ভাঙা গড়ার টান
ভাঙা গড়ার টান
রাতুল হাসান জয়
মোষের দলের মতো তেড়ে আসছে কালো মেঘ। বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে টিনের চাল। বারান্দার রেলিংয়ে খুব কায়দা করে বসে আছে একটা শালিক। অপেক্ষায় আছে তার সঙ্গীর। মানুষ তার সঙ্গীকে দেওয়া কথা রাখেনা। ওয়াদা ভুলে যায়। পশুপাখিরা তার ব্যতিক্রম।
মিতু এসে পাশে বসলো। এই মানুষটা আশেপাশে থাকলে ভরসা পাই। পাশের ঘরে আলোচনার প্রায় সবটাই কানে আসছে স্পষ্ট৷ হয়তো শুনিয়েই বলতে চাইছে। মিতু শাড়ির আঁচল টেনে চশমাটা মুছতে মুছতে বললো
‘ওসব ভেবো না তো। ওরা ছোট মানুষ। বুঝে কম।’
কথাটা আমায় সাবলীল ভাবে বললেও ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছিলো ছেলে বউদের এমন কঠিন কথায়। টের পেলাম সবটাই। বলতে পারলাম না। বয়সের একটা সময় এসে অনেক কিছুই বলা যায় না। ঘাড় ঘুড়িয়ে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম।
‘মিছে মিছে স্বান্তনা যে দাও, তুমি নিজে পাও?’
আরও পড়ুন গল্প জীবনের উপহাস
দুই ছেলে গতকাল এসেছে। কিছুক্ষণ আগে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি মাথায় করে এসেছে বউমাদের ভাইয়েরা। তাদের আগমনের কারণ জানা আছে আমার। শেষ কবে এমন একত্রিত হয়েছিলো সবাই মনে পড়ে না। বৃদ্ধ বয়সের এই এক অসুবিধা। কিছুই মনে থাকে না ঠিকঠাক।
পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপিয়ে ধীরপায়ে বসার ঘরে এলাম। শুনলাম তাদের অভিযোগ। বাড়িতে দুই বউ থাকলে যেরকম অভিযোগের কথা শোনা যায় তাই। অভিযোগ আলাদা হলেও দুজনের চাওয়াই এক। আলাদা সংসার । ছেলেরা জানালো তারা বাসাও ঠিক করে এসেছে। কাল চলে যাবে। এখানে তার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হচ্ছে না। বউদের ভাইয়েরাও তাদের সাথে একমত। তারা বলল্
‘আজ হোক কাল হোক আলাদা তো হতেই হবে। আগেই হোক সেই ভালো গুছিয়ে নেওয়ার সময় পাবে’।
কষ্টে কথারা ফুটে উঠতে পারছে না ফুলের মতো। কাঁটায় জড়িয়ে কথারা কেটে কেটে যাচ্ছে গলাতেই। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকালাম। মিতু এসে দাঁড়িয়েছে। চশমার নীচে জমাট অশ্রু দেখে কিছুই বলতে পারলাম না। চুপচাপ ঘরে ফিরে এলাম। তারা গুনগুনিয়ে কথা বলছে কিছুই কানে আসছে না৷
ছোট বড় গাছের সমন্বয়ে মান্ধাতার আমলে নির্মিত একতলা বাড়ি। টিনশেডের একটা ঘর। পৈতৃক সূত্রে দাদা পেয়েছিলেন। তারপর বাবা, এরপর আমি। আমার পর সম্ভবত কেউ এই স্মৃতি বয়ে বেড়াবে না। বাড়িটার বাইরের পলেস্তারা খসে পরছে। কিন্তু ভিতরটা এখনো চমৎকার। রক্তের সম্পর্কের মতো না, উপরে উপরে চমৎকার ভিতরে খসে পড়ছে অভিযোগের পলেস্তারা।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
পরদিন ঘুম থেকে খুব সকালে উঠলাম। বাড়ির দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটছি। আর কথা বলছি মিতুর সাথে।
-এই বাড়িতে আমাদের কত স্মৃতি। আচ্ছা মানুষ স্মৃতি বয়ে বেড়াতে চায় না কেন?
-স্মৃতিতে সবাই বাঁচতে পারে না, বুঝলে? মানুষ শিকড় ভুলে যেতে চায়।
-চায় বলেই ভেঙে যায়।
বেলা বাড়তেই এক এক করে সবাই চলে গেলো। বড় খোকা একবার বলেছিলো বাবা তুমি আমাদের সাথে চলো। শুনে তার বউয়ের ভ্রু কুঁচকে গেলো বিরক্তিতে। মুখ রাখতে সেও একবার বললো ‘চলুন বাবা।’ বললাম তোমরা যাও। এই বাড়ি ছেড়ে আমি যাচ্ছিনা কোথাও।
ঝড়ো বাতাস যেমন পুকুরের পানিতে বড় ঢেউ খেলে যায়। তেমনি বুকের ভিতর ব্যথার একটা ঢেউ বয়ে গেলো। পাকা বাঙ্গীর মতো যেন বুক ফেটে পরে আছি মরা মাঠে। চারপাশে শূন্যতার হাহাকার। দেখার কেউ নেই।
কিছুক্ষণ আগে একটা মেয়ে এসেছে। বড় খোকা ঠিক করে গেছে কাজের জন্য। বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে। ছ’মাসের টাকাও দিয়েছে। সে রান্নাঘরে ব্যস্ত। তখন থেকে মিতুকে দেখা যাচ্ছে না। মিতুর খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পিছনটায় গেলাম।
বাঁধানো কবরটা শুকনো পাতায় ছেয়ে আছে। পাতা ঝেড়ে পরিষ্কার করে দিলাম। কাল রাতের ঝড় বৃষ্টিতে নামের ফলকে কাঁদা জমে গেছে। পাঞ্জাবীর কোণা দিয়ে পরিষ্কার করে দিলাম। ফুটে উঠলো লেখা। মিসেস হাসান। মৃত্যু সাতাশ জানুয়ারি দুই হাজার তেরো।
কবর ছুঁয়ে অভিযোগের সুরে বললাম।
‘তুমি আসছো না কেন?’
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
ভাঙা গড়ার টান