিয়ে নিলাম। দেয়াল থেকে একটু দূরেই ছিল একটি ছোট্ট গর্ত, আমার এসএলআরটি এক হাত দিয়ে বুকের সঙ্গে ধরে গড়িয়ে তার মধ্যে চলে গেলাম। সেখানে পড়েই দেখি বরই গাছের ডালপালা, কাঁটায় আমার শরীরের আরো কয়েক স্থানে কেটে রক্ত বের হতে শুরু করলো। সেখান থেকে অনেক কষ্ট করে উঠে গড়িয়ে গড়িয়ে আরো কিছুদূরে চলে গেলাম।

আরও পড়ুন বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু

ইতোমধ্যে মোটর শ্রমিক নেতা রজব আলী চাচা এগিয়ে এসে আমাকে ধরে তুললেন। চাচার স্বাস্থ্য ছিল খুব ভালো, আমাকে একাই কাঁধে করে সেখান থেকে নিয়ে দৌড়ে চলে এলেন নিরাপদ স্থানে একটি বাড়িতে। সেখানে যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার জন্য আমাদের নির্দিষ্ট ডাক্তার ছিল। ডাক্তার সাহেব আমার হাতে ব্যান্ডেজ করে কিছু ওষুধ দিলেন। এরপর যেই এটিএস ইনজেকশন দিয়েছেন মুহূর্তে সৃষ্টি হলো আরেক সমস্যা। আমার সারা শরীরে ঢাকা ঢাকা হয়ে ফুলে উঠলো অর্থাৎ ওষুধের রি-অ্যাকশন। এর কারণ হলো, ট্রেনিংয়ের সময় ভারত থেকেই আমাদের দু’বছরের জন্য টিটিনাস কোর্স দেয়া ছিল, সে কথা ডাক্তার সাহেবকে বলতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় ভীষণ দুর্বল মনে হচ্ছে নিজেকে। চুপচাপ শুয়ে আছি আর চিন্তা করছি, ভাগ্যিস মাথা বের করে ফায়ার করতে যাইনি তাহলে এতক্ষণে ওদের গুলিটি আমার মাথা ছিদ্র করে আমাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতো। নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যুদ্ধের খবর নিতে পারছি না। গুলির শব্দ কানে আসছে কিন্তু কেউ এসে যুদ্ধের অবস্থার কোনো খবর দিচ্ছে না। বড় অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। বারবার দুলালের কথা মনে পড়ছে।

বিকেল তিনটার দিকে বকুল ভাই এলেন আমাকে দেখতে। আরেকটি গভীর দুঃখজনক খবর জানালেন। আমি আহত হওয়ার কিছুক্ষণ পর বেলা বারোটায় ‘দুলাল’ শহীদ হয়েছে। আমি যে পজিশনে ওকে রেখে এসেছিলাম সেখানেই শত্রুর একটি গুলি তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এ ঘটনা আমার জন্য কত শোকাবহ ছিল যা লেখার ভাষা জানা নেই। শুধু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নয়, চরম বিপদের দিনে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এর পরদিন আবু বক্কার, ছাত্তার শহীদ হয় এবং আবু সাইদসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। আবু সাইদের এমনভাবে গুলি লেগেছিল যে, মুখের এপাশ দিয়ে বুলেট ঢুকে ওপাশ দিয়ে বের হয়ে ওর চোখ দুটি চিরদিনের মতো অন্ধ করে দিয়েছে। দুলালের মরদেহ শত্রুর বাঙ্কারের খুব কাছে পড়ে থাকায় তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। ১২ তারিখ গভীর রাতে দুলালের মরদেহ সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়।

আরও পড়ুন সম্মুখ সমরের প্লাটুন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিফা আশরাফ

১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বকুল ভাই এসে বললেন, ১৪ তারিখ সকালে পাবনা শহর আক্রমণের জন্য দ্বীপচরে আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের জমায়েত হওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া আছে। এখন তিনি যদি সেখানে না যান তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। যেহেতু সুজানগর দখল করতে আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে সেহেতু পাবনা শহর আক্রমণের তারিখ পিছিয়ে দিতে হবে। আমাকে সাহস দিয়ে বললেন, তুমি চিন্তা করো না, আমি ফিরে এসেই তোমাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। বকুল ভাই ১২ ডিসেম্বর সুজানগর থেকে দ্বীপচরে চলে যান। সেখানে সব মুক্তিযোদ্ধাকে জমায়েত হয়ে প্রস্তুত থাকতে বলে আসেন, যেন সুজানগর থানা দখলের পরই আমরা পাবনা শহর দখলের জন্য আক্রমণ করতে পারি। পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে ১৪ তারিখ বেলা বারোটায় বকুল ভাই আবার সুজানগরে ফিরে এলেন।

এদিকে ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী থানার মধ্যে যারা জীবিত ছিল তারা বিক্ষিপ্তভাবে পালিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোরে সুজানগর থানা শত্রুমুক্ত হলো। বকুল ভাই এসে ইকবাল ভাইয়ের ওপর থানার দায়িত্ব দিলেন। সকলকে বলে দিলেন, ইকবাল ভাইয়ের সঙ্গে কিছু মুক্তিযোদ্ধা থাকবে, আর বাকি সবাইকে ১৫ তারিখ সকালের মধ্যে পাবনা শহর আক্রমণের জন্য দ্বীপচরে চলে আসতে হবে।

সুজানগর থানা মুক্ত হয়ে গেল, দুলাল পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল, আমি আহত হয়ে গেলাম। শেষ হলো আমার মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের আগে আমি সুজানগরে যাইনি। আমার কোনো আত্মীয়-স্বজনও সেখানে নেই । সম্পূর্ণ একটি অপরিচিত জায়গা। অথচ মুক্তিযুদ্ধের কয়েক মাস কাটিয়ে আমার এখন মনে হয় জন্ম জন্মান্তরের এক সম্পর্ক যেন সুজানগরের মাটির সঙ্গে। সুজানগরের মাটি আর মানুষের স্মৃতি আমার আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে। তাদের সাথে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, গুলিতে আহত হয়ে রক্ত দিয়েছি, তাদের বাড়িতে থেকেছি, খেয়েছি, ঘুমিয়েছি। আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় দিনগুলোর ইতিহাস থেকে সুজানগরকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। সুজানগরের মানুষের দিকে তাকালে আমার মা-বাবা, ভাইবোনদের প্রতিকৃতি মনে হয়। জীবনে যতদিন বেঁচে থাকবো সুজানগরের সেই স্মৃতি কোনোদিন ভুলতে পারবো না।

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সুজানগর হানাদার মুক্ত দিবস

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী মো. আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ সাহিত্য সংকলনের সম্পাদক এবং ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ সালের ১৫ জুন, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!