মির্জা-আব্দুর-রশিদ
আহম্মদপুর,  জনপ্রতিনিধি,  দূর্গাপুর (আহম্মদপুর),  শিক্ষাবিদ,  সমাজসেবক

মির্জা আব্দুর রশিদ ।। শিক্ষক ।। রাজনীতিবিদ ।। মানবহিতৈষী

আলহাজ মির্জা আব্দুর রশিদ পাবনার সুজানগর উপজেলার একটি উল্লেখযোগ্য নাম। কর্মগুণে তিনি মানুষের মনে স্থায়ী আসন করে নেন।

জন্ম ও পারিবারিক জীবন
মির্জা আব্দুর রশিদ ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই অক্টোবর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার আহম্মদপুর ইউনিয়নের দূর্গাপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মির্জা ইসমাইল উদ্দিন ছিলেন দূর্গাপুর গ্রামের জোতদার।
মির্জা আব্দুর রশিদ চার ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। তাঁর বড়ো ছেলে ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ, যিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ, পরিকল্পনা, বাণিজ্য, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর চার ছেলে এবং এক মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। তাঁর আরেক পুত্র এ কে মির্জা মো. শহিদুল ইসলাম প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক এবং অপর এক পুত্র আমেরিকা প্রবাসী।

আরও পড়ুন আহমেদ তফিজ উদ্দিন

শিক্ষাজীবন
মির্জা আব্দুর রশিদের লেখাপড়ার হাতেখাড়ি গ্রামের স্কুলে। পরে তাঁর বাবা তাঁকে তারাবাড়িয়া মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করান। কিন্তু মাদ্রাসায় বেশি দূর লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। সপ্তম শ্রেণি পড়াকালীন তাঁর বাবা মৃত্যুবরণ করলে তাঁর ফুফা তাঁকে খলিলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এখান থেকে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আরবিতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন; যা বর্তমানে এসএসসি পরীক্ষা নামে পরিচিত। এরপর পাবনা জেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে আইএ পাশ করেন। এরপর আর্থিক সমস্যার কারণে তাঁর উচ্চশিক্ষার সুযোগ হয়নি এবং তিনি চাকরির সন্ধানে নামেন।

কর্মজীবন
আইএ পাশ করার পর তিনি ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় রেলওয়েতে কর্মকর্তা হিসেবে চাকরির সুযোগ পান। কিন্তু এলাকার মানুষের অনুরোধে এবং সমাজহিতৈষী মনোভাবের কারণে রেলওয়ের চাকরিতে যোগদান না করে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে খলিলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। খলিলপুর উচ্চ বিদ্যালয় পাবনা জেলার মধ্যে সুপ্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিনি একনাগাড়ে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতা, নিষ্ঠা এবং সুখ্যাতির সাথে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষক জীবনে তিনি সফল শিক্ষক হিসেবে অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে তাঁর ইংরেজির Writting এবং Speaking Power বহুজনের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।

আরও পড়ুন মকবুল হোসেন সন্টু

রাজনৈতিক জীবন
আলহাজ মির্জা আব্দুর রশিদ এলাকার জনগণের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আহম্মদপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করে নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ইউনিয়ন বোর্ড ও প্রেসিডেন্ট পদের নাম পরিবর্তন হয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পদবি হয়। তিনি বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর এক মেয়াদ ব্যতীত ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একটানা আহম্মদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডে সরকারি কনফারেন্সে যোগদানের সুযোগ লাভ করেন। এসব কনফারেন্সে তিনি ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়ে সবার মনযোগ আকর্ষণ করেন। দীর্ঘ ২২ বছর ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, রাস্তাঘাট উন্নয়নসহ অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মসজিদ, কলেজ প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করে সুজানগর উপজেলার মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

তিনি ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) থেকে পাবনা-২ (সুজানগর-বেড়ার একাংশ) আসনে (২৪শে নভেম্বর ১৯৭৯ থেকে ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮২ মেয়াদে) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি বাংলাদেশে ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার ও উন্নয়ন এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে যমুনা নদীর মুখে বিলগণ্ডহস্তির (গাজনার বিল নামে পরিচিতি) সাথে সংযোগকৃত বাদাই নদীর উপর একটি সুইচ গেট নির্মাণ করে বিলগণ্ডহস্তির মধ্যকার কয়েক হাজার একর জমির আমন ধানসহ ফলস অকাল বন্যার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা সুনিশ্চিত করেন।

আরও পড়ুন অধ্যাপক মুহম্মদ খোয়াজউদ্দিন

মানবহিতৈষী
আলহাজ মির্জা আব্দুর রশিদ তাঁর মূল্যবান চার বিঘা দান করে আহম্মদপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, ইউনিয়ন কৃষি বীজাগার, ইউনিয়ন পরিবারকল্যাণ ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র, স্টাফ কোয়ার্টার, ইউনিয়ন খাদ্য গুদাম, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, দূর্গাপুর শাখা প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন। আহম্মদপুর ইউনিয়নের বিরাহিমপুর গ্রামে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর দান করা জমিতে ও অনুদানে প্রতিষ্ঠা করেন আলহাজ মির্জা আব্দুর রশিদ উচ্চ বিদ্যালয়টি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অবকাঠামো উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ব্যক্তিত্ব
তিনি ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত মিষ্টভাষী, সদালাপী, ন্যায়পরায়ণ, দানশীল এবং ধার্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর শ্রুতিমুধর কোরআন তেলাওয়াত এলাকার মানুষ আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।

মৃত্যু
১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে অক্টোবর মির্জা আব্দুর রশিদ সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। ঢাকা এবং নিজ গ্রামে জানাজা শেষে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর জানাজায় হাজারো মানুষ অংশগ্রহণ করেন, যা তাঁর প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার নিদর্শন।

তথ্যসূত্র: সুজানগরের ইতিহাস; লেখক: ড. আশরাফ পিন্টু ও মিজান খন্দকার

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

Facebook Comments Box

আলতাব হোসেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। তিনি ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!