মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান
মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান
সদালাপী এবং জীবনবাদী কথাশিল্পী মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান। তিনি কবি, কথাশিল্পী ও গবেষক হিসেবে সমাজে সমধিক পরিচিত। বর্তমানে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) এর পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) হিসেবে কর্মরত আছেন।
জন্ম: পদ্মার পলিমাটি বিধৌত শ্যামল বাংলার প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠা মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের গুপিনপুর গ্রামের সন্তান। সম্ভান্ত মুসলিম প্রামাণিক পরিবারে ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি-তে তাঁর জন্ম।
পারিবারিক জীবন: পিতা মহির উদ্দিন প্রামানিক ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা (শহীদ), মাতা মরহুমা হাজেরা খাতুন। ছয় ভাই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। পিতামহ কফিল উদ্দিন প্রামাণিক ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
স্ত্রী জাফরিন আক্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি, সুইডেন থেকে আইসিটিতে ডিপ্লোমা এবং এমফিল শেষ করে কলেজে অধ্যাপনা করেন। মেয়ে নাহিয়ান নাওয়ার অন্তিকা, ভিকারুনেসা স্কুল ও কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। ছেলে আবরার জাহিন অহং এবং মাহির জাহিদ উচ্ছ্বাস, গভমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের ৭ম শ্রেণীর ছাত্র।
আরও পড়ুন এম আকবর আলী
শিক্ষাজীবন: মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান সাতবাড়ীয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর মালিফা হাবিবর রহমান বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সাতবাড়ীয়া মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাশ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স অব বিজিনেস স্টাডিজ ডিগ্রী লাভ করেন। সুইডেন থেকে “ICT for Pedagogical Development” বিষয়ে ডিপ্লোমা, থাইল্যাণ্ড, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এছাড়াও মালয়েশিয়ার University of Nottingham থেকে Policy Makers এবং অস্ট্রেলিয়ার Curtin University থেকে Action Research for SDGs Localisation in Bangladesh কোর্স সম্পন্ন করে শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর অবদান রাখছেন।
কর্মজীবন: মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান ছাত্রজীবনে ‘সাপ্তাহিক বঙ্গ বিচিত্রা’র জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল পরিচিত ‘সংবাদপত্র পাঠক ফোরাম’ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন শেষে তিনি কলেজে অধ্যাপনার মধ্যদিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রণালয়ে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) এর সহকারি পরিচালক (ফিন্যান্স) হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। বর্তমানে নায়েম এর পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।
তথ্যজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে জাতীয় পরিকল্পনা একাডেমি, ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুল, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, বিয়াম, আরপিএটিসি, ওয়াল্ড ভিশন এবং ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কলেজে অধিবেশন পরিচালনা করে থাকেন তিনি।
আরও পড়ুন সরদার জয়েনউদ্দীন
সামাজিক কর্মকাণ্ড: মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থেকেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন সমিতি, পাবনা সমিতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাকাউন্টিং এলামনাই এ্যসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, লাইফ একাডেমি এলামনাই এসোসিয়েশন, সুইডেন এর জীবন সদস্য। এছাড়া বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব, বাংলা একাডেমি, পাবনা উন্নয়ন ফোরাম, পাবনা ডেভেলোপমেন্ট ফাউন্ডেশন এবং চেয়ারম্যান, শহিদ মহির উদ্দিন ফাউন্ডেশন-সহ বেশ কয়েকটি সামাজিক ও পেশাগত সংগঠনে যুক্ত থেকে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছেন।
প্রকাশনা: ৮টি গবেষণা, দেশী-বিদেশী পত্রিকা ও জার্নাল, প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল ও গ্রন্থে ৫৪টি প্রকাশনা রয়েছে। দাদার ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদা, চারিত্রিকগুণাবলী শিশুকাল থেকেই লেখকের মনে স্বপ্ন জাগে চেয়ারম্যান হওয়ার। তিনি লিখেন প্রথম জনপ্রিয় উপন্যাস ‘চেয়ারম্যান হবো’।
উপন্যাস:
- চেয়ারম্যান হবো (২০১৫ খ্রি.)
- ভোরের কুহেলিকা (২০১৭ খ্রি.)
কাব্যগ্রন্থ:
- নষ্ট ভালোবাসা (২০১৮ খ্রি.)
গল্পগ্রন্থ:
- সিডরের সেই রাত এবং তারপর..(২০২০ খ্রি.)
গবেষণা গ্রন্থ:
- বাংলা সাহিত্য ও বঙ্গবন্ধু (২০২০ খ্রি.)
ভ্রমণকাহিনী:
- নোবেলের দেশে শান্তির দেশে (২০২২ খ্রি.)
