সময়ের পাচঁফোড়ন
সময়ের পাচঁফোড়ন
রাতুল হাসান জয়
ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকারেও আয়েরা দুটো চোখ দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট। শক্ত করে সে দু চোখের মালিক তার চুল আর গলা চেপে ধরেছে। আয়েরা চিৎকার করতে চাইছে, কিন্তু চিৎকারের চেষ্টা এখানে ধোপে টিকবে না। ভয় যেন তার কন্ঠ শীতল করে দিয়েছে। ভয়ংকর দু চোখের এক আগন্তুক এ ভয়ের কারণ। চোখের সামনে চিৎকার করে কান্নার কারণ থাকলেও আয়েরা যেন নিথর এক বোবা চরিত্র হয়ে দরজার সাথে লেপ্টে আছে।
ষোলশহর স্টেশন, রাত সাড়ে আটটা। রাস্তার পাশে ফেলে রাখা পিলারের স্তুপে বসে আছে দুজন। কিছুক্ষণ আগেই হর্ণ দিয়ে চবি’র উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছে শাটল ট্রেন। স্টেশন প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। আধখাওয়া সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে রেললাইন ধরে হাঁটা শুরু করলো দুজন। কিছুদূর সামনেই বামপাশে চায়ের দোকান। গুঁটিকয়েক লোক সেখানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মান্নার সিনেমা দেখছে টিভিতে; ডায়ালগ চলছে মান্নার “এই বাস্টার্ড….”
দোকানটা পাশ কাটিয়ে পাশ কাটিয়ে দুজন ঢুকে গেল সরু গলিটায়। সেদিকে কারো কোন ভ্রক্ষেপ নাই। আর কেনই বা করবে ভ্রুক্ষেপ। পথ মানেই মানুষ হাটবে। কিন্তু মফস্বল এলাকায় অপরিচিত কাউকে দেখলে মানুষ কৌতূহলী হয় বৈকি। আজ নায়ক মান্না সব কৌতূহল কেড়ে নিয়েছে।
আরও পড়ুন গল্প সোনালী
গলি বেয়ে পাহাড়ে উঠে এসে পিঠের ব্যাগ খুলে চেক করে নিলো দুজনের একজন। শীতের রাত, ফরেস্ট এরিয়া। তার ওপর অমাবস্যার রাত। অন্ধকার গ্রাস করেছে চারপাশ। শব্দহীন পদক্ষেপে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো সামনের একতলা বাড়ির দিকে। তাদের কাছে পাক্কা খবর আছে আলী নামের লোক এ বাড়িতে একা আছে। চারপাশ ভালোমতো দেখে চুপিসারে ঢুকে গেলো বাড়ির ভেতর। তারপর নিঃশব্দে ভিজিয়ে রাখা দরজা ঠেলে ভেতরে চলে এলো। সোফায় বসে টিভি দেখছে টার্গেট। ধীরপায়ে এগিয়ে যায় একজন। অপরজন নজর রাখছে দরজায়। দুজন দুজনের দিকে চোখাচোখি করে একটা মুচকি হাসি বিনিময় করে নিলো মাত্র। কোন প্রকার শব্দ ছাড়াই পেছন থেকে গিয়ে এক হাতে মুখ চেপে ধরে অন্য হাতে থাকা চাকু বসিয়ে দিলো গলায়। চোখের পলকে যেন ঘটে গেল সব। ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত ঝাপসা করে দিচ্ছে টিভির স্ক্রিন, গলা কাটা মুরগির মতো লাফাতে লাফাতে নিস্তেজ হয়ে গেলো একটু আগেই জীবিত থাকা টার্গেট।
বেশ কয়েকদিন থেকেই আয়েরা নিজের ভিতরে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট করানোর পর তার সে পরিবর্তন আতঙ্কে পরিণত হয়। কখনো কখনো সুসংবাদ রাজ্যের ভয় আর বিপদ নিয়ে আসে। এ সংবাদটাও ঠিক তেমনই; আয়েরা টেস্ট পজিটিভ। তারপরও সে এক সপ্তাহ কাউকে কিছু না বলেই নিজের মাঝে চেপে রেখেছে এই খবর। আজ সন্ধ্যায় তার বাবা আমির হামজা থাকবে না। তাই আয়েরা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে আলীকে সব খুলে বলবে। বলবে বিয়ে করে নিতে। আয়েরার বাবা এসব জেনে গেলে নির্ঘাত খুন করে ফেলবে দু’জনকেই। মেনে নেওয়ার কোন প্রশ্নই আসেনা। তার কাছে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আর সম্মানই সব।
আরও পড়ুন গল্প কথোপকথন
সন্ধ্যায় আমির হামজা গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যেতেই আয়েরা বের হয়ে আসে বাড়ি থেকে। তার বিশ্বাস আলী এসব জেনে ফিরিয়ে দিবে না কখনোই। আয়েরা আর আলীদের বাড়ির দূরুত্ব খুব বেশি না পায়ে হাঁটা পনেরো মিনিট। সময় কম। তাই আয়েরা বাসা থেকে বেরিয়েই রিক্সা করে পাহাড়টার গোড়া অব্দি চলে আসে। গন্তব্য আলীর বাড়ি। বিদ্যুৎ চলে গেল হঠাৎ। তাই আলীর বাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। এক মিটার দূরের কাউকেও দেখা যায় না। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই গা’য়ে কাঁটা দিলো আয়েরার, মেডিকেল স্টুডেন্ট আয়েরার নাকে কেমন যেন একটা লিকুইডের গন্ধ ভেসে আসে, খুব পরিচিত এক গন্ধ! আলীকে ফোন করেছিলো আয়েরা বেশ কয়েকবার। কোন উত্তর না পেয়ে সোজা তাই বাড়িতে চলে আসা। ঘরের দরজা খুলতেই এক ঝটকায় কাছে টেনে গলা চেপে ধরে আগন্তুক।
– হ্যালো স্যার, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।
– কেমন ঝামেলা?
– কাজ শেষ করে বের হবো, দেখি একটা মেয়ে এসে হাজির।
– সে কোথায়?
– আফজাল এর কব্জায়। কি করবো বলেন?
– রাজনীতিতে কয়েকটা লাশের ওপর দিয়েই যদি না হাটলাম, সে ক্যারিয়ারকে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বলি কী করে!
– বুঝেছি স্যার।
তারপর অনেকক্ষণ ফোন কানের কাছে রেখে ফোনের ও পাশের ব্যাক্তির নির্দেশ শুনে নিলো হন্তারক। ফোন রেখেই আফজাল এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সোহেল । চোখের ঈঙ্গিত সিলিংফ্যানের দিকে। আফজাল মেয়েটার বুক থেকে ওড়না টেনে ছুঁড়ে দিলো সোহেলের হাতে। ততক্ষণে এক হাতে চুল ছেড়ে চেপে ধরেছে মেয়েটার মুখ। সোহেল সিলিংফ্যানে শক্ত করে বেঁধে নিলো ওড়নাটা। আয়েরার গলা টিপে ধরলো আফজাল। স্বচ্ছ মার্বেলের মতো আয়েরার দুটো চোখ যেন বেরিয়ে আগন্তুকের হাতে এসে ধরা দেবে, এমন ভাব। একদম নিঃশব্দে নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর। অন্ধকার জেঁকে বসছে চোখে। গলা ছেড়ে দিতেই ধপ করে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো শরীর। এবার গলায় ওড়না বেঁধে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে খোলা প্রকৃতিতে বেরিয়ে আসে দুজন।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
– স্যার শেষ!
– তার ল্যাপটপ, ক্যামেরা?
– স্যার, ব্যাগে।
– গুড, যত দ্রুত সম্ভব এলাকা ছেড়ে দাও। তোমাদের একাউন্টে পৌঁছে যাবে বাকীটা।
আগন্তুকের বিদায়ে যেন বিজয়ের হাসি নেতার মুখে। বিরবির করে বলে ওঠে,
‘কুত্তার বাচ্চার সাহস কত আমার এমপি হওয়া ঠেকাইবো’
ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। আমির হামজা বাড়ি ফিরেছে ভোরের আলোর সাথে সাথে।
আয়েরা, আয়েরা অনেকক্ষণ ডাকছে তার বাবা। কোন সাড়া না পেয়ে নিচে চলে আসে। হয়তো ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক! চা হাতে মেয়ের মা এসে জানালো, রাতে ইন্টার্ন ডিউটি ছিলো হসপিটালে। যাবার আগে বলে গেছে আসতে দেরী হবে।
আমির হামজা চা’য়ে চুমুক দিয়ে পত্রিকায় চোখ বুলালেন। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো।
– হুম কালাম বলো।
– স্যার টিভিতে নিউজ দেখছেন?
– না, কেন?
– দেখেন স্যার তাড়াতাড়ি।
আমির হামজা ফোন কানে নিয়ে মুচকি হাসছে। সে ভাবছে, আলীর খুন হওয়ার নিউজের বিষয়ে জানাতে চাইছে কালাম। কিন্তু সে নিজেই তো এর মূল হোতা।
টিভি অন করে নিউজ চ্যানেল আনতেই ধপ করে কান থেকে ফোন ফ্লোরে পড়ে ডিসপ্লে মাকড়সার জালের মতো হয় যায়।
হেডলাইনে ভাসছে, ‘নিজ ঘরে খুন সাংবাদিক আলী। সিলিং এ গর্ভবতী মেয়ের ঝুলন্ত লাশ!’
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সময়ের পাচঁফোড়ন