রাজামারা
কে এম আশরাফুল ইসলাম (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

রাজামারা

রাজামারা

কে এম আশরাফুল ইসলাম

 

কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত গ্রামটি প্রকৃতির অবারিত সবুজ লীলা দিয়ে নকশীকাঁথার মত বুনন দিয়ে  জমিনকে সৌন্দর্যে লীলায়িত করেছে। ধান আর বিভিন্ন সবজির সমারোহ গ্রামটিকে আরও অপরূপে সজ্জিত করেছে। যেন মায়ার চাদরে ঘিরে রেখেছে। যতদূর যায় আঁখি অক্লান্তে মুগ্ধ হয়ে সব অবলোকন করে তৃপ্ত হই। আষাঢ় মাস। মেঘলা আকাশ। কখন যেন অঝর ধারায় বৃষ্টি পরে।  

মেঠো পথ। প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে যাতায়াতে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়! ১৯৯৪ সাল। জয়নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রক্সি ক্লাস নেই। থাকি আমার পিতৃতুল্য শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শহিদুল্লাহ স্যারের বাড়িতে। শহিদুল্লাহ স্যার উক্ত বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক।  তাঁর পিতা-মাতা আমাকে খুব আদর করেন। দাদি কাছে বসে অনেক গল্প বলেন। স্যারের বাড়ি ফেনুয়া গ্রামে। পাহাড় ঘেঁষা ফেনুয়া গ্রামটি আমার কাছে অতি চমৎকার লাগে। পাহাড় যেন আমাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকে। বিকেলে সময় পেলেই একাকি হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের নিকট চলে যাই। পাহাড় থেকে বয়ে আসা ঝর্ণার স্বচ্ছ পানি  হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে শিহরিত হই। গরমে ঝর্ণার শীতল পানি আলাদা আমেজে আপ্লুত করে। পাহাড়ের পাশে এবং উপরে ছোট ছোট ঘর বেঁধে কিছু মানুষ বসবাস করে। দৃশ্যপট আমার মনপ্রাণ কেড়ে নেয়। 

থেমে থেমে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। কর্দমাক্ত পিচ্ছিল রাস্তা। অযাচিত বৃষ্টির ঝামেলা থেকে রক্ষার জন্য রাস্তার পাশে অবস্থিত একটা মাদ্রাসার বারান্দায় সাইকেলটা নিয়ে আশ্রয় নিলাম। কিছু ছাগল শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে। মাদ্রাসা চত্বরে গরুগুলো ভিজে ভিজে ঘাস খাচ্ছে। সেখানে এক ব্যাক্তি এলেন। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, তার নিজ বাড়ি ঐ গ্রামেই। গ্রামের নাম জানতে চাইলাম। বললেন,

_রাজামারা।

লোকটি মনে হলো আমার সাথে কথা বলে বেশ তৃপ্তি পাচ্ছেন। বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

_গ্রামের নাম ‘রাজামারা’ হওয়ার কারণ কী?

আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

লোকটি বলতে শুরু করলেন।

_এখানে অতীতকালে একজন রাজা ছিলেন। বেশিরভাগ জমির তিনিই মালিক ছিলেন। তাঁর আদেশই ছিল আইন। তাঁর খেয়াল খুশিই প্রজাদের ওপর প্রয়োগ করা হতো। তাঁর ছিল কিছু ধামাধরা লোক। তাদের কাজ ছিল রাজার ইচ্ছা মাফিক আদেশ নিষেধ কার্যকর করা। যথা চিন্তা তথা আদেশ। তিনি খুব অত্যাচারী ছিলেন। প্রজাদেরকে তিনি দাস মনে করতেন। প্রজাদের কষ্ট দিতেন। জমিতে উৎপাদিত ফসলের সিংহভাগ তিনি জোড় করে আদায় করতেন। এমনকি পূজা পার্বণেও অন্য ধর্মের লোকদের থেকে চাঁদা নিতে দ্বিধা করতেন না।

বৃষ্টির বেগতিক অবস্থা। যেন হাল ছেড়ে অঝর ধারায় নামছে। মনে হচ্ছে প্রয়াত অত্যাচারী রাজার অমানবিক কাহিনী শুনে আকাশ কেঁদে কেঁদে অত্যাচারিতদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে। আমি মাঝে মাঝে লোকটির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করছি। লোকটির চোখ ভেজা দেখা যায়।

_ভাই, মনে হয় আপনার পূর্ব পুরুষদের কেউ এই অত্যাচারী রাজার দ্বারা জুলুমের শিকার হয়েছিলেন?

তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। বাকরুদ্ধ অবস্থা। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে তিনি বলতে শুরু করেন।

_জি, আমার দাদার দাদা এই অত্যাচারী রাজার অত্যাচারে ইহলোক ত্যাগ করেন।

আরও পড়ুন গল্প লালু

তার কথা শুনে মনে খুব কষ্ট পেলাম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসে। সমব্যথি বৃষ্টি থামছে না। আমি মনোযোগী শ্রোতা। অগত্য একটা বেঞ্চ টেনে দুজনে বসলাম। তিনি আবার শুরু করলেন। 

_রাজার অভিলাষ একটা দিঘী কাটবেন। দিঘীটা থাকবে বাড়ির পিছনে। রাজপরিবারের নারীরা সে দিঘীতে স্নান করবে। নৌকা বিহার করবে। দেব-দেবি জলাঞ্জলি দেবে। শ্রমিক ডাকা হলো। দিঘী কাটার উদ্বোধনী করলেন। দিনের পর দিন কাজ চলতে থাকে। রাজা মাঝে মাঝে দেখতে যান। শ্রমিকদের মনে বিরক্তি আর তীব্র অসন্তোষ। তারা নিরুপায় হয়ে কাজ করে। নচেৎ কপালে জোটে অবর্ণনীয় চাবুকের আঘাত। কেউ হয় পঙ্গু। কাউকে বিদায় নিতে হয় এ ধরাধাম থেকে। পেটের দায়ে অত্যাচার সয়ে সয়ে আধা মজুরিতে তাদের কাজ করতে হয়। প্রত্যেকের মনে চাপা ক্ষোভ। প্রতিশোধের তীব্র স্পৃহা। তারা শলাপরামর্শ করে কীভাবে জালিমকে শায়েস্তা করা যায়। একশ শ্রমিক কাজ করছে। রাজা কয়েক দিন কাজ দেখতে আসেন না। অগোছালোভাবে কাজ চলছে। আকস্মিকভাবে রাজা কাজ দেখতে আসেন। কাজের অবস্থা দেখে রাজা রাগে অগ্নিশর্মা। 

_এই ছোটলোকের বাচ্চারা, তোরা এ কী কাজ করছিস?

_হুজুর কী করতে হবে? শ্রমিক সর্দার রাগত স্বরে জিগায়।

_শালারা ন্যাকামি করতাছোস। সব শালারে আজ সাইজ করব। কোনো শালাই আর নিস্তার পাবি না।

ওদিকে প্রায় সব শ্রমিকের মাথায় মাটি ভর্তি ঝাঁকা। পিঁপড়ের সারির মতো পরিকল্পিতভাবে সজ্জিত। আজ রাজা মশায় তোমারও নিস্তার নেই!

রাজার জীবনের অন্তিম গালিগালাজ ওরা মুখ বুজে সহ্য করে। রাজা দিঘীর মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায়। শ্রমিকগণ ধীর পায়ে তাঁর দিকে এগুতে থাকে। রাজার কাছে এসে দাঁড়ায়।

_হুজুর কোথায় মাটি ফেলাব?

_শালারা, আমার মাথার ওপরে ফেলা।

রাজার বলতে দেরি হয়, ওদের হুকুম তালিম করতে বিলম্ব হয় না। অতি দ্রুত শতাধিক ঝাঁকা মাটি রাজাকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করে দেয়। মুহুর্মুহু মাটি পড়তে থাকে। সমাপ্তি ঘটে অন্যতম এক অত্যাচারী রাজার দম্ভ। আর সেই থেকে এই গ্রামের নাম হয় রাজামারা! 

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

রাজামারা

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!