ভ্রমণ প্রিয় লেখক ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, কাতার, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও তুরস্ক ভ্রমণ করেছেন। এতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটেছে। যা তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে।
আরও পড়ুন কবি ও কথাসাহিত্যিক খলিফা আশরাফ
সাহিত্য মূল্যায়ন: বর্তমানে মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান তাঁর কর্মের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। তাঁর প্রকাশিত লেখাগুলো পাঠক মহলে সমাদৃত ও জনপ্রিয়। লেখালেখি তাঁর পেশা না হলেও নেশা। এ নেশায় তিনি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো নিয়ে মেতে থাকেন নিমগ্নতার মধ্যেই। যেখানে লেখকের নিবিড় সান্নিধ্যতার শিল্পরূপ স্নিগ্ধ ক্যানভাসে আলোকিত হয়। লেখকের অপরিমেয় দিব্য চক্ষু সন্ধানী মননের পরিচয় পাওয়া যায়।
গল্পগ্রন্থ ‘সিডরের সেই রাত এবং তারপর…’
গ্রামীণ ও শহরের পটভূমিতে অত্যন্ত সাদামাটা উপস্থাপনায় ৭টি গল্পের সমাহার ঘটানো হয়েছে এ গ্রন্থে। গল্পগুলো হল: সিডরের সেই রাত, গাউছিয়ার ফাঁদে, ভিলেজ পলিটিক্স, একান্ন নম্বর বাড়ি, প্রিয়তমার লাল চোখ, মৌমিতার মৌনতা এবং ভুল পথ।
যে সমস্ত প্রাকৃতিক দূর্যোগ এ জনপদ লন্ডভন্ড করেছে, তার মধ্যে সিডর অন্যতম। সিডরে জীব-বৈচিত্র্যে এসেছে পরিবর্তন। নষ্ট হয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। আঘাত এসেছে পারিবারিক জীবনে। প্রেমবন্ধনে এসেছে ভিন্ন মাত্রা। বহমান জীবনে মানুষ কোনো না কোনোভাবে রহস্যময়ী মায়াবী ফাঁদে জড়ায়। সামাজিক প্রেক্ষাপটে তা প্রকাশ করাও দুরূহ হয়ে যায়। তেমন ঘটনাসমূহ গল্পের মাধ্যমে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন।
শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব। বিত্তবৈভবে অর্থের প্রবাহ ছেলেমেয়েকে ভিন্ন পথে নিয়ে যায়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে একজন সরকারি কর্মকর্তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা এ গল্পে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলার চিরায়ত রূপ ও প্রকৃত স্বাদ উপলব্ধি করা যাবে এ গল্পে। যেখানে গ্রামবাংলায় বিবাহ নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনায় কণের ভূমিকা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ রকম ব্যতিক্রমধর্মী গল্পই ‘সিডরের সেই রাত এবং তারপর…’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
আরও পড়ুন কবি ও কথাসাহ্যিতিক বিমল কুন্ডু
কথাশিল্পী মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান লেখালেখির যে ধারায় হাঁটেন এটি তাঁর একান্তই নিজস্ব ভঙ্গিমা। আরোপিত কোন বিষয়ের অবতারণা করেননি তাঁর লেখায়। তাঁর গল্পে ভাষার দুর্বোধ চর্বিত চর্বনের উপস্থিতি নেই। যে বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত তাঁকে ভাবায় এবং যে বিষয়গুলোর প্রতিকার করতে পারেন না এবং যে বিষয়গুলোকে অন্তরে লালন করেন, সে বিষয়গুলোকে নিজস্ব ঢংয়ে রূপায়িত ও সহজবোধ্য করেছেন শক্ত লেখনির মাধ্যমে।
যে কারণে ‘লেখক এবং তাঁর লেখনী ভাষার’ মধ্যে নিবিড় আত্মিক সম্মিলনের সন্ধান পাওয়া যায়। সুতরাং গল্প বিচরণ মাঠে তিনি অযাচিত নন বরং বোধ্য পাঠকের নিবিড় সান্নিধ্য পাবেন এবং বাংলা সাহত্যিকেও তিনি অনায়াস লব্ধতার সমৃদ্ধ করবেন। সহজ-সরল ভাষার ব্যবহার গল্পগ্রন্থটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। কঠিন ও অনাড়ান্বর ভাষার ব্যবহার না থাকায় গ্রন্থখানা পড়ে পাঠক ভিন্ন সাধ গ্রহণ করতে পারবেন। গ্রন্থের প্রতিটি শব্দ চয়নে সারল্যে ভরা। সাধারণ ভাষার উপস্থিতি গ্রন্থখানায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে।
এ গল্পগ্রন্থে সমাজের বিভিন্ন ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো স্থান পেয়েছে। সমাজ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ অনুকরণীয় চরিত্রগুলো এ গ্রন্থের উপজীব্য।
কবি ও কথাশিল্পী মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান একাধারে গবেষক ও প্রশিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির পরিচালক পদে কর্মরত থাকায় তাঁর লেখাতেও ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। তার গল্পে গবেষণাধর্মী লেখার আভাস পাওয়া যায়। একজন মানুষ প্রত্যাহিক জীবনে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হয়, তাই গল্পগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে