মাওলানা-রইচ-উদ্দিন
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  জনপ্রতিনিধি,  পুকুরনিয়া,  লেখক পরিচিতি,  সাগরকান্দি,  সাহিত্য

মাওলানা রইচ উদ্দিন

মাওলানা রইচ উদ্দিন (১৮৯৬-১৯৬৫ খ্রি.) পাবনা জেলার একজন প্রসিদ্ধ আলেম, রাজনীতিবিদ, অনলবর্ষী বক্তা ও লেখক। সুজানগর উপজেলায় তিনিই প্রথম এমএ পাশ করেন।

বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এবং সকল ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মিশুক ও সদালাপী।

জন্ম: মাওলানা রইচ উদ্দিন ১৮৯৬ সালে, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত সাগরকান্দি ইউনিয়নের পুকুরনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃ প্রদত্ত নাম রেকাত উদ্দিন। তিনি এই নামেই ছাত্র জীবন অতিবাহিত করেন।

পারিবারিক জীবন: পিতা মুন্সী রমজান আলী মিয়া সাগরকান্দি দত্ত জমিদারদের সেরেস্তাঁয় একটি ক্ষুদ্র চাকরি করতেন এবং  লাঠি খেলায় সপটু ছিলেন।

তিনি বেশ পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। তাঁর জীবিতকালেই তাঁর স্ত্রী পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। আপন দুই এতিম ভাগ্নেকে নিজ সন্তানের মত লালন-পালন করেন।

আরও পড়ুন হযরত শাহ মাহতাব উদ্দিন শাহ ছাহেব (রহ.)

শিক্ষা জীবন: মাওলানা রইচ উদ্দিন একজন প্রতিভাবান ছাত্র ছিলেন। তিনি দারিদ্রের সাথে কঠোর পরিশ্রম করে বৃত্তিসহ ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন।

তিনি স্থানীয় শ্যামগঞ্জ মানিক কুণ্ডু বিদ্যাপীঠে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর সাগরকান্দি দত্ত জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত জুনিয়র স্কুলে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করার পর মুর্শিদাবাদ নবাব হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯১৬ সালে তিনি এই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯১৮  ও ১৯২০ সালে যথাক্রমে প্রথম বিভাগে আইএ ও বিএ পাশ করেন। ১৯২২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সগৌরবে ইংরেজি ও আরবি সাহিত্যে এমএ পাশ করেন।

উল্লেখ্য, ১৯২০ সালে রাজশাহী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মাওলানা রইচ উদ্দিনের মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ একটি সার্টিফিকেট প্রদান করেন। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিনা বেতনে অধ্যয়ন করার সুযোগ লাভ করেন।

কর্ম জীবন: মাওলানা রইচ উদ্দিন সুদীর্ঘ কাল প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি জেলা বোর্ড ও ব্যবস্থাপক সভার সভ্য নির্বাচিত হন। তিনি গান্ধীর আদর্শে স্থানীয় লোকদের সাহায্যে একতি তাঁতখানা খোলেন, যেখানে খদ্দরের কাপড় তৈরি হত।

আরও পড়ুন অধ্যাপক মোহাম্মদ খোয়াজউদ্দিন

রাজনৈতিক জীবন: মাওলানা রইচ উদ্দিন শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে গান্ধিজীর নেতৃত্বে কলকাতায় কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দেন এবং মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা মোহাম্মদ আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের রাজনৈতিক সহপাঠী হিসেবে কাজ করেন। তৎকালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে পাবনাসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম করেন এবং নেতৃত্ব দেন। ১৯২৪ সালে তিনি কলকাতাস্থ পাবনা সমিতির ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৩০ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগের মনোনয়ন প্রার্থী হন। কিন্তু মনোনয়ন পান দেওয়ান লুৎফর রহমান (ভাষাসৈনিক)। তিনি দেওয়ান লুৎফর রহমানের পক্ষে জোরালোভাবে কাজ করেন। নির্বাচনে লুৎফর রহমান বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। ১৯৪৮-১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট। মুসলিম লীগকে হারাতেই হবে। মনোনীত প্রার্থীদের নিয়ে সমস্ত জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ল নির্বাচনী প্রচারণায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সারাদেশ ঘুরে মন্তব্য করলেন, মুসলিমলীগ সিট পাবে ১০টি। আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তান থেকে সিট পেয়েছিল মাত্র ৯টি। যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন প্রকাশ পেলে দেখা গেল, সুজানগর  অংশ থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন আবদুর রব বগামিয়া। আর মাওলানা রইচ উদ্দিন মনোনয়ন প্রার্থী থাকা সত্বেও বাদ পড়েছেন। মাওলানা রইচ উদ্দিন ছুটে গেলেন পাবনায়, আবদুর রব বগামিয়ার কাছে। বগামিয়াকে বুঝিয়ে নিয়ে গেলেন ঢাকায় এবং মনোনয়ন পরিবর্তন করে প্রার্থী হয়ে এলেন মাওলানা রইচ উদ্দিন। 

আরও পড়ুন শিক্ষাবিদ ও লোকসাহিত্য গবেষক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন

উল্লেখ্য যে, আবদুর রব বগামিয়া মাওলানা রইচ উদ্দিনকে খুবই সম্মান করতেন। তাই তিনি নিজে প্রার্থী না হয়ে মাওলানা রইচ উদ্দিনকে মনোনয়ন পাইয়ে দিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের নজির খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। পূর্ব পাকিস্তানের এই প্রাদেশিক পরিষদের (১৯৫৪-৫৮) নির্বাচনে মাওলানা রইচ উদ্দিন এমএনএ নির্বাচিত হন।

মানবহিতৈষী: মাওলানা রইচ উদ্দিন একজন চিন্তশীল মানুষ ছিলেন। তিনি মুসলমান সমাজের কল্যাণ চিন্তা করতেন এবং আজীবন মুসলমান সমাজের খেদমতে অতিবাহিত করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে, হযরত শাহ মাহতাব উদ্দিন শাহ ছাহেব (র.) ছায়ার মতো রইচ উদ্দিনকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আমৃত্যু আন্দোলন করে গেছেন। জমিদারদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মাওলানা রইচ উদ্দিন-ই সাগরকান্দি এলাকায় সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে গরু কুরবানির প্রচলন করেন। সে সময় গরু কুরবানি নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি কেউ যদি গরুর মাংস খেত এবং সেটা যদি জমিদার জানতে পারত, তাহলে ওই ব্যক্তিকে ৫০ টাকা জরিমানা দিতে হতো। মুসলমানরা যাতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সঠিকভাবে পালন করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্থ সাহায্য করেছেন এবং স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার অনেক গরিব মেধাবী ছাত্রদের তিনি আর্থিক সহযাগিতা ছাড়াও বইপত্র ক্রয় করে দিতেন। ভারতের আসামের নানা স্থানে সভা সমিতি করে ইসলামের খেদমত করেন।

সাগরকান্দির দত্ত জমিদারদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৩০ সালে তিনি সাগরকান্দির তালিমনগরে একটি জুনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন।

আরও পড়ুন এম আকবর আলী

সাহিত্য সাধনা: মাওলানা রইচ উদ্দিন ছাত্র জীবনেই সাহিত্য সাধনা শুরু করেন। রাজশাহী কলেজে অধ্যয়নকালে তাঁর রচনা কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এই ম্যাগাজিনের শ্রেষ্ঠ লেখক হিসাবে কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পুরস্কৃত হন।

তিনি গদ্য ও পদ্য  উভয় রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর রচনার মধ্যে ইসলামী জীবনভঙ্গী পরিলক্ষিত হয়। তিনি রবীন্দ্র সাহিত্যে পারদর্শী ছিলেন। ফার্সী, আরবি সাহিত্যের সাথেও তাঁর গভীর পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন একাধারে একজন সাহিত্যিক, দার্শনিক ও ইসলামের আধ্যাত্মিক সাধক। তৎকালীন সমাজের দুরবস্থা ও প্রতিকার প্রভৃতি তাঁর পাণ্ডিত্যের সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর সুন্দর একটি পাঠাগার ছিল।

প্রকাশনা: মাওলানা রইচ উদ্দিন বেশ কয়েকটি বই রচনা করেন। তন্মধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়।

প্রকাশিত গ্রন্থ:

  • কোরআনের বাণী
  • মরুবীণা
  • সিন্ধু ও বিন্দু
  • মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ বিলাপ
  • মুসলমান সমাজের দুরবস্থা ও তার প্রতিকার

অপ্রকাশিত গ্রন্থ:

  • কবি হাফেজের জীবনী ও কাব্যলোচনা

ব্যক্তিত্ব: মাওলানা রইচ উদ্দিন  নামাজ ও রোজার পাক্কা পাবন্দ ছিলেন। তাঁর মধ্যে কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামী ছিল না।

মৃত্যু: নিঃসন্তান এই মহান ব্যক্তি ১৯৬৫ সালের ২০ ডিসেম্বর নিজ বাসগৃহে মৃত্যুবরণ করেন।

 

তথ্যসূত্র:

১। বহুমাত্রিক প্রতিভার মেলবন্ধনে পাবনা, মহিউদ্দিন ভূঁইয়া (সম্পা.)

২। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন রচনাবলী ১ম খণ্ড

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!