বাংলার সুবাদার শাহ সুজা
বাংলার সুবাদার শাহ সুজা
শাহজাদা সুজা ছিলেন সম্রাট শাহজাহান ও সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের দ্বিতীয় পুত্র। ১৬১৬ সালের ২৩ জুন তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
শাহজাহান ইসলাম খান শাহ সুজাকে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ১৬৩৯ সালে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। ১৬৪২ সালে তাঁকে ঊড়িষ্যা প্রদেশের দায়িত্বও অর্পণ করা হয়। ১৬৩৯-১৬৬০ সাল পর্যন্ত বিশ বছরের কিছু অধিক সময় ধরে তিনি প্রদেশ দুটি শাসন করেন।
শাহ সুজার নিযুক্তির সময় ঢাকা সুবাহ-বাংলার রাজধানী ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি রাজধানী রাজমহলে স্থানান্তরিত করেন । শাহ সুজার শাসনকালে বাংলা ও ঊড়িষ্যা প্রদেশ দুটিতে মোটামুটি শান্তি বিরাজ করছিল; কোন অংশেই কোন বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়নি। প্রকৃত পক্ষে জমিদার ও দুষ্কৃতিকারীরা সুবাদার হিসেবে শাহজাদাকে দেখে হতবিহবল হয়ে পড়ে। তদুপরি সুজার উপর কেবল দুই প্রদেশের (বাংলা ও ঊড়িষ্যা) সুবাদারির দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে নি, তিনি কামরূপ ও আশ্রিত রাজ্য কুচবিহার দখল করেন, যা তৃতীয় আর এক প্রদেশের সমতুল্য ছিল এবং এটিও তাঁর অধীনে দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে সুজা পূর্ব ভারতের ভাইসরয় ছিলেন।
আরও পড়ুন সুজানগরের নামকরণের ইতিহাস
১৬৫৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সমগ্র সাম্রাজ্যে গুজব রটে যে সম্রাট মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর বড় পুত্র দারাশিকো সিংহাসনে তাঁর অবস্থান দৃঢ়করণের জন্য তা গোপন রেখেছেন। বাকি তিন যুবরাজ সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী অভিমুখে যাত্রার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সুজা রাজমহলে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন ও রাজকীয় উপাধি গ্রহণ করেন। গঙ্গা নদীতে বহু সংখ্যক যুদ্ধের নৌকা সজ্জিত করে বিরাট বাহিনী নিয়ে তিনি রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হন। বাহাদুরপুরের তুমুল যুদ্ধে (আধুনিক উত্তর প্রদেশ, ভারত) দারার বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে আবার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সুজা রাজমহলে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে আওরঙ্গজেব দুবার (ধর্মাট ও সামগড়ে) দারাকে পরাজিত করেন এবং তাঁকে বন্দি ও হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুজা আবারও রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হন। এবার তাঁর অভিযান ছিল আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে। ১৬৫৮ সালের ৫ জানুয়ারি খাজোয়াতে (ফতেহপুর জেলা, উত্তর প্রদেশ, ভারত) যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধেও সুজা পরাজিত হন। তিনি বাংলার দিকে পশ্চাদপসরণ করেন।
মীরজুমলার অধীন রাজকীয় বাহিনী দ্বারা ভীষণভাবে তাড়িত হলেও সুজা প্রতিটি জায়গায় তাদেরকে বাধা দিতে থাকেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ১৬৬০ সালের এপ্রিল মাসে চূড়ান্ত যুদ্ধে তিনি পরাজয় বরণ করেন। প্রতিটি পরাজয়ের পর স্বীয় বাহিনীর সেনারা তাঁকে ছেড়ে যেতে থাকে কিন্তু তিনি তাতে হতোদ্যম হন নি। তিনি বরং নতুন উদ্যমে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করেন। কিন্তু তান্ডাতে যখন চারদিক থেকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ছিলেন এবং সৈন্য পুনর্গঠিত করা আর সম্ভব নয় মনে করলেন তখন চিরকালের জন্য তিনি বাংলা (এবং ভারতবর্ষ) ত্যাগ করে আরাকানে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সপরিবারে এবং দলবল নিয়ে ১৬৬০ সালের ৬ এপ্রিল তান্ডা ত্যাগ করে এপ্রিলের ১২ তারিখে ঢাকা পৌঁছেন।
আরও পড়ুন সুজানগর উপজেলার ইতিহাস
নিরুপায় সুজা আশ্রয় ও সহযোগিতার জন্য আরাকান রাজ্যের সাথে যোগাযোগ করেন। আরাকান রাজ আশ্বস্ত করলে দুর্ভেদ্য পার্বত্য অঞ্চল অতিক্রম করে নাফ নদী পার হয়ে মাত্র ৪০ জন অনুচর ও ২০০জন দেহরক্ষী নিয়ে তিনি আরাকানের রাজধানী রোসাঙ্গ পৌঁছান। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী পরীবানু, তিন কন্যা এবং এক পুত্র। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় আরাকানের রাজসৈন্যরা।
যদুনাথ সরকারের ‘হিস্ট্রি অব আওরঙ্গজেব’ এবং অ্যালবার্ট ফিচ-এর ‘বার্মা: পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’ বই থেকে জানা যায়, রাজা চন্দ্র সুধর্ম আশ্রয় দেওয়ার বিনিময়ে শাহ সুজার বড় মেয়ে গুলরোখকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু শাহ সুজা প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এবং রাজা চন্দ্র সুধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও সিংহাসনচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেন। এটা ছিল তাঁর উচ্চবিলাসী ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। চন্দ্র সুধর্মের অনুচর ও গুপ্তচর ছিল শাহ সুজার আশেপাশে। বিদ্রোহের গোপনীয়তা রক্ষা হয় না। বাধে সংঘাত। এই যুদ্ধে শাহ সুজা পরাজিত হন এবং জঙ্গলে পালিয়ে যান। কিছুদিন জঙ্গলেই লুকিয়ে থাকেন। রাজা চন্দ্র সুধর্মের দেহরক্ষীরা তাঁকে ও পলায়নরত অনুচরদের এক সময় ধরে ফেলে এবং জঙ্গলেই তাদের কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। মেয়েদেরকে ধরে আনা হয়। চন্দ্র সুধর্ম গুলরোখকে বিয়ে করেন (মতান্তরে তার হেরেমে রাখেন)। কয়েক মাস পরে চন্দ্র সুধর্মকে হত্যা চেষ্টার অপরাধে গুলরোখকে গর্ভবতী অবস্থাতেই হত্যা করা হয়। শাহ সুজার অন্য দুই মেয়েকে অন্ধকার খুপরিতে রেখে মারা হয়।
আরও পড়ুন সুজানগর পৌরসভার ইতিহাস
শাহ সুজার ভাগ্যে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল তা নিয়ে গবেষক ও ঐতিহাসিকরা নানা মত পোষণ করেন। কেউ বলেন, পলায়নকালে সুজা বনেই নিহন হন; কেউ বলেন, জঙ্গল হতে ধরে এনে তার শিরচ্ছেদ করা হয়। কারো মতে, সুজাকে বস্তাভর্তি করে সাগরে ডুবিয়ে মারা হয়। মৃত্যু ১৬৬০ সাল।
তথ্য সংগ্রহ: সুজানগরের ইতিহাস, ড. আশরাফ পিন্টু
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে