শাস্ত্রীয়-সঙ্গীতশিল্পী-চিন্ময়-লাহিড়ী
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  তাঁতিবন্দ (গ্রাম),  তাঁতিবন্ধ,  সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী চিন্ময় লাহিড়ী

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী চিন্ময় লাহিড়ী (২০ মার্চ, ১৯২০-১৭ আগস্ট, ১৯৮৪ খ্রি.) একজন স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী। তিনি বিভিন্ন রাগে ঠুমরি, দাদরা, হোলি, ত্রিবট, চতুরঙ্গ, গীত, ভজন, গজল সহ বাংলা রাগপ্রধান সঙ্গীতের স্রষ্টা ছিলেন।

জন্ম: চিন্ময় লাহিড়ীর জন্ম ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে মার্চ পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার তাঁতিবন্দ ইউনিয়নের তাঁতিবন্দ গ্রামের জমিদার পরিবারে। 

পরিবারের-সাথে-চিন্ময়-লাহিড়ী
পরিবারের সাথে চিন্ময় লাহিড়ী

পারিবারিক জীবন: পিতা জীবনচন্দ্র লাহিড়ী পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী, কর্মসূত্রে  লক্ষৌতে থাকতেন। মাতা সরোজবাসিনী দেবী। শৈশবে চিন্ময়ের আগ্রহ ছিল শরীরচর্চায় ও সঙ্গীতসাধনায়।

শিক্ষা জীবন: পড়াশোনা লক্ষৌয়ের বয়েজ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্কুলে। রবীন চট্টোপাধ্যায়ের নিকট তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয়। লক্ষ্ণৌয়ের মরিস কলেজ অব মিউজিকে তিনি সঙ্গীত বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। কলেজের অধ্যক্ষ পন্ডিত রতন ঝঙ্কারের নিকটও তিনি সঙ্গীতে তালিম নেন। পরবর্তীকালে দিলীপ বেদী, খুরশীদ আলী খাঁ, ছোটে খাঁ প্রমুখ ওস্তাদের নিকট তিনি সঙ্গীতে পাঠ গ্রহণ করেন।

সঙ্গীত জীবন:  মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি তাঁর তেরো বৎসর বয়সে সঙ্গীতচর্চাই শুরু করেন। ভাইয়ের মনোবাসনা পূরণ করতে তাঁর দাদা নিয়ে গেলেন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সেতার শিল্পী ধ্রুবতারা জোশীর কাছে। তিনি আবার নিয়ে যান ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত মরিস কলেজ অব মিউজিক এর (বর্তমানে ভাতখণ্ডে মিউজিক ইনস্টিটিউট ডিমড ইউনিভার্সিটি) তৎকালীন অধ্যক্ষ পণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতন ঝংকারজির কাছে। তিনি জেদি ও আত্মবিশ্বাসী চিন্ময়ের আগ্রহ দেখে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন এবং চিন্ময়ও নিজের শ্রমে ও যথাযথ তালিমের গুণে অচিরেই পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

আরও পড়ুন লোকসাহিত্য বিশারদ মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন

বিখ্যাত ওস্তাদের কাছে সংগীতের তালিম নিলেও নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি নিজস্ব ঘরণার অজস্র রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে গিয়েছেন।

সঙ্গীত পরিবেশনার সময় মন এবং মস্তিষ্কের সঠিক মেলবন্ধনে বিশ্বাস করতেন চিন্ময় লাহিড়ী (মাঝখানে)
সঙ্গীত পরিবেশনার সময় মন এবং মস্তিষ্কের সঠিক মেলবন্ধনে বিশ্বাস করতেন চিন্ময় লাহিড়ী (মাঝখানে)

তাঁর গানে শাস্ত্রীয় আঙ্গিকের সঙ্গে মধুর রস ও আত্মনিবেদনের সংমিশ্রণ ঘটে ছিল। তাঁর রাগ রাগিনীর মধ্যে কয়েকটি হলো শ্যামকোষ, যোগমায়া, প্রভাতী টোড়ি, সন্ত ভৈঁরো, কুসুম কল্যাণ ইত্যাদি। তাঁর অসামান্য সৃষ্টি “নন্দকোষ” ভারতের সংগীতবিদগ্ধ সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এক সঙ্গীত সম্মেলনে “নন্দকোষ” পরিবেশনের সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ওস্তাদআলাউদ্দিন খাঁ সাহেব ও ওস্তাদ হাফিজ আলি খাঁ অভিভূত হয়ে পড়েন এবং দুজনেই অনুষ্ঠান শেষে তাঁর কাছ থেকে রাগের বন্দিশ সংগ্রহ করেন। 

সঙ্গীত জগতে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চিন্ময় লাহিড়ী সাঙ্গীতিক বংশপরম্পরা ছিল না। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি কোনো সাঙ্গীতিক পরম্পরা লাভ করেননি; একান্তই নিজের আগ্রহ, উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফলে তিনি বাংলা তথা ভারতের সঙ্গীত জগতে খ্যাতিমান হন।

তিনি রাগকণ্ঠসঙ্গীতে যশস্বী হলেও  খেয়াল গানেও প্রসিদ্ধি অর্জন করেন।

কর্ম জীবন: ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও বর্তমানে আকাশবাণী কেন্দ্রের সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন চিন্ময় লাহিড়ী। সেখান থেকে এসে তিনি ঢাকা রেডিওতে যোগদান করেন। পরে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে চলে যান কলকাতায়। কলকাতা বেতারের সঙ্গেও তিনি বেশ কিছুকাল জড়িত ছিলেন। গ্রামোফোন কোম্পানিতেও তিনি কিছুকাল প্রশিক্ষকের কাজ করেন। জীবনের শেষ কয় বছর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। সংগীত শিক্ষক হিসাবে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। একজন শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতগুণীর যেসব গুণ থাকা দরকার, তাঁর মধ্যে তা বর্তমান ছিল। সরগম-এর কাজে তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তিনি একাধারে শিল্পী, স্রষ্টা ও শিক্ষক ছিলেন।

আরও পড়ুন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে এইচএমভি থেকে ‘না মানে মানা’ ও ‘দুয়ারে এলো কে’— এই দুটি খেয়াল গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। চিন্ময় লাহিড়ী “মগন” ছদ্মনামে বিভিন্ন রাগের বন্দিশ রচনা করেছেন। লক্ষৌতে থাকার ফলে তার হিন্দি ও উর্দু ভাষার উপর বিশেষ দখল ছিল। এছাড়া তিনি বিভিন্ন রাগে ঠুমরি, দাদরা, হোলি, ত্রিবট, চতুরঙ্গ, গীত, ভজন, গজল, বাংলা রাগপ্রধান সৃষ্টি করে গিয়েছেন এবং স্বরলিপির আকারে উপস্থাপন করে গেছেন। 

১৯৫২ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে সঙ্গীত পরিবেশন করে তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

চলচ্চিত্র: চিন্ময় লাহিড়ী চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও কাজ করেছেন। চলচ্চিত্রে প্রথম পেব্যাকের কাজ করেন ‘মানদণ্ড’ ছায়াছবিতে। কয়েকটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা ও কণ্ঠদান করেছেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে “শাপমোচন” ছবিতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পটদীপ’ রাগে দ্বৈতকণ্ঠে গাইলেন “ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান” বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। 

প্রকাশনা: সঙ্গীত বিষয়ে তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে মগনগীত ও তানমঞ্জরী নামে স্বরলিপির গ্রন্থটি কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত। এর মধ্যে চারটি খন্ড প্রকাশিত হয়েছে।

অবদান: যার মধ্যে একটু প্রতিভা বা সম্ভাবনা দেখেছেন, তাকে উৎসাহিত করেছেন এবং প্রাণভরে শিখিয়েছেন। 

ফলস্বরূপ বাংলার সঙ্গীত জগত পেয়েছে মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বেগম পারভিন সুলতানা, শিপ্রা বসু প্রমুখ স্বনামধন্য শিল্পী। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর পুত্র শ্যামল লাহিড়ী ও পুত্রবধূ মন্দিরা লাহিড়ী কলকাতায় তাঁর ছদ্মনাম ‘মগন’ নিয়ে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে গঠন করেছেন এক সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘মগন মন্দির’।

সম্মাননা: লক্ষৌয়ের মরিস কলেজ অব মিউজিক তাঁকে “সঙ্গীতবিশারদ” উপাধিতে ভূষিত করে। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে পুর কর্তৃপক্ষ তাঁর বসতবাড়ি সংলগ্ন রাস্তাটির নাম পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ী সরণী রেখেছেন।

মৃত্যু: চিন্ময় লাহিড়ী ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই আগস্ট কলকাতায় প্রয়াত হন।

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী চিন্ময় লাহিড়ী

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!