বিষফুল (১ম পর্ব)
বিষফুল (১ম পর্ব)
সকালে ঘুম থেকে উঠা নিয়ে শুরু হল সোনিয়ার সঙ্গে বাকবিতণ্ডা। এমন করতে করতে একটা সময় সোনিয়া-মুরাদ দম্পতির ভেতর শুরু হয় জিদ। মুরাদ ঘুম থেকে খাটের উপর উঠে বসল। তারপর পা বাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়িয়ে রইল। ভোরের প্রকৃতির প্রতি তার এক ধরনের নেশা কাজ করে। দাঁড়িয়ে ব্রাশ করতে করতে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়ল। বের হয়ে এসে দেখল, সোনিয়া ঘুমিয়ে আছে। বেড ট্রি তো দূরের কথা সকালের নাশতা পর্যন্ত তৈরি করেনি। এভাবে এক বছর চলতে থাকল। মুরাদ এক প্রকার হাল ছেড়ে দিয়েছিল। নিজের স্ত্রী সন্দেহ করে কেন? এই প্রশ্নটি মুরাদ তার স্ত্রীকে করেছিল। কিন্তু তার সদুত্তর মেলেনি কখনো। অতিরিক্ত ফোন ব্যবহার, বাইরের আড্ডা। সবকিছু কেমন যেন হয়ে উঠেছিল। মুরাদ চাইনি সংসারটা ভেঙে যাক। কিন্তু তারা আলাদা হয়ে গেল একদিন। কিছু বিষয় নিয়ে মুরাদ সোনিয়াকে সন্দেহ করত, অথচ উল্টো সোনিয়া মুরাদকে দোষ ধরতে থাকে। এর ভেতরেও ছিল অনেক না বলা ছোট্ট ছোট্ট গল্প। দৃশ্যমান হয়নি মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখা দু’জনের গরল।
অনলাইনে কাকতালিয়ভাবে পরিচয় হয় মণিকা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে। তার সঙ্গে গড়ে উঠে মুরাদের অদৃশ্য প্রণয়।
মণিকা বেশ কিছুদিন আগে মুরাদকে ফোন করে বলেছিল,
── এবার গ্রামে যাব ঈদ করতে। তুমি কি আমাদের সঙ্গে যাবে?
কীভাবে যাবে তা নিয়ে একটু চিন্তায় পরে গেল। কারণ মণিকা মুরাদের ফেসবুক বন্ধু। বয়সে তার চেয়ে বেশ ছোট। মুরাদের সঙ্গে তুমি, কখনো আপনি সম্বোধন করে কথা বলে। একদিন কথা প্রসঙ্গে ওদের গ্রামের বাড়ির গল্প শুরু করল। গ্রামের বাড়ির গল্প শুনতে মুরাদ ভীষণ পছন্দ করে। তালগাছ, পুকুরে মাছ ধরা, খেজুর রস খাওয়া, নদীর তীরে বসে বাদাম খাওয়া। গল্প শুরু হলে চলতেই থাকে। অনলাইন অনেকটা নেশার মতো। একবার কোনোভাবে নেশা যদি লেগে যায়। তা পাশ কাটিয়ে উঠতে বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। মুরাদ অকস্মাৎ একটু ধাক্কা খেল নিজের মনের কাছে। মেয়েটি এত সহজে পটে গেল ক’দিনের মধ্যে। মুরাদ শ্রোতা হয়ে শুনতে লাগল।
আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ
মণিকা বলল,
── তোমার সঙ্গে এই অনলাইনে কথা বলে তাও আমার সময় কেটে যাচ্ছে; চোখের পলকে। বিশ্বাস করবে এই দেড় বছর কেমন বন্দি একটা জীবন অতিক্রম করছি। সব আছে তবুও মনে হয়েছে কী যেন নেই?
তোমার সেলফোন নম্বরটা আমাকে পাঠিয়ে রেখ। আমি একসময় কল দেব।
অনলাইনে আসলে কল দিয়ে কথা বলতে সব সময় ভালো লাগে না। তাছাড়া তোমার ব্যস্ততা আমি তো বুঝতে পারব না। অনলাইনে থাকলেই কল দিতে হবে এটা আসলে ভদ্রতার ভেতর পরে না।
মুরাদ কণ্ঠ মোলায়েম করে বলল,
── তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু আমরা ক’জন নিয়মের ভেতর থাকি।
মুরাদ তার অফিসের কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে কথা সংক্ষিপ্ত করল। তাকে ভীষণ চিন্তিত মনে হল। নিজের অজান্তে ঠোঁট নাড়তে লাগল।
কার সঙ্গে কথা বলবে, মনে হচ্ছে তার মনের ভেতর অনেক দিনের পুরোনো কষ্ট জমে আছে। প্রিয় কোনো মানুষের কাছে কথা বলতে পারলে মনটা একটু হালকা হত তার। কিন্তু এমন কাউকে পাবে কী করে?’
পরিচিত যারা আছে তাদের কাছে এ ধরনের কথা বলতে গেলে তাকে ভুল বুঝবে। তাছাড়া ভেবে বসবে, বয়স তো কম হয়নি এখনো কেমন … তার নিজের কাছেই বিষয়টা খারাপ লাগল। এক প্রকার নিজেকে আড়াল করবার চেষ্টা করল মুরাদ।
গাড়ির এসি একটু বাড়িয়ে দিল। তবুও তার শরীর ঘেমে যাচ্ছে। তখন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। নিজে ভাবল এসি বন্ধ করে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দেই। বৃষ্টি ছুঁয়ে দিলে অনেক সময় মন ভালো হয়ে যায়। গাড়ির গ্লাস খুললে তাতে বাহির থেকে বৃষ্টির পানি চলে আসতে পারে ভেবে গ্লাস খোলা হল না। আজ উত্তরা ক্লাব থেকে একটা বোতল নিয়ে বাসায় ফিরবে ভাবছে সে। সেভাবেই জসীম উদ্দিন মোড় হয়ে গাড়িয়ে ঢুকিয়ে দিল।
আরও পড়ুন গল্প দীপ্তিদের দেবতা
পবিত্র মহরম তাই আজ আর মদ বিক্রি হবে না; ক্লাবের রিসেপশনে বসা ভদ্র মহিলা জানিয়ে দিলেন। চোখের দিকে তাকাতেই বিদ্যুৎ গতিতে সে নজর সরিয়ে নিল। এসব জায়গার মেয়েরা অবশ্য খুব চালক হবে এটাই স্বাভাবিক।
‘উত্তরা ক্লাব আজ বন্ধ’
এ ফোর সাইজের কাগজে প্রিন্ট করা একটা কাগজ টানিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
গাড়ি ঘুরিয়ে মহাখালী গেলেন, সেখানে অবশ্য তার যে ব্যান্ড পছন্দ তা নেই।
সোজা গুলশান এক নম্বরে হলি ফ্যামিলি হোটেল। তার পরিচিত একজন আছে। তার কাছে গেলে অবশ্য ব্যবস্থা একটা হবে। ইউটার্ন নিয়ে গুলশানে ঢুকতে পথে জ্যাম। রাস্তায় এক ঘণ্টা বসে। এর ভেতর চারটা সিগারেট শেষ করল। চারদিকের পরিবেশ কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। নিজের মনের ভেতর সাত পাঁচ প্রশ্ন হতে লাগল।
গাড়ি পার্কিং করে জামিলকে ফোন দিল সে। প্রথম রিং শেষ না হতেই রিসিভ করল,
── মুরাদ ভাই, বলুন, কি করতে পারি আপনার জন্য?
─জামিল ভাই, একটা ব্যবস্থা করেন না।
── কই আছেন?
─আপনার হোটেলের নিচে।
──নতুন একটা পরী আছে, চলে আসুন।
─পরী লাগবে না ভাই। পানি হলেই চলবে।
── মুরাদ ভাই লিফটের সাতে আসুন।
ভেতরে ঢুকতেই খুব পরিচিত একটা মুখ; সিগারেটের ধোঁয়ায় তার চেহারাটা হালকা ঝাপসা দেখা গেল। স্লিভলেস জামা পরে বসে আছে। জামিলকে আবার ফোন দিতেই, রিসিভ না করে তার সামনে এসে হাজির। মুরাদকে চোখ দিয়ে ইশারা করল।
── দেখছেন না, জিনিসটা? আজ থাকুন না আমাদের এখানে। ভালো একটা ডিসকাউন্ট করে দেব মুরাদ ভাই।
আরও পড়ুন গল্প ওরা তেরোজন
মুরাদ জামিলের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে জানতে চাইলো।
── কে মেয়েটি?
── ধুর মিয়া তারে চেনেন না; সবচেয়ে দামি মডেল। বিদেশ থেকে কিছুদিন আগে বিজ্ঞাপন করে আসল।
─হুম এখন চিনতে পারলাম। এই জন্যই চেহারাটা পরিচিত মনে হচ্ছিল।
── জামিল ভাই , পেমেন্ট কীভাবে করব? নিচে নাকি আপনাকে দিলেই হবে?
── এটার দাম নিচে দিলেই হবে।
সেদিন কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। জামিলের কাছে যদিও সোনিয়ার খবর থাকে। তার বিশেষ কারণ সোনিয়া জামিলের কলেজ বন্ধু। সে হিসেবে কখনো কখনো জানতে না চাইলেও অনেক কথা বেড়িয়ে আসত। সোনিয়া ইদানীং বিভিন্ন ক্লাবে রাতে আড্ডা দেয় তার বন্ধুদের সঙ্গে। যদিও এ নিয়ে মুরাদের মাথা ব্যথা নেই। মুরাদ নিজেই স্বাধীন একটা জীবন চেয়েছিল। যেখানে নিজের জন্য বেঁচে থাকা; সুখ, আনন্দ উপভোগ করা। সেখানে সোনিয়া তার ব্যক্তিগত জীবন উপভোগ করবে এটাই স্বাভাবিক। মুরাদ যদিও চেয়েছিল তাদের ভেতর সম্পর্ক থাকবে কিন্তু আলাদা সংসার থাকবে দু’জনের। জবাবদিহিতা থাকবে না। সোনিয়া চেয়েছিল ভিন্ন কিছু। গ্রাম্য একটি মেয়ে মডার্ন কালচার সম্পর্কে অজ্ঞ। এটা মুরাদের এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা।
সোনিয়াকে আজ ভীষণ মনে পড়ছে মুরাদের। সে নিজেকে অনেকটা ব্যর্থ ও অসহায় মনে করল।
সোনিয়া যদি তাকে বুঝতে চেষ্টা করত! নিজের মনের মতো করে ভালোবাসতো। কিন্তু অবিশ্বাস তাকে মুরাদ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর। সে চাইলেই তাকে ডিভোর্স দিতে পারত।
কেন এমন করছে, সেই হয়তো ভালো জানে। দুজনের ভেতর গড়ে উঠেছিল অদৃশ্য অভিযোগের পাহাড়।
আরও পড়ুন গল্পের-
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
বিষফুল (১ম পর্ব)