মোহাম্মদ-আবদুল-জব্বার-৩য়
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  গোপালপুর (ভায়না),  বিজ্ঞানী,  ভায়না,  শিক্ষাবিদ,  সাহিত্য

মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (৩য় পর্ব)

মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (৩য় পর্ব)

 

তারা পরিচিতি রিভিউ:

তারা পরিচিতি জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশল শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার রচিত একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থ। এই বইয়ে আধুনিক ৮৮টি তারামণ্ডলের সবগুলোর বিস্তারিত বর্ননা করা হয়েছে। পৃথিবীর আকাশে তাদের অবস্থান এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত তারার তালিকা উল্লেখিত আছে। প্রত্যেকটি তারামণ্ডলের বৈশিষ্ট্য,অবস্থান চেনার সহজ উপায়,স্পষ্ট ম্যাপ এবং তারকা সমূহের চিহ্ন,বাংলা ও ইংরেজি নাম। বিশেষত্ব, উজ্জ্বলতা এবং জোড়াতারা সমূহেরও বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। এছাড়াও বইটিতে বারটি রাশির আলোচনার পাশাপাশি তারার শ্রেণীবিভাগ (বিষম, যুক্ত, নব তারা), তারার আয়তন, উজ্জ্বলতা, সীমারেখা, Hour circle, Celestial equator, Meridian,অয়ন, বিষুবন চলন এর মতো জটিল বিষয়সমূহ অতি প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পরিশিষ্ট অংশে সবগুলো নক্ষত্রমণ্ডলের বিশেষ তারাসমূহের সূচী ও বর্ণনাক্রমিক সূচী দেওয়া আছে যা রাতের আকাশের দিকে চেয়ে থাকা নব জ্যোতির্বিদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান।

সৈয়দ মুজতবা আলী বইটি সম্পর্কে বলেন- “মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিজ্ঞানের রাজ্যে এমন একখানা পুস্তক ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে, যার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এমন বই উভয় বাংলায় পূর্বে বেরোয়নি, আগামী শত বৎসরের ভিতরে বেরুবে কি না সন্দেহ। পণ্ডিত আবদুল জব্বার রচিত এই ‘তারা পরিচিতি’ গ্রন্থখানিকে ‘শতাব্দীর গ্রন্থ’ বলে তর্কাতীত দাৰ্য্যসহ পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়।” (দেশ, চৈত্র ২৪/১৩৭৯)

আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে জ্যোতির্বিদ্যা শেখার তেমন কোনো সুযোগ নেই। পাঠ্য বইতে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত কোনো অধ্যায় নেই বললেই চলে। তাই রাতের আকাশের তারা সম্পর্কে যারা জানতে চায় তাদের জন্য প্রথম পাঠ্য বই হল তারা পরিচিতি

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে এবং দ্বিতীয়বার প্রকাশ হয় ২৭ বছর পর ১৯৯৪ সালে। ২০০৫ সালে গ্যাগারিন বিজ্ঞান মেলা উপলক্ষে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করে।

প্রথম প্রকাশ: মে, ১৯৬৭

দ্বিতীয় প্রকাশ: বইমেলা-ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৪

প্রথম সংস্করণ: গ্যাগারিন বিজ্ঞান মেলা-এপ্রিল, ২০০৫

প্রথম সংস্করণ ২য় প্রকাশ: গ্যাগারিন বিজ্ঞান মেলা-এপ্রিল, ২০০৬

প্রকাশনী: বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন

আরও পড়ুন সুজানগরের ইতিহাস বই রিভিউ

 

বিষয়সূচী:
  • রাশি নক্ষত্র তারা
  • তারার শ্রেণীবিভাগ
  • তারার অবস্থানের গাণিতিক নির্দেশ ও কয়েকটি সংজ্ঞা
  • তারা মণ্ডলসমূহ
  • তারা চেনা
  • মাসিক তারাচিত্র

পাঠকের সুবিধার্থে বইটির প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকাশের ভূমিকা হুবহু তুলে ধরা হলো-

 

প্রথম প্রকাশের ভূমিকা:

“তারা পরিচিতি  মহাকাশ গ্রন্থমালার দ্বিতীয় গ্রন্থ। তারামণ্ডল নিয়ে অনেক গল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। সেই সমস্ত গল্পের দিক লক্ষ্য রেখেই আমরা বক্তব্য বলবার চেষ্টা করেছি। আকাশের তারা চেনানোই এ বই-এর প্রধান উদ্দেশ্য। সেই প্রসঙ্গে তারার উজ্জ্বলতা, দূরত্ব, বিশেষত্ব এবং স্থানাঙ্ক প্রভৃতি এসে পড়েছে। তারা চিনতে মণ্ডল চেনা দরকার, আর মণ্ডলের প্রচলিত ছবির কাঠামো থেকেই মণ্ডলের অবস্থানের একটা স্থূল ধারণা করা যেতে পারে। কোন তারাটি ছবির কোন অংশে অবস্থিত, এ বিষয়টা জানতে পারলে, মণ্ডল ও তারা চেনা সহজ হয়ে পড়ে। তারাসমূহের নামকরণও অনেক সময় ছবিতে তারার অবস্থান অনুযায়ী করা হয়ে থাকে। যেমন দেনেব শব্দের অর্থ লেজ, অর্থাৎ পাখীর লেজের তারাটির নামকরণ করা হয়েছে দেনেব। এই তারাটি চিনতে পারলে, পাখীর লেজ চেনা যেতে পারে এবং সেখান থেকে সমস্ত মণ্ডলটির কল্পনা করা সহজ হয়ে পড়ে।

যদিও মণ্ডলের নাম এবং তারার নাম, ছবি ও ছবিতে তারার অবস্থান অনুযায়ী করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্ৰত্যেকটি মণ্ডলকে কতগুলি রেখা দিয়ে রেখাচিত্রেও চিত্রিত করা হয়। যেমন সপ্তর্ষিমণ্ডলকে যদিও একটি বড় ভালুক রূপে কল্পনা করা হয়ে থাকে, তথাপি এই মণ্ডলটির প্রধান কয়েকটি তারা যোগ করে, আকাশে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন বা হাতাওয়ালা পেয়ালাররূপে চিত্রিত করা হয়। ক্যাসিওপিয়া মণ্ডলকে যদিও সিংহাসনে উপবিষ্টা ইথিওপিয়ার রানীরূপে কল্পনা করা হয়ে থাকে, তথাপি এ মণ্ডলটিরও প্রধান কয়েকটি তারা যোগ করে M বা W এর মত চিত্রে চিত্রিত করা হয়। স্বভাবত এই দুই ভিন্ন প্রকার চিত্র, একটি কল্পনার ছবি, আর একটি রেখাচিত্র। এদের মধ্যে সম্বন্ধ জানতে এবং তুলনা করতে আগ্রহ হয়। এই আগ্রহ মিটানাের উদ্দেশ্যে এ বইতে এই দুই প্রকার চিত্ৰই পাশাপাশি সন্নিবেশ করা হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের আগ্রহ তৃপ্তির এই চেষ্টাতে অবশ্য আমি অনেক জায়গায় সফল হতে পারি নি। কারণ, কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাচীন ছবি পাওয়া যায় নি।

আরও পড়ুন সরদার জয়েনউদ্দীনের নয়ান ঢুলী রিভিউ

তারামণ্ডলসমূহের প্রাচীন চিত্র সংগ্রহ করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। গ্ৰীক চারণ কবিগণের কবিতাতে মণ্ডলসমূহের যে সমস্ত ছবির বর্ণনা দেওয়া আছে। আজকাল সেসমস্ত ছবি পাওয়া সম্ভব নয়। আমেরিকার কর্তৃত্বে আজকাল সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরে যেমন বিরাট পরিবর্তন দেখা যায়। তারামণ্ডলের ছবিতেও তার স্পষ্ট স্বাক্ষর পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ আকাশের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল তারা লুব্ধক এবং ঐ তারা মণ্ডল মৃগব্যাধ মণ্ডলের উল্লেখ করা যেতে পারে। গ্ৰীক কবিতাতে বর্ণনা দেওয়া আছে, এখানে বড় একটি কুকুর (Canis Major) তার সামনের দুটাে পা উচু করে পিছনের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে, আর লুব্ধক সেই কুকুরের ডান দিকের মুখের তারা। কিন্তু বর্তমানে আমেরিকার তারার ছবিতে এখানে চারপায়ে দাঁড়ায়ে একটি শান্তশিষ্ট কুকুর দেখানো হয়। আর লুব্ধককে দেখানাে হয় তার বুকের তারারূপে। তারামণ্ডলসমূহের প্রাচীন ছবি সংগ্ৰহ করবার অনেক চেষ্টা করেছি। সে চেষ্টা আমার বিশেষ সফল হয় নি। অবশ্য পরে অপ্রত্যাশিতভাবে এই প্রাচীন চিত্ৰসম্বলিত একখানা বই আমার হাতে এসে পড়ে।

ঢাকার ভূতপূর্ব নর্মাল স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, আমার অগ্ৰজপ্রতিম জনাব মোজাহার আলী সাহেব। তাদের স্কুলের পরিত্যক্ত কতকগুলি বই-এর স্তুপের ভিতরে Astronomy-র একখানা বই দেখতে পান এবং আমি এ বিষয়ে আগ্রহী জেনে বইখানা তিনি আমাকে দেন। বইখানার নাম School Atlas of Astronomy, লেখক Alex Keith Johnston; প্রকাশকাল ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ। এই বইখানাতে প্ৰত্যেকটি মণ্ডলের প্রাচীন ছবি দেওয়া আছে, কিন্তু রেখাচিত্র দেওয়া নেই। বইয়ের ভূমিকাতে গ্রন্থাকার লিখেছেন, The subject of each illustration has been carefully studied and details have been wrought out at such an expense of time and labour as is seldom bestowed on an elementary book. কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই বইখানার প্রকাশকাল একশত বছরেরও বেশী, তার উপরে অনেককাল অযত্নে রাখবার ফলে বইখানার অবস্থা এমন হয়েছে যে, তা থেকে সবগুলো ছবি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।

আরও পড়ুন আনন্দ বাগচীর উপন্যাস চকখড়ি রিভিউ

শিল্পী হাশেম খান সাহেবকে ভার দিয়েছিলাম ঐ সমস্ত অস্পষ্ট ছবিগুলো উদ্ধার করতে। এজন্য তিনি যে পরিশ্রম করেছেন, পারিশ্রমিকে তার শোধ হয় না। প্ৰত্যেকটি ছবি তাকে অনেকবার করে আঁকতে হয়েছে। প্ৰাচীন বিবরণের সঙ্গে মিলিয়ে প্রত্যেকটি ছবির একটা কল্পনা আমি তাকে দিয়েছিলাম, তা থেকেই Johnston-এর বই-এর অস্পষ্ট ছবির কিছু সংখ্যক তিনি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছেন। অনেকদিন অযত্নে ফেলে রাখার ফলে এ বই-এর ছবিগুলোর সমস্ত জায়গাতেই সাদা দাগে ভর্তি দেখা যায়। এতে কোনটি তারা আর কোনটি তারা নয়, বুঝতে পারা মুস্কিল। সে জন্য Callatay-এর Atlas of the Sky-এর সঙ্গে মিলিয়ে ছবির বিভিন্ন অংশের তারার অবস্থান আমাকে দেখিয়ে দিতে হয়েছে এবং শিল্পী হাশেম খান সেগুলো সম্পপূৰ্ণ করেছেন। এভাবে সবগুলো ছবি শেষ করতে প্ৰায় এক বছর সময় দরকার হয়েছে।

হাশেম খান সাহেব আমার এ বই-এর জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তার জন্য তাঁকে আমার অশেষ ধন্যবাদ। অবশ্য এভাবেও সমস্ত মণ্ডলের প্রাচীন ছবি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। মৃগব্যাধ মণ্ডল, কপোত মণ্ডল ইত্যাদি কতগুলো মণ্ডলের ছবি আমেরিকা থেকে প্ৰকাশিত Stars নামের বইখানা থেকে নেয়া হয়েছে।

তারামণ্ডলসমূহের রেখাচিত্র নিয়ে নানাপ্রকার মতভেদ দেখা যায়। বিভিন্ন প্রকার তারাচিত্রাবলীতে এই সমস্ত রেখাচিত্র বিভিন্ন। Calatay. Hart, Barton and Balton প্রত্যেকের বইতে এই রেখাচিত্র পৃথক। এদের একটার সঙ্গে অন্যটা যথেষ্ট গরমিল দেখতে পাওয়া যায়। আমার এ বইতে মাসিক তারাচিত্রে আমি Henry Hart-এর বই থেকে রেখাচিত্র নিয়েছি। পৃথক পৃথক মণ্ডলের রেখাচিত্র নিয়েছি। Calatay থেকে এবং আমাদের ছায়াপথের দুই অর্ধের ছবি নিয়েছি Readers Digest কর্তৃক প্রকাশিত Great Atlas থেকে।

তারাচিত্রের দিকেরও পরিবর্তন করা হয়েছে। উত্তর আকাশের মণ্ডলসমূহের রেখাচিত্রের উপরের দিকে উত্তর এবং বাম দিকে পূর্ব দেখানাে হয়েছে। দক্ষিণ আকাশের মণ্ডলসমূহের রেখাচিত্রের উপরের দিকে দক্ষিণ এবং ডান দিকে পূর্ব দেখানাে হয়েছে। এতে দুই দিকের তারাচিত্রের সাথে আকাশের তারার তুলনা করা একই প্রকার সুবিধা হয়। Callatay-র Atlas of the Sky-তেও তাই করা হয়েছে।

আরও পড়ুন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের হারামণি রিভিউ

ভারতীয় নক্ষত্র, আরবের মনজিল এবং চীনের সিট সম্বন্ধে নানা জায়গায় উল্লেখ পেয়েছি। এরা সবাই যে চাঁদের পরিভ্রমণ-পথের কতকগুলি অংশ, এ বিষয়ে একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিল। কিন্তু ভারতীয় ২৭টি নক্ষত্র ছাড়া কোন মনজিল বা সিট-এর নামও জানতাম না। চীনের সিট-এর জন্য বিশেষ উৎসাহবোধ কোন দিন করি নি। কিন্তু আরবী মনজিলগুলোর নাম ও ভারতীয় নক্ষত্রের সাথে তাদের সম্বন্ধ জানিবার আগ্রহ অনেকদিন থেকেই ছিলো। কিন্তু ২৭টি মনজিলের নাম জানা অনেক দিন নানা চেষ্টার ফলেও আমার হয়ে ওঠে নাই। অনেক দিন পরে, জিকো প্রেসের মালিক, আমার সোদরোপম কল্যাণীয় মৌলানা আবুল খয়ের আহমদ আলী (মৌমতাজুল মোহাদেসিন) সাহেব তফসিরে কাশসাফ থেকে ২৭টি মনজিলের নাম দেন। কিম্ভ এদের অবস্থান, ভারতীয় নক্ষত্রের সঙ্গে সম্বন্ধ, এসব কিছুই তখনও জানতে পারি নাই।

ঢাকার এবং বাইরের বিভিন্ন স্থানের গ্রন্থাগারে এজন্য অনুসন্ধানও করি। অবশেষে ঢাকা সারস্বত সমাজের গ্রন্থাগারে Hindu Astronomy নামে একখানা বই দেখতে পাই। বইখানা ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত; গ্রন্থাকার উইলিয়াম ব্রেননান্ড। ইনি কোন এক সময় ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। এই বইখানা থেকেই ভারতীয় নক্ষত্র, আরবীয় মনজিল, চীনের সিট এবং মিসরের চন্দ্র-নিবাস সম্বন্ধে বিশেষভাবে জানতে পারি। সারস্বত সমাজের কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে আরমানীটোলা স্কুলের পণ্ডিত অবিনাশ বাবু আমাকে এই বইখানা দিয়ে সাহায্য করেছেন।

তারাসমূহের অনেকগুলির নামের আদিতে ‘আল’ থাকায় এবং অন্য অনেকগুলি নাম আরবী ব্যাকরণের রীতিমাফিক (যেমন- মেনকার, মেসবুতা ) হওয়াতে, অতি সহজেই মনে হয়, এগুলি আরবী নাম। হয়তো বা বিকৃত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আরবীতে এই নামগুলি কি এবং তাদের অর্থ কি, এ জানবার যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। অনেক বই পুস্তক ঘাঁটাঘাঁটি করবার পর Knoble এর Star Catalogue of Ulugh Beg নামে এক খানা বই এর সন্ধান পাই। মনে হয়, এ বইতে আরবী তারামণ্ডলের সাথে আধুনিক পাশ্চাত্য তারামণ্ডলের তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ বইখানা যোগাড় করতে পারি নাই।

আরও পড়ুন শফিক নহোরের গল্পগ্রন্থ মায়াকুসুম রিভিউ

ঢাকার অনেক লাইব্রেরীতে আদি আরবী বা ফারসী বই-এর সন্ধান করেছি। ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসাতে অনেকদিন ধরে খুঁজবার পরে তারা সম্বন্ধে উর্দুর্তে একখানা বই পাই। বইখানার নাম jJ লাহোর থেকে প্রকাশিত। বইখানাতে অনেক তারার আরবী নাম দেওয়া আছে। অবশ্য এদের সবগুলো নাম আরবী নাও হতে পারে। দুই একটি নাম ফারসী ভাষাতেও হতে পারে। কিন্তু কোনগুলি ফারসী আমি সে বিষয়ে স্থিরনিশ্চিত হতে পারি নাই। এজন্য আমি সবগুলো নামই আরবী বলে উল্লেখ করেছি।

তারাসমূহের আরবী নামগুলি কিভাবে বিকৃত হয়েছে, সে সম্বন্ধে অন্য কোথাও আলোচনা করা হয়েছে কিনা জানিনা। আরবী নাম এবং বর্তমান পাশ্চাত্য নামসমূহ বিবেচনা করে আমি এই বিকৃতির কারণ ও ধারা সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। এই আলোচনাতে যে মতবাদ দেয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ আমরা নিজস্ব। আলিয়া মাদ্রাসা থেকে উল্লিখিত বইখানাও যোগাড় করে দিয়েছেন মৌলানা আবুল খয়ের আহমদ আলী সাহেব।

তারাসমূহের সংস্কৃত নাম পেয়েছি ‘ভগোল-চিত্রম’ নামে একখানা সংস্কৃত বইতে। এ বইখানাও ভূতপূর্ব ঢাকা নর্মাল স্কুলের পরিত্যক্ত বই-এর স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়। বইখানার গ্রন্থাকার বা প্রকাশকাল কিছুই জানা যায় না। তবে বইখানা এত পুরানো এবং তার অবস্থা এমন শোচনীয় যে, পাতা উল্টাতে গেলে ভেঙ্গে গুঁড়া হয়ে যায়। বইখানাতে হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যার তারামণ্ডলসমূহের ছবি ও তারার নাম দেওয়া আছে। অনেক মণ্ডল ও তারা সম্বন্ধে অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন শ্লোকেরও উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ বই-এর ছবির সঙ্গে পাশ্চাত্য জগতের ছবির তুলনা করা এবং তারা মিলিয়ে পরিচয় নির্ণয় করাও অত্যন্ত শ্রম ও সময়সাপেক্ষ।

আরও পড়ুন  নাজিরগঞ্জে পাকবাহিনীর ফেরি ধ্বংস

অনেকদিন চেষ্টার পরে তারাসমূহের নাম নির্ণয় করে এ বইতে সন্নিবেশ করা হয়েছে। পাঠকবৃন্দ হয়তো লক্ষ্য করবেন যে, তারাসমূহের পরিচয় দেওয়ার সময় ‘বাংলা নাম’ ও ‘পাশ্চাত্ত্য নাম’ দুইটি কথা ব্যবহার করেছি। ‘বাংলা নাম’ কথাটা ব্যবহার করা কতটা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে জানি না। প্রকৃতপক্ষে এগুলি ‘ডগোল-চিত্র বইতে পাওয়া তারাদের সংস্কৃত নাম। এ বই-এর পরিশিষ্টে তারাসমূহের স্থানাঙ্ক দেওয়া হয়েছে। ১৯৬৬ খ্রীস্টাব্দে বিষুবনের অবস্থান অনুযায়ী নির্ণীত স্থানাঙ্ক গ্রহণ করা হয়েছে। একটা সাধারণ ধারণা দেওয়ার জন্য তারার স্থানাঙ্ক দেয়া হয়েছে। এই সমস্ত স্থানাঙ্ক নেওয়া হয়েছে, American Ephemeris and Nautical Almanac ১৯৬৬ থেকে। আর মণ্ডলগুলোর সীমারেখা নেওয়া হয়েছে, Callatay-র Atlas of the Sky থেকে। সেখানে যে সীমারেখা দেওয়া আছে, সেটা আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা সঙ্ঘের নির্দেশে দেলপোর্তে কর্তৃক নির্ধারিত।

তিনি ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দের বিষুবনের অবস্থান অনুযায়ী এ সীমারেখা নির্দেশ করেছিলেন। অতএব তারাসমূহের স্থানাঙ্ক ও মণ্ডলসমূহের সীমারেখার নির্দেশ সময়ের ভিতরে পার্থক্য ৯১ বৎসরের। এ সময়ের মধ্যে বিষুবনের প্রায় ১ ডিগ্রী ১৭ মিনিট অগ্রগতি হয়েছে। এজন্য কোন কোন তারার স্থানাঙ্ক ঐ মণ্ডলের বাইরে বলে মনে হবে। প্রকৃতপক্ষে তারার স্থানাঙ্কই অপেক্ষাকৃত আধুনিক।

আমি বইতে সর্বত্র ‘তারা’ শব্দ ব্যবহার করেছি। কোন কোন বন্ধু বলেছেন যে, নক্ষত্র বা তারকা শব্দ ব্যবহার করাই নাকি উচিত ছিল। তবে ‘তারা’ শব্দটি সংস্কৃত গ্রন্থে স্থান পেয়ে এসেছে। ভগোল-চিত্রম-এর সর্বত্র ‘তারা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, কুচিৎ ‘তারকা’ ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে যে সমস্ত শ্লোকের উল্লেখ করা হয়েছে তার ভিতরে প্রায় সব জায়গাতেই ‘তারা’ শব্দ পাওয়া যায়।

উৎসর্গপত্রে কয়েকটি ল্যাটিন শব্দ ব্যবহার করেছি। তারাসমূহের নাম সমস্ত ল্যাটিনে দেওয়া হয়ে থাকে। আমার বই-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের জানীমণ্ডলের ল্যাটিন প্রতিশব্দ ব্যবহার করেছি। এই ল্যাটিন শব্দ কয়েকটির জন্য আমি নটরডাম কলেজের অধ্যক্ষ রেডারেন্ড ফাদার গ্রাহামের নিকট কৃতজ্ঞ।

যে বিরাট বিষয়ে লিখবার চেষ্টা করেছি, সে বিষয়ে আমার অজ্ঞতা ও অযোগ্যতা সমন্ধে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। আমার মনের আনন্দে এ বই লিখেছি, মনের আনন্দেই এর মাল-মশলা সংগ্রহ করেছি। অন্য করো মনে এই আনন্দ সঞ্চারিত হ’লে নিজেকে ধন্য মনে করব।”

মোহাম্মদ আবদুল জব্বার

মে ১০/১৯৬৭

দ্বিতীয় প্রকাশের ভূমিকা:

“তারা পরিচিতি  প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে। ২য় বার প্রকাশ হল ২৭ বছর পর ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে। এই দীর্ঘ সময়ের ভিতরে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে অনেক নতুন তথ্য জানা গেছে। বইটি প্রথম প্রকাশের পর অতি শিগগির সমস্ত কপি বিক্রি হয়ে যায়, কিন্তু চাহিদা থেকেই যায়। অনেকে আমার নিকট বইয়ের জন্য তাগিদ দেয়। কিন্তু বাংলা একাডেমী বই খানা পুনরায় প্রকাশ করতে রাজি হয় নি। ইতিমধ্যে কিছু সংখ্যক তরুণ জ্যোতির্বিদ্যায় উৎসাহী হয়ে উঠে এবং কয়েকটি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক সংগঠন গড়ে উঠে।

ইতিমধ্যে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞান জগতে সাড়া পড়ে যায়। এই সাড়া বাংলাদেশেও অনুভূত হয়। এই সময় ড. এ আর খান (অধ্যাপক, ফলিত পদার্থ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) অনুসন্ধিৎসু চক্রের উদ্যোগে একটি “সাড়ে সাত ইঞ্চি টেলিস্কোপ” তৈরি করেন এবং তিনি এই টেলিস্কোপে বাংলাদেশে প্রথম হ্যালির ধ্যকেতু পর্যবেক্ষণ করেন। ইতিমধ্যে বিজ্ঞান জাদুঘর আট ইঞ্চি টেলিস্কোপ কিনে নিয়ে আসে। এই ২টি টেলিস্কোপের সাহায্যে প্রতিদিন রাতে নিয়মিতভাবে ধূমকেতু দেখানো হতো। ফলে হ্যালির ধূমকেতু দেখার উৎসাহ সৃষ্টি হয়। শেষ রাতের ঠাণ্ডা উপেক্ষা করেও অনেকেই হ্যালির ধূমকেতু দেখার জন্য ভিড় জমায়। হ্যালির ধূমকেতু বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহ জোগায়।

তারা-পরিচিতি প্রথম প্রকাশের পরে নানা জায়গা থেকে এ সমন্ধে অনুকূল সমালোচনা হতে থাকে। পশ্চিম বাংলায়ও এই বই যথেষ্ঠ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব বইটি সম্পর্কে বলেন- “মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিজ্ঞানের রাজ্যে এমন একখানা পুস্তক ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে, যার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এমন বই উভয় বাংলায় পূর্বে বেরোয়নি, আগামী শত বৎসরের ভিতরে বেরুবে কি না সন্দেহ। পণ্ডিত আবদুল জব্বার রচিত এই ‘তারা পরিচিতি’ গ্রন্থখানিকে ‘শতাব্দীর গ্রন্থ’ বলে তর্কাতীত দাৰ্য্যসহ পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়।” (দেশ, চৈত্র ২৪/১৩৭৯)

আরও পড়ুন পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বই রিভিউ

বর্তমানে জ্যোতির্বিদ্যা ক্রমেই বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই বইটি পুনঃপ্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমীকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু বাংলা একাডেমী তাতে রাজি হয়নি; বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনকে বইটি প্রকাশ করার অনুমতি দেয়।

বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন এই জন্য যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করেছে তার জন্যেই বইটি প্রকাশ করা সম্ভব হলো। এজন্যে আমি বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনকে বিশেষ করে সাধারণ সম্পাদক মশহুরুল আমিনকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। এছাড়াও অধ্যাপক এ. আর. খান, অধ্যাপক আলী আসগর এবং ড. আসান এ. বিশ্বাস বইটি প্রকাশের জন্য যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখিয়েছেন সেজন্য তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।”

নভেম্বর ২৪, ১৯৯২

১৬৮- মালিবাগ বাজার রোড [৩য় তলা] ঢাকা।

মোহাম্মদ আবদুল জব্বার

আরও পড়ুন মোহাম্মদ আবদুল জব্বার-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৪র্থ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (৩য় পর্ব)

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!