মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ফোকলোর সাধনা
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ফোকলোর সাধনা
বঙ্গদেশে ফোকলোর-সাধনা, পঠন-পাঠন ও গবেষণায় মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৭) একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। ফোকলোর-সাধনাকে তিনি জীবনের মূল ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ‘বস্তুত, লোকসাহিত্য ও সঙ্গীত সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সম্পাদনা ও তৎ-সংক্রান্ত গবেষণা ছিল অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের সারা জীবনের ধ্যান-জ্ঞান, অধ্যবসায় অনুরাগ, প্রেম-ভালবাসা, আর্তিচেতনা ও স্বপ্নসাধনা।’ তিনি ছিলেন পল্লির সন্তান। পল্লিসাহিত্যের বিশাল সমুদ্র মন্থন করে তিনি সংগ্রহ করেছেন লোকসঙ্গীত মাণিক্যের বিপুল সম্ভার। তাঁর সংগৃহীত লোকসঙ্গীত সংকলন হারামণি এবং লোককথা সংকলন শিরনী বাংলা ফোকলোর ভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদ।
বঙ্গদেশে ফোকলোর-সাধনার ধারা গড়ে উঠেছে ফোকলোর অনুরাগী কিছু ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত আত্মসংযোগ ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে। ইংরেজ রাজকর্মচারীরা সর্বপ্রথম বঙ্গদেশে ফোকলোরচর্চার গোড়াপত্তন করলেও বাঙালিদের মধ্যে সর্বপ্রথম ফোকলোরের উপাদান সংগ্রহে ব্রতী হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ফোকলোরের কেবল ফোকলোরের উপাদান সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হননি, ফোকলোরের নানা বিষয়ে স্বীয় চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়ে লোকসাহিত্য নামে একখানি গ্রন্থ প্রকাশ করেন ১৯০৭ সালে। রবীন্দ্রনাথ ১৩২২ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় হারামণি নামে একটি বিভাগ চালু করেন, যেখানে ফোকলোরের নানা উপাদান প্রকাশ পেতে থাকে। এদেশে ফোকলোর-সাধনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে ড. দীনেশচন্দ্র সেনের (১৮৬৬-১৯৩৯) হাতে। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে ফোকলোর-সাধনায় অবদান রাখেন চন্দ্রকুমার দে, জসীম উদ্দীন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রমুখ।
ফোকলোর-সাধনায় মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের শ্রেষ্ঠ দান হারামণি। ‘সমুদ্রোপকূলে বালুকারাশির মধ্যে যেমন অগণিত মণিমুক্তা থাকে, বাংলার পল্লিজীবনে তেমনি বহু অমূল্য রত্ন বিক্ষিপ্তভাবে পড়িয়া রহিয়াছে। হারামণি তাহারই সংগ্রহ।’ এই হারামণি নামের পেছনে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব।
আরও পড়ুন অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন
বাংলাদেশে ফোকসাধনা ও গবেষণায় সর্বাধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেন মযহারুল ইসলাম ও আশরাফ সিদ্দিকী। তাঁরা ফোকলোর গবেষণার জন্য আমেরিকায় যান এবং সেখানকার পণ্ডিতদের সংস্পর্শে ফোকলোর-সাধনার আধুনিক রীতি-পদ্ধতি আয়ত্ত্ব করেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্যের ফোকলোর-সাধনার যোগসূত্র স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে এদেশে ফোকলোর-সাধনা ও গবেষণায় যাঁরা মূল্যবান অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে আব্দুল হাফিজ, আনোয়ারুল করীম, ওয়াকিল আহমদ, আলমগীর জলীল, শামসুজ্জামান খান, খোন্দকার রিয়াজুল হক, মুহম্মদ আবদুল জলিল, আবদুল খালেক, আবুল আহসান চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ পাঠান, তোফায়েল আহম্মদ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফোকলোর-সাধনায় মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের বিশেষত্ব লোকসঙ্গীত সংগ্রহ ও সংকলনের ক্ষেত্রে। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন লোকসংগীতের বিপুল সম্ভার। ফোকলোর বিষয়ক জ্ঞানগর্ভ ও বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ রচনায় তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন।
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের জন্ম পাবনা জেলার নিভৃত পল্লী মুরারীপুর। তাঁর শৈশব-কৈশোরে দিনগুলো কেটেছে ফোকলোরের বিচিত্র উপাদানে সমৃদ্ধ পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলে। নিরক্ষর ভাবুকজনের রচিত লোকসঙ্গীত, ছড়া, লোককথা, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি ঐ অঞ্চলের মানুষের স্মৃতিপটে রয়ে গেছে যুগ যুগ ধরে। লোককবি পাগলা কানাই, লালন ফকির, ইদু বিশ্বাস, ভাজন শাহ, ক্ষেপুউল্লাহ বয়াতি পাবনার জেলার মাটিতে বসে অসংখ্য গান রচনা করেছেন। এ ছাড়া বাউল, ফকির, বোষ্টমী, কৃষক ও মাঝি-মাল্লার রচিত অসংখ্য লোকসঙ্গীতের সুর-লহরিতে মুখরিত থাকতো মনসুরউদ্দীনের জন্মভূমির আকাশ-বাতাস, মাঠ-প্রান্তর। এ কথা বললে বোধ করি একটুও অত্যুক্তি হয় না যে, ফোকলোর-ভাণ্ডারের বিপুল ঐশ্বর্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন। তাঁর পারিবারিক পরিমণ্ডলও ছিল ফোকলোরের জন্য বিশেষভাবে অনুকূল। তাঁর মাতামহ সন্ধ্যায় বাড়ির আঙিনায় বসে রসিয়ে রসিয়ে রূপকথার গল্প বলতেন।
আরও পড়ুন সুজানগরের প্রথম এম এ পাশ মাওলানা রইচউদ্দিন
গ্রামের লালু মোল্লা তাঁদের বাড়ির দহলিজে বসে বসে গভীর রাত পর্যন্ত সুর করে আমির হামজা ও আলিফ লায়লা পুঁথি পাঠ করতেন। বালক মনসুরউদ্দীন এসব শুনে পুলকিত হতেন। বালক হৃদয়ে এ পুলক-সঞ্চারের বিষয়টি পরবর্তীকালে তাঁকে ফোকলোর-সাধনায় নিবিষ্ট করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন অল্প বয়সেই ফোকলোর-সাধনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। গ্রামের স্কুলে পড়ার সময় প্রবাসী পত্রিকার একটি সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত কয়েকটি লালনসঙ্গীত দেখে তিনি বিস্মিত ও অভিভূত হন : ‘গ্রামের স্কুলে যখন পড়ি তখন শহরের এক বন্ধু আমাকে একখানা প্রবাসী দিয়েছিলেন পড়তে। তাতে রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত লালনের কয়েকটা গান ছিল। রবীন্দ্রনাথ এই সংগ্রহ করেছেন দেখে আশ্চর্য লাগল। তখন এই জাতীয় পল্লীগান সংগ্রহে আগ্রহের সঙ্গে নিজেকে নিয়োজিত করলুম।’ তাঁদের গ্রামের বাড়ির পাশে একটি মনিহারি দোকান ছিল। সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে বৈরাগীদের আগমন ঘটতো। বৈরাগী প্রেমাদাসার কাছ থেকে মনসুরউদ্দীন লালন শাহ’র কিছু গান সংগ্রহ করেন। বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে লালনের গানের পাশাপাশি অন্যান্য লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করতে থাকেন। ‘প্রতিবেশী ছায়েম উদ্দীন ওরফে ছামু, নায়েব আলী মণ্ডল, ন্যাংড়া মোল্লা, আব্দুল জব্বার ওরফে জবা’র নিকট থেকে তিনি প্রথম পাগলা কানাইয়ের গান সংগ্রহ করেন। একই গ্রামের জাবেদ আলীর নিকট থেকে তিনি প্রথম একটি বারোমাসী উদ্ধার করেন।’
আরও পড়ুন মোহাম্মদ আবিদ আলী
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর সংগৃহীত লোকসঙ্গীত ছাপা হয়। তিনি বলেছেন : ‘রাজশাহীতে এসে লোকসঙ্গীত সংগ্রহে আমার নেশা ধরে যায়। এই সময়ে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বঙ্গবাসী প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় আমার লোকসঙ্গীত সংগ্রহ ছাপা হয়।’ তাঁর এই সংগ্রহ দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), বিজয়চন্দ্র মজুমদার (১৮৬১-১৯৪২), শশাঙ্কমোহন সেন (১৮৭১-১৯২৮), অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) প্রমুখ ব্যক্তি মুগ্ধ হন এবং আশীর্বাদ করেন। ফলে লোকসংগীত সংগ্রহে তাঁর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯), বিধুশেখর ভট্টাচার্য (১৮৭৮-১৯৫৯), সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০১৯৭৭)), ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০১৯৬০) এবং অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৭) সান্নিধ্য লাভ করে তাঁদের দ্বারা নানাভাবে অনুপ্রাণিত হন। নওগাঁ অবস্থানকালে তাঁর পরিচয় ঘটে অন্নদাশঙ্কর রায়ের (১৯০৪-২০০২) সঙ্গে। এ সময় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লোকসংগীত সংগ্রাহক আরনল্ড বাকে নওগাঁ এলে মনসুরউদ্দীন তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন। অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন : ‘আমরা নওগাঁয় থাকতে আমাদের শান্তিনিকেতনের আলাপী ডক্টর আরনল্ড বাকে লোকগীতি সংগ্রহের জন্য সেখানে আমাদের অতিথি হন। … মনসুরউদ্দীনকে খবর দিতেই তিনি কোথা থেকে এক ফকিরানীকে ধরে নিয়ে আসেন। সঙ্গে তাঁর ফকির।’
কর্মজীবনে মনসুরউদ্দীন লোকসঙ্গীত সংগ্রহে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। এম এ পাস করে তিনি প্রথমে স্কুল সাব-ইন্সপেক্টরের অস্থায়ী চাকরি পান। এ সময় বেড়া, পাবনা, বদরগঞ্জ, রংপুর, রাজশাহী, নওগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি এসব অঞ্চল থেকে বাউল গান, সারিগান, বারাসে গান, বিয়ের গীত প্রভৃতি সংগ্রহ করেন। পরবর্তীকালে স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের কাছ থেকে অনেক গান সংগ্রহ করেন। তাঁর সংগৃহীত মোট গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। মনসুরউদ্দীন গান সংগ্রহ ও সংকলনের পাশাপাশি বহু গানের স্বরলিপি প্রস্তুত করেছেন। ‘লোকসঙ্গীতের স্বরলিপি প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনিই পথিকৃৎ।’
আরও পড়ুন অধ্যাপক মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন
দুই.
ফোকলোর-সাধনায় মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের শ্রেষ্ঠ দান হারামণি। ‘সমুদ্রোপকূলে বালুকারাশির মধ্যে যেমন অগণিত মণিমুক্তা থাকে, বাংলার পল্লিজীবনে তেমনি বহু অমূল্য রত্ন বিক্ষিপ্তভাবে পড়িয়া রহিয়াছে। হারামণি তাহারই সংগ্রহ।’ এই হারামণি নামের পেছনে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। কলকাতার প্রবাসী পত্রিকায় পল্লি অঞ্চল থেকে সংগৃহীত লুপ্তপ্রায় লোকসঙ্গীত প্রকাশের জন্য একটি বিভাগ খোলা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর নাম দেন হারামণি। মনসুরউদ্দীন তাঁর সংগৃহীত লোকসঙ্গীত সংকলন গ্রন্থের নাম হারামণি এখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন। হারামণির সঙ্গে মনসুরউদ্দীনের নাম ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। এ গ্রন্থটিই তাঁর জীবনে সর্বাধিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। পল্লিবাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত খ্যাপা বাউলের মতো, মুক্তা আহোরণকারী ডুবুরির মতো বিচরণ করে তিনি এ সব গান সংগ্রহ করেছেন। তাঁর সংগৃহীত ও সংকলিত হারামণি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালির প্রাণের সম্পদ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় : ‘‘হারামণি’র একটি বৈশিষ্ট্য, ইহা শুধু লোকসাহিত্য নহে। বাঙ্গালাদেশের হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে বাঙ্গালী জনগণের আধ্যাত্মিক অনুভূতির ও উপলব্ধির একটি রত্নভাণ্ডর।’’
হারামণি তের খণ্ডে সংকলিত। এতে প্রায় সাড়ে চার হাজার লোকসঙ্গীত স্থান পেয়েছে। এগুলোর প্রকাশকাল যথাক্রমে : প্রথম খণ্ড, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২৯; দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪২; তৃতীয় খণ্ড, হাসি প্রকাশনালয়, ঢাকা, ১৯৪৭; চতুর্থ খণ্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৫৯; পঞ্চম খণ্ড, হাসি প্রকাশনালয়, ঢাকা, ১৯৬১; ষষ্ঠ খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৬৭; সপ্তম খণ্ড, ১৯৬৩; অষ্টম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৬; নবম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৮; দশম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৪; একাদশ খণ্ড, অপ্রকাশিত; দ্বাদশ খণ্ড, অপ্রকাশিত; ত্রয়োদশ খণ্ড, বাংলাদেশ ফোকলোর পরিষদ, ঢাকা, ১৯৮৪। হারামণি গ্রন্থে সংকলিত গানের সংখ্যা যেমন বিপুল তেমনি বৈচিত্র্যপূর্ণ। এতে প্রধানত ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি, কবিগান, জাগগান, পালাগান, মেয়েলি গীত, ধুয়া গান, ঘাটু গান, বারমাসী, বাউল গান, মুর্শিদী গান, মারফতি গান, গম্ভীরা, উরিগান ও ভাসান গানসহ বিভিন্ন ধরনের গান স্থান পেয়েছে। গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই গানগুলো সংগৃহীত হয়েছে।
আরও পড়ুন এম. আকবর আলী
এই গানগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে মনসুরউদ্দীন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এজন্য তিনি বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে ছুটে বেড়িয়েছেন। এ কাজে একদিকে যেমন অনেকের উৎসাহ ও সহযোগিতা পেয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি নানাবিধ বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন, তবে উদ্যোম হারান নি। বরং দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন : ‘এ পথে পদে পদে বাঁধা, কিন্তু কর্মীকে দমে গেলে চলবে না, নিরূৎসাহ হলে হবে না। হতে হবে উদ্যোমী, একনিষ্ঠ ও নিরলস।’
লোকসঙ্গীতের পাশাপাশি মনসুরউদ্দীন লোককাহিনি সংগ্রহ করেছেন। তাঁর এ প্রচেষ্টায় মুগ্ধ হয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লিখেছিলেন : ‘অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন সাহেব লোকগীতি সংগ্রহ করিয়া যশস্বী হইয়াছেন। তিনি এখন উপকথা সংগ্রহে মনোনিবেশ করিয়াছেন দেখিয়া প্রীতি-লাভ করিলাম।’ দরজীর শাস্তর নামক একটি লোককাহিনি মনসুরউদ্দীন শিরনী (কলকাতা, ১৯৪২) নামে প্রকাশ করেন। ১৩৮৭ সালে শিরনীর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং এতে মধুমালার কেচ্ছা এবং সাতশ তোতার কেচ্ছা নামক আরও দুটি লোককাহিনি যুক্ত করা হয়।
তিন.
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ফোকলোর-সাধনা করেছেন। লোকসাহিত্য ও লোকসঙ্গীত সম্পর্কে মুসলমানদের অনাগ্রহ ও বিরূপ মনোভাব তাঁকে ব্যথিত ও মর্মাহত করেছে। “বাংলার লোকসাহিত্য ও মুসলমান” প্রবন্ধে তিনি এ-সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি ইতিহাসের স্বচ্ছ দৃষ্টি দিয়ে লোকসাহিত্য-সাধনা করেছেন। লোকসাহিত্যের মধ্যে তিনি বাঙালির ইতিহাসের উপাদান অনুসন্ধান করেছেন। লোকশিল্প, লোকসাহিত্য এবং লোকচিত্তে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত শক্তির যে বিকাশ ঘটেছে সে-সম্পর্কে তিনি বলেছেন : ‘সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতিতে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত শক্তির মনোরম বিকাশের বিবরণী আমরা সংক্ষিপ্তরূপে জানি। কিন্তু লোকশিল্পে, লোকসাহিত্যে এবং লোকচিত্তে এই মিলন কি প্রকার দ্রুত ও সার্থকভাবে সংঘটিত হইয়াছিল তাহার ইতিহাসের সন্ধান নাই। অশিক্ষিত বহু মনের মিলন বা মিশ্রণের সেই কাহিনী বাউলদের গানে মারফতী গানে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়।’
আরও পড়ুন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মোহাম্মাদ আবদুল জব্বার
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ফোকলোর-সাধনার মূলে ছিল গভীর দেশপ্রেম। এ জন্যই তিনি পল্লি-বাংলার লুপ্তপ্রায় সাহিত্য খুঁজে বের করেছেন। প্রত্যাশা বা প্রাপ্তির দিকে না তাকিয়ে কেবল দেশ ও দেশের সংস্কৃতির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং প্রাণের টান থেকে তিনি ফোকলোরচর্চা করেছেন। নিজেই বলেছেন : ‘লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেছি প্রাণের টানে-অন্তরের তাগিদে।’
ফোকলোর-সাধনা করতে গিয়ে মনসুরউদ্দীন অনেক পণ্ডিত ও মনীষীর সান্নিধ্য লাভ করেছেন এবং তাঁদের কাছে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন : ‘মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন বাউল-সংগীত সংগ্রহে প্রবৃত্ত হয়েছেন এ সম্বন্ধে তার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে আলাপ হয়েছিল, আমি তাকে অন্তরের সঙ্গে উৎসাহ দিয়েছি।’ হারামণির একটি মুখবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : ‘মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন মহাশয় বাউল সঙ্গীত সংগ্রহ করে প্রকাশ করবার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, আমি তার অভিনন্দন করি।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও অনেক পণ্ডিত ও মনীষীর সহযোগিতা ও সৌহার্দ্য তিনি পেয়েছিলেন। মনীষী আর্নল্ড বাকে, মার্শাল ফিস উইক প্রমুখ ফোকলোর-সাধক মনসুর উদ্দীনের ফোকলোরচর্চার প্রশংসা করেছিলেন। ফিস উইক বলেছেন : ‘অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তিনি শুধু বাংলার সম্পদ নয় বিশ্বেরও সম্পদ।’
ফোকলোর-সাধনা ও সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ মনসুরউদ্দীন অনেক পুরস্কার, সম্মাননা ও সংবর্ধনা লাভ করেছেন। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৫), শেরে বাংলা জাতীয় পুরস্কার (১৯৭৭), মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), একুশে পদক (১৯৮৩), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), কালু শাহ পুরস্কার (১৯৮৬) প্রভৃতি। এছাড়া বাংলা একাডেমি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করে। ১৯৮৭ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে। তাঁর ফোকলোর-সাধনা আবেগ দ্বারা পরিচালিত ছিল না, তা ছিল আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তির নিগড়ে শানিত। ‘তিনি আধুনিক ফোকলোরচর্চা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এবং এ বিষয়ে তাঁর পড়াশোনাও ছিল। ফোকলোর-সাধনাকে তিনি যুগ থেকে যুগান্তরে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। ‘ফোকলোর সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়রূপে এর অবকাঠামো নির্মাণ এবং এই বিষয়ের চর্চায় আধুনিক মাত্রা সংযোজনের ক্ষেত্রে তাঁর নিরলস প্রয়াস চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
আরও পড়ুন বাংলাদেশে বইমেলার প্রবর্তক সরদার জয়েনউদ্দীন
তিনি স্বপ্ন দেখতেন এদশে ফোকলোরচর্চার একটি আধুনিক পদ্ধতি ও বৈজ্ঞানিক রীতি প্রতিষ্ঠিত হোক। তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন এ দেশে ফোকলোর-সাধনার জন্য একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হোক, যেখান থেকে গবেষকগণ ফোকলোর-সাধনায় নানাভাবে উপকৃত হবে। এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন : ‘লোকসাহিত্যের পরিপূর্ণ গবেষণা, পঠন-পাঠন, বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য দেশে একটি লোকসাহিত্য একাডেমী অবশ্যই করতে হবে।’ তিনি ফোকলোর-সাধনায় ফিল্ডওয়ার্কের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কেননা, আধুনিক কালে ফোকলোরচর্চা ফিল্ডওয়ার্ক ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তাঁর প্রজ্ঞাদীপ্ত অভিমত : ‘তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে যদি সরেজমিনে সফর ও পর্যক্ষেণের অভিজ্ঞতা যুক্ত না হয় তা হলে প্রকৃত ফোকলোর চর্চা সম্ভব হবে না।’ এ কথা মনসুরউদ্দীন কেবল মুখে বলেন নি, কাজে প্রমাণ করেছেন। তিনি নিজে বাংলার নিরক্ষর জনসাধারণের কাতারে মিশে ফোকলোর সংগ্রহ করেছেন। আন্তর্জাতিক ভোকলোর ফিল্ডওয়ার্কের রীতি-পদ্ধতি পুরোপুরি অনুসরণ করে তিনি এ কাজ সম্পাদন করেছেন। লোকসাধারণের কাছে যেভাবে পেয়েছেন, সেভাবেই প্রকাশ করেছেন। তাঁর আদর্শ ছিল ‘যৎ শ্রুতং তৎ লিখিং।’
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ফোকলোর-সাধনায় মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের অবদান অবিসংবাদিত। ফোকলোর সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণায় তিনি যে অবদান রেখেছেন তা অতুলনীয়। ‘তাঁকে বাদ দিয়ে লোকসাহিত্য গবেষণা প্রায় অসম্ভব।’ ফোকলোর-সাধানায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দীনেশচন্দ্র সেনের পর তাঁর নাম অনায়াসে উচ্চারণ করা যায়। তাঁর হারামণি বাংলা ফোকলোর-ভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদ, এর গুরুত্ব কোনোদিনই কমবে না। তাঁর চিন্তানিষ্ঠ প্রবন্ধগুলো অনাগত কালের ফোকলোর-গবেষকদের পথ দেখাবে। তিনি ব্যক্তি নন, প্রতিষ্ঠান। স্বীয় কীর্তি ও কৃতিত্বের জন্য তিনি বাংলা ফোকলোর-সাধনার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আরও পড়ুন বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. এম আব্দুল আলীম
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ফোকলোর সাধনা