বেলীফুলের ঘ্রাণ (শেষ পর্ব)
বেলীফুলের ঘ্রাণ (শেষ পর্ব)
৩.
শোন, খেয়ে নে। আজ ঢাকা থেকে তোর জাহিদ ভাই আসবে। আমরা ফকির বাড়ি যাবো পিঠার চাইল কুটতে, ঢেঁকিতে। এতদিন পর ছেলেটা বাড়ি আসছে। তোর মেঝ মামাকে বললাম, রোকেয়াকে নিয়ে আপনিও আসেন। জাহিদের সঙ্গে তার নাকি অফিসে অনেক কাজ, আসতে পারবো না। মানুষ একবার শহরে গেলে গ্রামে আর ফিরে আসতে চায় না। কেউ যদিও আসে লাশ হয়ে। বেঁচে থাকতে আর ক’জন আসে গ্রামে। তাই না রে পারুল? তোর মেঝ মামা বলেছে, তোর লেখাপড়া ভালো হলে ঢাকা নামকরা কলেজে তোকে ভর্তি করবে। তোকে নাকি ডাক্তারি পড়াবে, তোর মায়ের না কি স্বপ্ন ছিল। তুই ডাক্তারি পড়বি। আজকাল আর মামারা কারো জন্য এমন করে না। তোর মেঝ মামা বলেছে, আমার মেয়ে নাই। পারুল আমার মেয়ের মতো। আমার এখানে থেকে লেখাপড়া করলে কি এমন ক্ষতি হত শুনি?
অবুঝ বালিকার মতো মামীর মুখের দিকে চেয়ে রইল পারুল। পিঠা বানানোর চাউল কুটা শেষ করে পুকুর পাড়ের সরুরাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে এগাতো লাগল। কাঁকে করে চাউলের গুড়া নিয়ে আসছে মামীর সঙ্গে পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল পারুল। যদিও চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়নি বিষণ্ণ হয়ে কিছু একটা ভাবছে। স্বর্ণলতার দেহের মতো পরিপাটি হয়েছে পারুল। এ যেন গোবরে পদ্মফুল। দেখতে দেখতে চোখের সামনে বছর কীভাবে শেষ হয়ে যায়। মনে হয়ে বেলা উঠার সঙ্গে সঙ্গে বছর শেষ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা
জাহিদ পারুলকে দেখেছিল তখন পারুল ছোট, ক্লাস সেভেনে পড়ত। আর এখন? ক’দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। দেখেতে দেখেতে মেয়েটা কেমন বড় হয়ে গেল। জাহিদ মেডিকেলে পড়ছে। তার জন্য আজ এ বাড়িতে মনে হচ্ছে জামাই আদর চলছে। এখনো আসার কোন হদিস নাই। দুপুরে পুকুরের থেকে গোসল সেরে হালকা বেগুনী রঙের জামা পরেছে পারুল। দেখতে পরীর মতো লাগছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল ঠিক করতেই, হঠাৎ ঘরের ভেতরে জাহিদ এসে হাজির। লজ্জায় দ্রুত বুকে ওড়না টেনে নিয়ে বাহিরে বের হয়ে গেল। জাহিদের সঙ্গে কোন কথা হল না।
মামী উচ্চ স্বরে নাম ধরে পারুল পারুল ডাকতে লাগল,
──পোড়ামুখী কোথায় গেলি? দেখেছিস জাহিদ এসেছে।
──কি রে তুই এখানে দাঁড়িয়ে কেন? জাহিদ আসছে। ওর টিউবওয়েল থেকে পানি তুলে দে, গোসল করুক। ছেলেটা শহরে থাকে। হঠাৎ করে পুকুরে গোসল করলে, হয়তো ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।
──ঠাণ্ডা লাগবে কেন? সে নাকি ডাক্তার?
──ক্যান ডাক্তার মানষির বুঝি ঠাণ্ডা লাগে না?
জাহিদ ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল।
──চাচী, তোমার সঙ্গে মেয়েটি কে?
──কেন, ওকে চিনতে পারছিস না? তোর রোজী ফুফুর মেয়ে। তোকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো তোর রোজী ফুফু। তুই তখন খুব ছোট, তোকে কোল থেকে মাটিতে নামতে দিতো না। তোকে খুব আদর করত।
──পারুল দেখছি বড় হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে কথা বলছে না।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
লজ্জা পেয়ে পারুল টিউবওয়েলের দিকে একটু এগিয়ে গেল। বালতি ভরে, গামছা নিয়ে জাহিদের হাতে দিয়ে বলল,
──পানি দিয়েছি, গোসল করে নিন।
──পারুল তোর এত লজ্জা কেন রে? আমি কি তোর পর মানুষ?
──আমি কি বলেছি, আপনি পর মানুষ?
সকালে হঠাৎ ভীষণ জ্বর পারুলের। গা মনে হচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে। জাহিদ শরীরে হাত স্পর্শ করতেই কেমন কেঁপে উঠল।
──চাচী, ওকে দ্রুত একটা হাসপাতালে নেওয়া দরকার। বারেক ভাইকে ডাক দিন, ভ্যান নিয়ে আসুক। আচ্ছা চাচী, পারুল কি খুব মানসিক চিন্তা করে?
──ছেলের যে কথা। মা মরা মেয়ে, চিন্তা তো একটু করবোই।
──ঠিক তা না। আমি বলছিলাম, লেখাপড়া নিয়ে কি বেশি চিন্তা করে? বাবা তো বলেছে, কলেজ শেষ হলেই ঢাকা নিয়ে ভর্তি করে দেবে। বলবেন চিন্তা না করতে।
কিছুক্ষণ পরে সজ্ঞানে ফিরে আসল পারুল, জানতে চায় সে এখানে কীভাবে এলো। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়ে বলল,
──ঠিক মতো খেতে বলবেন। পেশার লো হয়েছিল। রাতে হয়তো ভালো ঘুম হয়নি। খাবার ঠিক মতো খেতে হবে। দুপুরে না খেয়ে ছিল। না খেয়ে থাকা খুব বোকামি, এমন করা ঠিক নয়।
──কি ব্যাপার তোমার ছেলে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে, এবার দেখছি আসার নাম গন্ধ নেই। একটা খবর নাও, দেখ অসুস্থ হল কি-না? জাহিদ তো কখনো গ্রামের বাড়িতে এতদিন থাকে না।
──ঠিক আছে। দেখি আজ ওকে ফোন দেবো। এ নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।
জাহিদ এবার গ্রাম থেকে যাওয়ার সময় কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। পারুলের প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মনের গভীরে তাকে নিয়ে সাত পাঁচ ভাবনায় ডুবে আছে।
পারুল তাকে নিজের কাছে সপে দিতে নারাজ। নিজেকে অযোগ্য মনে করেই নিজেকে আড়াল করেছে। তার মনের ভেতরেও জাহিদের জন্য মায়া বেঁধেছে, মনের গভীরে তা রয়ে গেল অপ্রকাশ্য।
আরও পড়ুন ভৌতিক গল্প অশরীরী আত্মা
দু’বছর পর!
দিন দিন পারুল অসুস্থ হয়ে পড়ল। এদিকে জাহিদ ইন্টার্নি শেষ করে নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে। পারুল মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। জাহিদের মা স্বপ্ন দেখেছিল, পারুল তার ছেলের বউ হয়েই এ বাড়িতে থাকবে। জাহিদ একটা সময় নিজের মনের কথা পারুলকে সব খুলে বলে। জাহিদ সত্যিকার অর্থে পারুলকে মন থেকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু পারুল ভালবাসলেও তা প্রকাশ করেনি। পারুলের মনের ভেতর বার বার জানান দিয়েছে; এ পৃথিবীর আলো বাতাসে সে হয়তো বেশিদিন নেই। একটা সময় রক্ত বমি শুরু হল। ভয় পেয়ে গেল বাড়ির সবাই। হাসপাতালে ভর্তি করা হল পারুলকে। পাশে থেকে সব রকম সাহায্য করছে জাহিদ। কিন্তু পারুল দিনদিন নিস্তেজ হয়ে পড়ল। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটা সময় জানিয়ে দেয় তাকে বাঁচানো সম্ভব না। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরে পরিবারের সবাই।
হাসপাতাল থেকে পারুলকে বাসায় নিয়ে আসতে হয়। নিজের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা হতে লাগল জাহিদের। নিজে ডাক্তার হয়েও নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে পারল না। দিন যতো কমছে পারুলের মুখাবয়ব ততো পবিত্রায় পূর্ণতা পেয়ে বসলো। চোখের দিকে তাকালে মায়া হয়। এই মানুষটা আর মাত্র কদিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে। আর মাত্র ক’ দিন! আমার চোখে চোখ রাখবে না কখনো। কোনোদিন তাকে দেখব না, স্পর্শ করতে পারব না। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ডাক্তার আকিত সাহেবের ফোন।
──হ্যালো, জাহিদ বলছেন?
──জি।
──আপনি যে পেশেন্ট ভর্তি করেছিলেন, তার রিপোর্ট ভুল এসেছে; তার ক্যান্সার হয়নি। সরি, আপনাকে সঠিক তথ্যটি না দিতে পেরে আমি লজ্জিত।
কথাটি শোনার পর ভেজা চোখে হেসে উঠল জাহিদ। পারুল তখন পানি চেয়ে বসল, পানি আনতে গিয়ে ফিরে এসে দেখল, ঘুমিয়ে গেছে। বেলিফুলের মতো সাদা মুখাবয়ব।
কারণে-অকারণে তুমি কাছে আসতে চাইলেও বাঁধা দেওয়ার মত সাহস আমার কখনোই ছিল না। অথচ তুমি ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে আমাকে সবকিছুর আড়ালে রেখে। তুমি জয়ী হতে পারনি। মোবাইল ফোনের নোট প্যাডে লিখেছিল পারুল।
আরও পড়ুন বেলীফুলের ঘ্রাণ-
১ম পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
বেলীফুলের ঘ্রাণ (শেষ পর্ব)