বিল গাজনার ইতিহাস
বিল গাজনা বা গাজনার বিল হচ্ছে পাবনা জেলার একটি বৃহত্তম বিল। এটি সুজানগর উপজেলার অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
অবস্থান: বিলটি সুজানগর উপজেলার মাঝখানে অবস্থিত যা পাবনা শহর থেকে প্রায় ৩৫-৩৬ কিলোমিটার দূরে। সাতবাড়িয়া-চিনাখড়া সড়ক বিলের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে বিখ্যাত খয়রান ব্রিজকে অতিক্রম করে।
আয়তন: বিল গাজনার আয়তন প্রায় ১২ বর্গ মাইল বা ৩১০০ হেক্টর। এ বিলে (পানি না থাকা অংশ) আবাদি জমির পরিমান প্রায় ১০ হাজার হেক্টর।
বিলের পূর্ব পাশে রানিনগর ও সাগরকান্দি ইউনিয়ন; দক্ষিণে হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা, শোলাকুড়া, শ্রীপুর, কামালপুর, সৈয়দপুর; ভায়না ইউনিয়ন ও মানিকহাট ইউনিয়নের বোনকোলা, উলাটসহ অনেকগুলো গ্রাম স্পর্শ করেছে। উত্তর পাশে আহম্মদপুর, দুলাই ও তাঁতিবন্দ ইউনিয়নের অর্ধাংশ। পশ্চিম পাশে ভায়না ও তাঁতিবন্দ ইউনিয়নের অর্ধাংশ।
আরও পড়ুন বোয়ালিয়া গ্রাম পরিচিতি
উৎসস্থল ও নামকরণ: সুজানগর উপজেলার আত্রাই ও পদ্মা নদীর সংযোগে সৃষ্ট এটি বিলগন্ডহস্তী নামেও পরিচিত। বর্তমানে বিল গাজনার পানির প্রধান উৎস এ অঞ্চলের বৃষ্টি ও যমুনা নদীর পানি হলেও যুগ যুগ ধরে পদ্মা নদীর পানি বিল গাজনায় প্রবেশ করতো।
জনশ্রুতি আছে, বর্ষা মৌসুমে প্রমত্ত পদ্মার যে গর্জন হতো এবং ঐ গর্জনের ফলে উত্থিত পানি দু’কুল ছাপিয়ে নিম্নাঞ্চল গাজনায় এসে আটকে থাকতো। যার কারণে প্রমত্ত পদ্মার গর্জন থেকেই গাজনা বা বিল গাজনা নাম হয়েছে।
উল্লেখ্য বিষয় যে, বিল গাজনা মূলত খয়রান ব্রিজ হতে পূর্ব দিকে তিন চার কিলোমিটার কাটাজোলা বিল পর্যন্ত বিল গাজনা নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে পোড়াডাঙ্গা থেকে বাদাই নদী পর্যন্ত বিল গাজনা নামে পরিচিত। মুজিব বাঁধ হওয়ার পর বাদাই নদী স্লুইসগেট দিয়ে যমুনার পানি বিল গাজনায় প্রবেশ করে।
বিল গাজনা-বাদাই-যমুনা খাল খনন ও তার উপর স্লুইসগেট নির্মাণ হওয়ার পূর্বে পদ্মা নদী থেকে কয়েকটি প্রাকৃতিক ক্যানালের মাধ্যমে বিল গাজনায় পানি প্রবেশ করতো। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যানালগুলো হলো চর সুজানগর হয়ে সুজানগর পৌরসভার কোল ঘেঁষে বান্নাই কোল হয়ে নেকের বনগ্রাম পোড়াডাঙ্গা হয়ে বিল গাজনা। নিশ্চিন্তপুর থেকে কাচুরির কোল হয়ে শাহপুর ও মঠবাড়িয়া পাশ দিয়ে মতির বিল (বিল গাজনা)। শ্যামনগর ভাটপাড়ার মধ্য দিয়ে মানিকহাটের পশ্চিম পাশ দিয়ে উলাট খয়রানের মধ্য দিয়ে বিল গাজনা। মালিফা হয়ে ভিটবিলার পূর্ব পাশ দিয়ে বোনকোলা হাটখালির মধ্য দিয়ে বিল গাজনা। বরখাপুর-নারায়ণপুর-সাগতা হয়ে বিল গাজনা। এসব ক্যানাল দিয়ে বর্ষা মৌসুমে পদ্মার পানি বিল গাজনায় প্রবেশ করতো এবং বিলের পানি জলাবদ্ধতা আকারে প্রায় সারাবছরই পানি থাকতো।
আরো পড়ুন চরদুলাই গ্রাম পরিচিতি
সে সময় বিলের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় রুই, কাতলা, বাঘার, ফলি, গজার, বোয়াল, পাঙ্গাশ ইত্যাদিসহ অসংখ্য ছোট ছোট মাছ পাওয়া যেত। কোন কোন মাছের ওজন ২০-৩০ কেজি পর্যন্ত হতো। গাজনা পারের মানুষ শীত মৌসুমের শুরুতে দলবেঁধে একসঙ্গে মাছ শিকার করতো যা ‘বাহুত’ নামে পরিচিত ছিল।
বিস্তৃতি: ১৬টি ছোট-বড় বিলের সমন্বয়ে সৃষ্ট এই বিল গাজনা। তন্মধ্যে মতির বিল, হাতিগারার বিল, সহিবাজের বিল, ডহার বিল, রামার বিল, গমগারার বিল, পশ্চিম চক বিল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিলটি সুজানগর উপজেলার একেবারে মাঝখানে অবস্থিত। সুজানগর উপজেলার সবগুলো ইউনিয়ন জুড়ে এর বিস্তৃতি।
বিল গাজনায় এক ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৫০০ হেক্টর, দুই ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৭৫০০ হেক্টর এবং তিন ফসলি জমি প্রায় ২০০০ হেক্টর। জলাভূমি ও পতিত জমি প্রায় নাই বললেই চলে। গভীর নলকূপ ৫টি, অগভীর নলকূপের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার এবং ৪০টির মতো শক্তিচালিত পাম্প আছে। ( সূত্র: সুজানগর উপজেলার কৃষি সংক্রান্ত ডাটাবেজ )
আরও পড়ুন সুজানগর উপজেলার নামকরণের ইতিহাস
অর্থের চারণভূমি: বিলটি সুজানগর উপজেলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকাংশ এর উপর নির্ভরশীল। সুজানগর উপজেলার কমবেশি ১০ টি ইউনিয়নের সাথেই বিল গাজনা সংযুক্ত রয়েছে। বিলের চারধারে আবাদি জমি ও সকল বসতি অবস্থিত। এই বিল গাজনার মাধ্যমেই এই এলাকার কৃষি ও মৎস্য অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়।
বিলের চারপাশে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার হেক্টর। এসব জমিতে পাট, পেঁয়াজ ও বিভিন্ন জাতের ধান উৎপাদন হয়। বর্তমানে এই বিলের জমি বাংলাদেশের মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। দেশের চাহিদার ৩০-৪০ ভাগ পেঁয়াজ এই বিলের জমিতে উৎপাদন হয়। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে পাট ও ধান উৎপাদিত হয়। গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিক হতে বিল গাজনায় ইরিগ্রেশন প্রজেক্টের আওতায় ইরি-বোরো ধান লাগানো শুরু হয়। এ সব কৃষি আবাদের ফলে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাদের জীবনযাপনে স্বচ্ছলতা আনয়ন করে।
এছাড়া বর্ষা মৌসুমে পাবনা ও সুজানগর উপজেলার বৃষ্টির পানি ও বাদাই স্লুইসগেটের মাধ্যমে যমুনা নদী থেকে এই বিলে পানি আসে যা মৎস্য চাষের বিশাল কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়। দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত বিল গাজনায় ছোট বড় প্রায় শতাধিক প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এসব মাছ এ অঞ্চলের মানুষের চাহিদা মিটিয়েও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মৎস্য আড়তে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন আমাদের দ্বারিয়াপুর গ্রাম
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিল গাজনার পরিবেশ। বিলের মাঝ দিয়ে উড়ে বেড়ায় নাম জানা অজানা নানারকম পাখি। জেলেরা মাছ ধরে চলেছে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে। কখনো বা এক ঝাঁক সাদা বক পতপত শব্দে উড়ে যায় নীল আকাশ শুভ্র সাদা করে। বিলে শাপলা পদ্ম ফুল ফোটে যা বিলকে অপরুপ সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে।
প্রতি বছর বর্ষার মৌসুম এলেই বিল গাজনা পানিতে থই থই করে। আর এই পানি থাকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত অবস্থান করে। তখন সবুজ শ্যামল গ্রাম বেষ্টিত বিশাল বিস্তৃত গাজনার বিল সত্যই অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। এক সময় রংবেরঙের পালতোলা নৌকায় বিলে মানুষ একগ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াত করতো।
দর্শনীয় স্থান: বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এ সময় দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসে বিল গাজনায় নৌ-ভ্রমণ করতে। বিশেষ করে শুক্র-শনি সরকারি ছুটির দিনে পর্যটকদের নৌ-ভ্রমণে বিল গাজনা মুখরিত হয়ে উঠে। পর্যটকদের নৌ-ভ্রমণের জন্য বিখ্যাত খয়রান ব্রিজ, চরবোয়ালিয়া, গোড়ার ভিটা, শারীর ভিটা, বস্তাল, বাদাই স্লুইসগেট এবং বোনকোলা ব্রিজ পয়েন্ট। এসব পয়েন্টে বাণিজ্যিকভাবে রাখা হয়েছে ইঞ্জিন চালিত বড় নৌকা ও ডিঙি নৌকা। তাছাড়া, পর্যটকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে মাঝে-মধ্যে বিলের খয়রান ব্রিজ পয়েন্টে রাখা হয় বিশাল বাইচ-এর নৌকা। পর্যটকরা এসব বাইচ’র নৌকায়ও বিল ভ্রমণ করে থাকেন। তবে বাইচ-এর নৌকায় সাধারণত স্থানীয় পর্যটকরা ভ্রমণ করেন। পর্যটকরা সকাল থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত বিলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত নৌ-ভ্রমণ করেন।
আরও পড়ুন সুজানগর উপজেলার ইতিহাস
বিল গাজনার নামে প্রতিষ্ঠান: ১৯৭২ সালে রানিনগর গ্রামে একটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যার নামকরণ করা হয় রানিনগর বিলগাজনা উচ্চ বিদ্যালয়। যা বর্তমানে মহাবিদ্যালয় হয়ে রানিনগর বিল গাজনা স্কুল এন্ড কলেজ নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মো. আহসান হাবিব।
বর্তমানে শুকনো মৌসুমে বিল গাজনার মাঠে প্রবেশের জন্য বিভিন্ন গ্রাম হতে জলডোবা পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে কৃষকেরা জমির ধান পেঁয়াজ ও অন্যান্য ফসলে সহজে ঘরে তুলতে পারে।
সুজানগর উপজেলার কৃষি অর্থনীতির প্রাণভোমরা বিল গাজনা বা বিল গন্ডহস্তী।