শানশি লাইব্রেরি ও মোরগ ডাক
শানশি লাইব্রেরি ও মোরগ ডাক
২৫ জুন ছিল আরেকটা অনলাইন কর্মসূচি। ভার্চুয়ালি শানশি প্রদেশ পররাষ্ট্র দপ্তরের লাইব্রেরি পরিদর্শন। যথারীতি কর্মসূচিটি টেনসেন্ট অ্যাপসে হয়। টেনসেন্ট জুমের মতোই চীনাদের নিজস্ব অ্যাপস। মোবাইলের মাধ্যমে এদিনও জয়েন করতে গিয়ে বেশ ঝক্কিতে পড়তে হল। আরও দু’একজনও একই সমস্যায় পড়ে। তবে পরে বুঝতে পারলাম ভুলটা আমাদেরই। ভিপিএন চালু রাখায় টেনসেন্টে জয়েন করা যাচ্ছে না। ভিপিএন বন্ধ করতে সহজেই টেনসেন্টে জয়েন করা সম্ভব হল। উইচ্যাটের সিএপিপিসি গ্রুপে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করায় অন্যরাও দ্রুত জয়েন করতে সক্ষম হন। অর্থাৎ তারাও ভিপিএন চালু রেখে চেষ্টা করায় এতোক্ষণ জয়েন করতে পারে নাই। ভিপিএন চালু রাখলে চীনা যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা অ্যাপসগুলোতে ঢুকতে গেলে সমস্যা হয়। আগের দিনের মতো এদিনও একজন লাইব্রেরি সম্পর্কে, এর খুটিনাটি বিষয়ে কথা বলছেন।
তবে ভদ্রমহিলা মান্দারিনে বলছেন আর তার সাথে একজন ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন যাতে আমরা বুঝতে পারি। ভার্চুয়ালি দেখলেও লাইব্রেরির ভেতরটা দেখে মন ভরে গেল। ঝকঝকে পরিস্কার। মনে হচ্ছে চারদিকে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে। কয়েকতলা বিশিষ্ট লাইব্রেরিটির সব ফ্লোরের একই অবস্থা। লাইব্রেরিটিতে আধুনিক বই-পুস্তকসহ নানা জিনিস স্থান লাভ করেছে। পাশাপাশি পুরোনো ঐতিহ্যবাহী অনেক জিনিসপত্র, পুরাকীর্তি, লেখা, বই, স্যুভেনির নানান কর্নারে সাজিয়ে রাখা। চীনের প্রাচীন বইপত্রের সংরক্ষণাগার বলা যায় একে। আছে সুং, মিং, হাংসহ বিভিন্ন শাসনামলের লেখা। সেসব লেখা আবার প্রিন্ট করে বই আকারে রাখা হয়েছে। প্রাচীণ চীনের বর্ণমালাগুলোও এই লাইব্রেরিতে রয়েছে। অর্থাৎ লাইব্রেরিটিকে একটা জীবন্ত ইতিহাস বললেও বেশি বলা হবে না।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে
যে কেউ এই লাইব্রেরিতে ঢুকলে যেন চীনের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বর্তমান অবস্থা, শাসন ব্যবস্থা সব জানতে পারে সেই ব্যবস্থা আছে লাইব্রেরিটিতে। এক লাইব্রেরিই সবকিছু জানার জন্য যথেষ্ট। নি:সন্দেহে বলা যায় পড়ুয়ারা এই লাইব্রেরিতে ঢুকলে আর বেরুতে চাইবে না। অন্তত জ্ঞানতাপস ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মত পড়তে পড়তে সময় কোনদিক দিয়ে চলে যবে তা বুঝতে পারবে না।
অনেকের কাছে বিদেশি একটা লাইব্রেরির মত বিষয় নিয়ে লেখা তুচ্ছ জ্ঞান হতে পারে। হলেও তাতে কোন আপত্তি নেই। এখানে এ বিষয়ে লেখার অবতারণা করার একটাই কারণ। তা হল তুলনামুলক বিচার। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা লাইব্রেরি আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন খুব বেশি না হলেও বার কয়েক যাওয়া পড়েছে। বার কয়েক বললাম এ কারণে যে আমি খুব পড়ুয়া ছাত্র ছিলাম না। অর্থাৎ একাডেমিক পড়ুয়া। তবে অন্যান্য বইপত্র পড়ার অভ্যাস আছে। যাইহোক, সেসময় দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটির বেহাল দশা। ভেতরে ঢুকতেই কেমন একটা গুমোট গন্ধ এসে নাকে লাগতো। যাদের ধুলোবালি বা পুরোনো বইপত্রের গন্ধে অ্যালার্জি আছে তারা হয়তো প্রবেশই করতে পারবে না। প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব তো ছিলই। দেখা যেত যে বইয়ের জন্য গেছি সেই বই-ই নাই।
আবার এমনও হয়েছে যে বই আছে কিন্তু সংশ্লিষ্ট পাতা নেই। এখনকার অবস্থা জানি না। হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে, আধুনিক হয়েছে। দেশের বেশিরভাগ লাইব্রেরি তথা গণগ্রন্থাগারের একইরকম তথৈবচ অবস্থা। অথচ সরকারি লাইব্রেরিগুলোর জন্য প্রতিবছর বেশ ভাল বাজেট দেয়া হয়। নতুন বই কেনা, রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য। নিজের দু’চারটা বই প্রকাশ হওয়ার কারণে এ খাতের খবর একটু আধটু জানি। টেন্ডারের মাধ্যমে যেসব বই কেনা হয় সেগুলোর বেশিরভাগই গুণাগুণের বিচারে নয় সুপারিশের ভিত্তিতে কেনা হয়। বইয়ের লেখনির মানের চেয়ে বিচার হয় লেখক কোন পন্থী, কোন মতাদর্শের। যাক, এ বিষয়ে আর কথা না বলাই ভালো। তারচেয়ে বরং কুনমিংয়ে মোরগের ডাক নিয়ে কথা বলি।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী ঘুরে এলাম পর্তুগাল
মাঝে মাঝে প্রভাতের দিকে ঘুম ভেঙে যায়। চেষ্টা করেও যখন ঘুম আসে না তখন এপাশ ওপাশ করি। কারণ সূর্য ওঠার তখনও অনেক বাকী। বাইরে শুনশান নিরবতা। কোন শব্দ নেই। আশপাশের সুউচ্চ ভবনের বাইরের আলো অথবা ল্যামপোস্টের মৃদু আলো পূর্ব পাশের কাঁচের দেয়াল ও পাতলা স্বচ্ছ সাদা পর্দা ভেদ করে রুমে পড়ে। হঠাৎ একদিন মনে হল কোথাও যেন মোরগ ডাকছে। একেবারে অবিকল মোরগের ডাক কুকরু…কু…কুক। আমি ভাবি বোধহয় ভুল শুনছি। কুনমিং একটা আধুনিক শহর এখানে মোরগের ডাক আসবে কোথা থেকে। কিন্তু না আরও কয়েকদিন এরকম ডাক শুনলাম। একদিন এরকম সময়ে ঘুম ভাঙার পর সিদ্ধান্ত নিলাম বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভাল করে শোনার চেষ্টা করব। এদিনও আওয়াজ আসতে লাগলো কুকরু…কু…কুক।
গ্রামে বেড়ে ওঠায় এ ডাকের সাথে আমার বহু পুরোনো পরিচিতি। এটা আসলেই মোরগের ডাক। কতদিন পর যে, মোরগের এমন সুরেলা ডাক শুনছি তা বলতে পারব না। মোরগের এমন ডাক আমাকে নষ্টালজিক করে তুললো। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে মোরগ-মুরগী পালন হত। এদের মধ্যে একটা থাকতো বিশাল টয়াযুক্ত লাল মোরগ। সেই দলনেতা বা সর্দার। মোরগ-মুরগীর জন্য আলাদা ঘর থাকতো। মা এবং কাজের লোক এদের যত্নআত্মি করতেন। সেসময় ব্রয়লার-লেয়ার-সোনালী-রুপালী কোনকিছুর খবর ছিল না। ছোটবেলায় বাবার কড়া শাসনের কারণে আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ ভালভাবেই মানতে হত। সেকারণে প্রভাতে বা খুব ভোরবেলায় দেখতাম বড় মোরগটা এমন কুরুরু…কু… কুক করে ডাকে। তার সাথে সাথে অন্যান্য মোরগও ডাকাডাকি করে। এমনকি মোরগের এমন সুর করে দীর্ঘক্ষণ ডাকাডাকির কারণেই বাড়ির সবার বিশেষ করে বাবা-মা এবং কাজের লোকদের ঘুম ভাঙতো। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির অবস্থা ছিল এমন। মোরগের ডাক শুনলে সবাই বুঝতে পারতো ভোর হয়েছে।
আরও পড়ুন দুলাইয়ের জমিদার আজিম চৌধুরী
কিন্তু দু:খের বিষয় হল বাড়িতে কোন আত্মীয়স্বজন আসলে সেই সুরেলা কণ্ঠের বড় মোরগটাকেই আগে জবাই দেয়া হত। বড় মোরগটির জবাইয়ের সময় মন খারাপ হয়ে যেতো। মনে একটা দু:খভাব চলে আসতো। কিন্তু সেই খারাপ লাগা বা দু:খবোধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারতো না। খাওয়ার সময় মা যখন টয়াসহ অন্যান্য পছন্দনীয় মাংস দিতেন তখন সব দু:খ ভুলে যেতাম। মাংসের স্বাদ আস্বাদনে দু:খের কথা মনে হওয়া তো দুরের কথা তখন মনে হত আত্মীয়-স্বজন প্রতিদিন আসুক, মোরগ জবাই হোক আর আমাদের খাওয়ার ধুম পড়ুক। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসলে সত্যিই একটা উৎসব উৎসব ভাব পড়ে যেত। আমরাও খুশী হতাম শুধু খাওয়া দাওয়া নয়, পড়াশোনাও সেকদিন তেমন একটা করতে হত না সেই কারণে। আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মা-বাবাও আমাদের পড়াশোনার দিকে খুব একটা মনোযোগ দিতে পারতেন না। মাংস, পিঠা-পুলি, পায়েস খাওয়া আর আনন্দ ফুর্তিতেই কেটে যেত কয়েকটাদিন।
সে যাকগে, আবার মোরগের কথায় ফিরে আসি। এখন গ্রামে গেলে দেশি মোরগ-মুরগী পালন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে বোধহয় দেশি মোরগ-মুরগী পালন হয় না। পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে খামারে পালন করা ব্রয়লার-লেয়ারসহ অন্যান্য জাতের মোরগ-মুরগী। তাই বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো মোরগের ডাক শুনে অভ্যস্থ নয়। কুনমিংয়ের মোরগের ডাক বহুদিন পর মনে করিয়ে দিল ছোটবেলার সেই স্মৃতি। এখানে আমাদের ছোটবেলার মত ঘর করে দেশীয় জাতের মোরগ-মুরগী চাষ হয় কিনা কে জানে? নাকি আশপাশের পাহাড়ের বুনো মোরগের ডাক?
আরও পড়ুন চীনের ডায়েরি-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
শানশি লাইব্রেরি ও মোরগ ডাক