মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (২য় পর্ব)
মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (২য় পর্ব)
জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা: মোহাম্মদ আবদুল জব্বার জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতা করার সময়। এই কলেজে ছোট একটি অবজারভেটরি ছিল। সেখান থেকে টেলিস্কোপে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি দেখানো হতো। সে সময়েই জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলায় তাঁর লেখা বিভিন্ন নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘মোহাম্মদী’, ‘সওগাত’, ‘পাঠশালা’ ইত্যাদি পত্রিকায়। বুয়েটে ড. রশীদ অধ্যাপক হিসেবে কাজ করার সময় তিনি রচনা করেন গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘বিশ্ব ও সৌরজগৎ’। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন “..জ্যোতির্বিদ্যা আমার সখের বিষয়।…” এই শখের বিষয়টি নিয়ে গবেষণাকাজ চালিয়ে যাবার ইচ্ছে তাঁর অবশ্যই ছিল। কিন্তু এর জন্য বিষয়োপযোগী বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম, গবেষণাগার ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা তিনি কখনোই পাননি। তা সত্ত্বেও তিনি নানাভাবে সচেষ্ট হয়েছেন এই বিষয়ে গবেষণার জন্য এবং স্ব-উদ্যোগে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার জন্য কিছু কিছু মডেল ধরনের সরঞ্জাম তৈরি করিয়েছিলেন।
মোহাম্মদ আবদুল জব্বার যখন জ্যোতির্বিজ্ঞান-চর্চা শুরু করেছিলেন তখন এখনকার মতো কারিগরি সুযোগ সুবিধা ছিল না। কোনো রকম সরকারি, বেসরকারি সহযোগিতা না পেয়েও নিভৃতচারী এই জ্যোতির্বিদ নিজের অর্থ ব্যয় করে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিভিন্ন স্থান থেকে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ জোগাড় করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার থেকে ভারতীয় পুরাণ, নাসিরুদ্দিন আল-তুসীর কয়েকটি মূল আরবী গ্রন্থ (যার অধিকাংশই গ্রীক গ্রন্থের অনুবাদ) সংগ্রহ করে অধ্যয়ন করেছেন। এছাড়া ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা লাইব্রেরি থেকে ইসলামী যুগের জোতির্বিদ্যার পুস্তক, কুমিল্লার রামমালা লাইব্রেরিতে চীনের জোতির্বিদ্যা সম্বন্ধে সন্ধান লাভ করেন। চীন ও মিসরের প্রাচীন জোতির্বিদ্যা সম্বন্ধে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে প্রকাশিত জোতির্বিদ্যা বিষয়ক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং বই-এর সাহায্য নিয়েছেন।
আরও পড়ুন আবদুল গণি হাজারী
ঢাকার ভূতপূর্ব নর্মাল স্কুলের (বর্তমানে জুনিয়র ট্রেনিং কলেজ) পরিত্যক্ত বইয়ের স্তুপ থেকে Alex Keith Johnston -এর লেখা School Atlas of Astronomy বইটি সংগ্রহ করেন। প্রাচীন বিবরণের সঙ্গে মিলিয়ে এই বইয়ের অস্পষ্ট ছবিগুলো সম্পর্কে একটা কাল্পনিক ধারণা তিনি চিত্রশিল্পী হাশেম খানকে দিয়েছিলেন এবং এভাবে প্রায় একবছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে অনেক অস্পষ্ট ছবি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর পাশাপাশি তাফসিরে কাশসাফ থেকে ২৭টি মঞ্জিলের নাম, ইউলিয়াম ব্রেননান্ড কর্তৃক লিখিত Hindu Astronomy পুস্তক থেকে এ-সকল মঞ্জিলের অবস্থান এবং ভারতীয় নক্ষত্রের সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ খুঁজে বের করেছিলেন। ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার লাইব্রেরি ও লাহোর থেকে উর্দুতে প্রকাশিত একটি বই থেকে তারাসমূহের আরবী নাম এবং ‘ভূগোল-চিত্রম’ বই থেকে সংস্কৃত নাম সংগ্রহ করেছেন।
বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ এবং উপকরণ তিনিই প্রথম সৃষ্টি করেন। ১৯৬২-৮২ সাল পর্যন্ত তাঁর অঙ্কিত তারা চিত্র ‘রাতের আকাশ’ নামে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং পরিকল্পনায় বাংলাদেশের প্রথম খ-গোলক (Celestial Globe) নির্মিত হয়। এই খ-গোলকটি বর্তমানে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনে সংরক্ষিত আছে।
(খ-গোলক: অন্ধকার এবং মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকালে দর্শকমাত্রেরই চোখে পড়ে অসংখ্য জ্যোতিষ্ক। পৃথিবী থেকে এই জ্যোতিষ্কগুলোর দূরত্ব অনেক বেশি। এজন্য এদেরকে একটি বিরাট ব্যাসার্ধ্যের গোলকের ভেতরের পৃষ্ঠের কিছু স্থির বিন্দু বলে ভ্রম হয়। পৃথিবী পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান একজন দর্শক কেবল এই গোলকের উপরের অর্ধাংশই দেখতে পান। এর ভিত্তিতে একজন দর্শককে কেন্দ্র করে অসীম বা যেকোন ব্যাসার্ধ্যের গোলক কল্পনা করা যায়। এই গোলককেই খ-গোলক বলা হয়।)
আরও পড়ুন নিউরো সার্জন অশোক কুমার বাগচী
প্রকাশনা: মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গ্রন্থসমূহের মধ্যে বিশ্ব রহস্য সন্ধানে, খ-গোলক পরিচয়, তারা পরিচিতি, প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা, আকাশ পট ইত্যাদি অত্যন্ত উচ্চমানের বিজ্ঞান গ্রন্থ।
‘মহাকাশ গ্রন্থমালা’ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর খ-গোলক পরিচয়, তারা পরিচিতি এবং প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা গ্রন্থ তিনটি। জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকসমাজের জন্য ১৯৪২ সালে প্রকাশ করেন ‘বিশ্ব রহস্যে নিউটন ও আইনস্টাইন’ এবং ১৯৫১ সালে ‘বিশ্ব রহস্য সন্ধানে’ নামক দুটি বই। ‘বিশ্ব-রহস্যে নিউটন ও আইনস্টাইন’ বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদা। সকল গ্রন্থেই অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষা এবং গাণিতিক যুক্তির মাধ্যমে তিনি বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করেছেন।
‘তারা পরিচিতি’ গ্রন্থটি উভয় বাংলায় অত্যন্ত সমাদৃত হয়। এ সকল গ্রন্থ ছাড়াও তাঁর রচিত গণিতের বেশ কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক দীর্ঘকাল ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পুস্তক হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে জগত ও মহাজগত, চাঁদের দেশে অ্যাপোলো, জ্ঞান ও বিস্ময় এবং প্রকাশিতব্য ‘নিদ্রাচারী’ (Arthur Koesler রচিত Sleep Walker-এর বঙ্গানুবাদ)। বাংলাদেশের পাশাপাশি সমগ্র ভারতেও তাঁর বইগুলোর মতো মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা খুব কম।
আরও পড়ুন কবি ও কথাসাহিত্যিক আনন্দ বাগচী
বিজ্ঞান গ্রন্থ:
- বিশ্ব রহস্যে নিউটন ও আইনস্টাইন (১৯৪২ খ্রি.)
- বিশ্ব রহস্য সন্ধানে (১৯৫১ খ্রি.)
- খ-গোলক পরিচয় (১৯৬৫ খ্রি.),
- তারা পরিচিতি (১৯৬৭ খ্রি.),
- প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা (১৯৭৩ খ্রি.),
- বিশ্ব ও সৌরজগৎ (১৯৮৬ খ্রি.),
- আকাশ পট (১৯৮৯ খ্রি.)
পাঠ্য বই:
- টেক্সট বুক অব ইন্টারমিডিয়েট স্টাটিসটিক্স
- টেক্সট বুক অব ইন্টারমিডিয়েট ডাইনামিক্স
- টেক্সট বুক অব ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস
- টেক্সট বুক অব ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস
অনুবাদ গ্রন্থ:
- জগত ও মহাজগত
- চাঁদের দেশে অ্যাপোলো
- জ্ঞান ও বিস্ময়
পুরস্কার ও সম্মাননা:
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩ খ্রি.)
- বাংলা একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন (১৯৮৪ খ্রি.)
- ড. কুদরত-ই-খুদা স্মৃতি পদক (১৯৮৫ খ্রি.)
- একুশে পদক (১৯৮৫ খ্রি.)
- কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, অনুসন্ধিৎসু চক্র ও বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন যৌথভাবে তাঁকে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ব্রুনো পদকে ভূষিত করে।
আরও পড়ুন কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক বিমল কুণ্ডু
ব্যক্তিত্ব: নদীতে খেয়া পারাপারের একজন সাধারণ মাঝির সন্তান হয়েও প্রচন্ড ইতিবাচক মানসিক ইচ্ছাশক্তি এবং নিজের প্রতি অবিচল আস্থায় যে স্বপ্নের সমানও বড়ো হওয়া সম্ভব, সেটারই অবিসংবাদিত, বিরলতম উদাহরণ ছিলেন মোহাম্মদ আবদুল জব্বার। নিরন্তর নিরলস প্রচেষ্টায় ও স্ব-ক্ষমতায় আলোকিত মোহাম্মদ আবদুল জব্বার আমাদের কাছে চিরকালীন উৎসাহের সত্যিকারের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, আলোকবর্তিকা। স্মরণ করা জরুরি যে, মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের জীবনের স্বপ্নপূরণে, আপন কর্মে সফল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর পিতা-মাতা-ভাইদের পাশাপাশি আরো যে দু’জন মানুষের নাম উচ্চারণ না করলেই নয়, তাঁদের একজন ছিলেন ‘লেখাপড়া জানা মুচি, নাম নীলমনি ঋষি’ এবং আরেকজন ‘নিম্নবর্ণের এক হিন্দু- নাম শশী ভূষণ দাস’।
মৃত্যু: অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৩ সালের ২০ জুলাই তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৯৩ সালের ২৯ মে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর সোহরাওয়ার্দী হাসাপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়। পরে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলে তাঁকে পিজি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে সি.টি. স্ক্যান করার পর চিকিৎসকেরা জানান যে তাঁর ব্রেইন সংকুচিত হয়ে গেছে। এ সময়ে তাঁর রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং ১৬ জুলাই থেকে অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। অবশেষে ১৯৯৩ সালের ২০ জুলাই সকাল ৭:১০ টায় পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মূল্যায়ন: এক স্মরণ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী তাঁর প্রয়াত শিক্ষক সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করে বলেছিলেন, ‘মোহাম্মদ আবদুল জব্বার বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি যেমন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, তেমনি মেধাবী অধ্যাপক এবং চিন্তাশীল লেখক ছিলেন। তিনি যখন বাংলা বিজ্ঞানবিষয়ক বই লেখেন তখন এ সম্পর্কে কোনো বই-ই বাংলায় পাওয়া যেত না। কিন্তু তাঁর যে মূল্যায়ন হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। তাঁকে নিয়ে আরো গভীর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এতে তাঁর অবদানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, যা থেকে আমরা লাভবান হব।’
তথ্যসূত্র:
মোহাম্মদ আবদুল জব্বার-জীবন ও কর্ম : সুব্রত বড়ুয়া
আরও পড়ুন মোহাম্মদ আবদুল জব্বার-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (২য় পর্ব)