শূন্যতা
গল্প,  শফিক নহোর (গল্প),  সাহিত্য

শূন্যতা ।। ছোটোগল্প ।। শফিক নহোর

শূন্যতা

শফিক নহোর

সীমান্তের মনে আজও গেঁথে আছে সেই প্রথম দেখা—এক অস্থির মেঘবৃষ্টির দুপুরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার দিনে। সুতি, এক দৃষ্টিতে আকর্ষণ করবার মতো মেয়ে, তার চোখে ছিল উদ্‌বেগের ছাপ। নতুন ক্যাম্পাস, চারপাশের বিশৃঙ্খলা—সব মিলিয়ে একটু বিভ্রান্তই লাগছিল তাকে। ঠিক তখনই সীমান্ত পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
“তুমি নতুন?”
সুতি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ, হলে ভর্তি হব, কিন্তু কীভাবে কী করতে হবে বুঝতে পারছি না।”
সীমান্ত হেসে বলল,
“চলো, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”
সেদিন থেকেই বন্ধুত্বের শুরু। সীমান্ত আর সুতি দিনে দিনে একে অপরের ছায়া হয়ে উঠল। সীমান্ত পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটোখাটো কাজ করত, আর সেখান থেকেই কিছু টাকা বাঁচিয়ে সুতির জন্য বই, কোচিংয়ের ফি, ছোটোখাটো প্রয়োজন মেটাতো। সুতি প্রথমদিকে দ্বিধায় থাকলেও, সীমান্তের আন্তরিকতায় ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। এগুলো মূলত কিছুই না; বন্ধু তার বন্ধুর জন্য এটুকু করতেই পারে।

আরও পড়ুন লালু

বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছর কেটে গেল, তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হলো। সীমান্ত ভেবেছিল, তারা একসঙ্গে জীবনের পথে এগিয়ে যাবে। মানুষের জীবনে প্রতিটি মূর্হুতে স্বপ্ন পরিবর্তন হতে পারে; হয়ও ঠিক তাই। চলমান মানুষের স্বপ্ন যেকোনো সময় মানুষের মনের চাহিদা ভিন্ন রং ধারণ করতে পারে।

সুতি সেনাবাহিনীতে যোগ দিলো। তার স্বপ্ন পূরণ হলো, সে একসময় অফিসার হয়ে উঠল। এই সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে সে যেন একটু একটু করে বদলে যেতে লাগল। যেমন করে মাচায় পুঁইশাক বাড়তে থাকে।
সীমান্ত চাকরি খুঁজছিল, ততদিনে তার নিজস্ব জীবনেও নানা চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে। একদিন সীমান্ত সুতিকে বলল, “তুমি তো এখন প্রতিষ্ঠিত, আমরা কি এবার আমাদের সম্পর্কের কথা পরিবারের কাছে বলতে পারি?”

সুতি তখন সীমান্তের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “দেখো, আমাদের সামাজিক পার্থক্য বিশাল। আমার বাবা-মা এটা মেনে নিবে না। আমি এখন একজন অফিসার, তুমি সাধারণ ঘরের ছেলে, সবে মাত্র চাকরি খুঁজছে। আমরা কি সত্যিই মানিয়ে নিতে পারব?”
সীমান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। যে মেয়েটাকে সে এতদিন নিজের সব কিছু দিয়ে ভালোবেসেছিল, সে কি আজ এই কথাগুলো বলছে?

আরও পড়ুন একটি মিষ্টি স্বপ্ন

সীমান্ত কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সে বুঝতে পারল, কিছু সম্পর্কের শেষ হয় এভাবেই—নীরবে, অপ্রত্যাশিতভাবে। সীমান্ত কথা না বাড়িয়ে দ্রুত প্রস্থান করল, তার চোখে মুখে ফুটে উঠল যুদ্ধবিধ্বস্ত নাবিকের মুখাবয়ব। পকেট থেকে তার দেওয়া রুমাল দিয়ে চোখের অপ্রতিরোধ্য জল মুছে বের হয়ে গেল।

সুতি তার নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। অফিসের সহকর্মী রেজার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকল। তারা দুজনই উচ্চাকাঙ্ক্ষী, দুজনেরই লক্ষ্য অনেক দূর। একসময় তারা বিয়ে করল।
বিয়ের প্রথম কয়েক বছর ভালোই চলল। দুজনেই ব্যস্ত থাকত, কিন্তু একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকলেও সেখানে ভালোবাসা ও বিশ্বাস ছিল খুবই নগণ্য। ধীরে ধীরে তাদের ভেতরে দূরত্ব তৈরি হতে লাগল।
একদিন রেজা বলল,
“তুমি কি কখনো সময় পাবে আমাদের জন্য?”
সুতি বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি নিজেও তো সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকো!”
এই দূরত্ব ধীরে ধীরে আরও বড়ো হতে থাকল। তাদের সুখের সংসারে অনল প্রবাহিত হতে লাগল। দুজন দুজনের সামাজিক মর্যাদাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কেউ কারো কাছে নত স্বীকার হতে রাজি নয়। ভেতরে ভেতরে তাদের দুজনের অহংকারে পুড়ে ছাই হয়েছে সুখের সংসার; দুজনের কেউ টের পায়নি হয়তো। জলে বরফ ভাসলেও ডুবে থাকে তার বেশি।

আরও পড়ুন আড়ালের চোখ

তিন বছর পর তাদের একটি মেয়ে হলো—স্নেহা। কিন্তু সন্তানের আগমনে সম্পর্কের উন্নতি হলো না, বরং আরও খারাপ হলো। দুজনের মধ্যকার দাম্পত্যকলহ বাড়তে থাকল।
একদিন রেজা বলল,
“আমি বিদেশে চলে যাচ্ছি, এখানে থেকে লাভ নেই। আমাদের সম্পর্কটা আর আগের মতো নেই।”
সুতি কিছু বলল না, শুধু দেখল তার স্বামী চলে যাচ্ছে।
এত সাফল্যের পরও সে কি সত্যিই সুখী?

নিঃসঙ্গ রাতগুলো সুতিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। সে একদিন হঠাৎ মনে করল সীমান্তের কথা। সেই মানুষটা, যে একসময় তার জন্য সব কিছু করেছিল, যে সত্যিই তাকে ভালোবাসতো।
সে খুঁজতে শুরু করল সীমান্তকে। অনেক খোঁজার পর একদিন তার ঠিকানা পেল।
এক সন্ধ্যায় সুতি সীমান্তের দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ল।
দরজা খুলল সীমান্ত। চুলে পাক ধরেছে, কিন্তু চোখের গভীরতা এখনো আগের মতোই।
সুতি ধীরে ধীরে বলল, “কেমন আছ?”
সীমান্ত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “ভালো, তুমি?”

সুতি এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
“আমি ভালো নেই, সীমান্ত। আমি বুঝতে পারিনি, কত বড়ো ভুল করেছিলাম। আমি তোমাকে খুঁজছিলাম, তোমার কাছে ফিরে আসতে চেয়েছিলাম।”
সীমান্ত হাসল। কিন্তু সে হাসিতে কোনো উষ্ণতা ছিল না।
“জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না, সুতি। আমি এখন অন্য কারও স্বামী, অন্য কারও বাবা। আমি তোমার অতীত।”
অতীতকে ভুলে যেতে হয়; না-হলে দুঃখ পেতে হয় তার চেয়ে অধিক। তুমি সরকারি বড়ো অফিসার, টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি সবকিছুই আছে। এখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোমাদের বিদেশ ভ্রমণ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অতি আনন্দিতময় ছবি দেখি, তোমরা তো সুখি। তোমাদের কোনোকিছুর অভাব নেই। শুধু শুধু আমার মতো নগণ্য একজন মানুষের কথা মনে রাখতে গেলে কেন?
আমি হয়তো তোমাকে কিছুই দিতে পারব না। বরং কখনো বুঝি স্বার্থপরের মতো কিছু চেয়ে বসতে পারি।

সুতির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। এত বছর পর ফিরে আসার পরও কি সে সীমান্তকে আর ফিরে পাবে না?
মনে মনে সে সীমান্তকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল। তার ভেতরে দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা; তাকে জড়িয়ে ধরে একটু কান্না করতে পারলে হয়তো তার বুকের ভেতরের পাথর অদৃশ্য হয়ে যেত। অবহেলায় মানুষ যা দূরে ঠেলে দেয় একদিন হয়তো তার জন্যই ভেতরে ভেতরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে তাকে পাবার জন্য।
সীমান্ত ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে দিলো।

সুতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, অনুভব করল এক ভয়ংকর শূন্যতা, চাইলেই সবকিছু নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া যায় না। দূর থেকে অনেক কিছুই সুন্দর মনে হলেও কাছে এলে কেমন ফ্যাকাশে, ফিন ফিনে সুতি। চাইলেই দেশের বাহিরে স্বামীর সঙ্গে সুখের ঠিকানা গড়ে তুলতে পারে। কিছু শূন্যতা থাকা মানুষের জন্য ভালো জীবনকে পরিপূর্ণ উপলব্ধি করা যায়।
সুতি তার ডিভোর্স লেটারে লিখেছিল,
‘‘তোমাকে মন থেকে চাইনি, মোহ থেকে চেয়েছিলাম।
জীবনে এই শূন্যতাটুকু আমাকে আরও শক্তিশালী করবে বলেই এককিত্বের পথে স্বেচ্ছায় পা বাড়িয়ে দিলাম। মেয়েকে নিয়ে ভালো থেকো। ‘’

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

শূন্যতা শূন্যতা

Facebook Comments Box

শফিক নহোর মূলত একজন গল্পকার। এছাড়া তিনি প্রতিনিয়ত অণুগল্প, ছোট গল্প ও কবিতা লিখে চলছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: মায়াকুসুম, বিষফুল, কসুর; কাব্যগ্রন্থ: মিনুফুল তিনি ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নওয়াগ্রামের শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!