পুরাতন-বটবৃক্ষ
গল্প,  শফিক নহোর (গল্প),  সাহিত্য

পুরাতন বটবৃক্ষ

পুরাতন বটবৃক্ষ

শফিক নহোর

 

বড়খাঁপুরের মানুষজন কী বিচিত্র ধরনের! কেউ কেউ বলে, তারা নাকি চুলার ভেতরে ঠ্যাঙ দিয়ে ভাত রান্না করে।
অবাক হবার কথা, আমি নিজেও অবাক হলাম! বিষয়টি খুব সহজে নিতে পারিনি প্রথমে। এটাও কি সম্ভব! কী করে মানুষ এমন করতে পারে। কোন আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে আসলে, না খাইয়ে দুপুর পর্যন্ত রাখবে। সকালবেলা নদীর ধার দিয়ে হাঁটছি; আশেপাশের লোকজন খোলা মাঠে প্রকৃতির কাজ সেরেছে, চরম দুর্গন্ধ আসতে লাগল মৃদু বাতাসের সঙ্গে। নাকে হাত চেপে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম।
গ্রামের মানুষগুলোর সহজ-সরল সমীকরণ, খেয়ে পড়ে কোনো মত দিন পাড় করতে পারলেই বেঁচে যায়। কে কাকে নিয়ে এত ভাবে এখন? সে সময় কী মানুষের আছে এখন?
দরিদ্র ও স্বল্প শিক্ষিত কারো কারো বাড়িতে বাঁশের উঁচু পায়খানা আছে। তারা উপর থেকে ছাড়ছে, নিচে নদীতে ভেসে যাচ্ছে সেই ময়লা। সেই একই পানিতে গোসল, বাসন-কোসন, পরিষ্কার থেকে শুরু করে নানান কাজ করছে। বাচ্চা-কাচ্চা কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে দিনের পর দিন পরে আছে। অভাবের সংসারে একজন বেশি দিন অসুস্থ হয়ে থাকলে, মনে হয় মরে গেলেই শান্তি।

আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

নদী ভাঙ্গন পরিবারের কাছে কি সবসময় নগদ টাকা-পয়সা থাকে, তা থাকে না। সরকারি পয়ঃনিষ্কাশন সেনেটারী এসেছে ইউনিয়ন পরিষদে; তা সব সুর্যনগরের রাক্ষসদের পেটের ভেতরে গোল্লাছুট খেলছে। অসহায় দুখী মানুষ না খেয়ে দিনাতিপাত করছে। কারো জন্য কোন মায়া মমতা কাজ করে না এখন। মানুষজন রোবট হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। কেউ কারো নিয়ে ভাবছে না।
── কিডা গো, গফুর না কি রে?
── শমশের ভাই, তুমি এত সকালে নদীর পাড়ে? কোন কাজ আছে না কি?
── না রে, শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, একটু হাঁটতে বের হয়েছিলাম। নদীর পাড়ের যে অবস্থা। চল বাজারে গিয়ে এককাপ চা খেতে খেতে গল্প করি। তারপর বাড়ির দিকে রওনা দেবো। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে এমনিতেই অসুস্থ হয়ে যাবো।
── গফুর শুনলাম, শুকুর মাঝির মেয়ে বট তলায় ফাঁসি নিতে গিয়ে ধরা পড়ছে।
──লোকে মুখে তো তাই শুনছি। মেয়ে মানসীর মন বুঝা আর নদীর ঢেউ বুঝা বড়ই কঠিন। কোন তীর থেকে আসলো এ ঢেউ, বোঝা বড় মুশকিল।
── ঠিকই কইছো ভাই।
── আজ একটু চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি যাবো। জানি যেয়ে কোন লাভ হবে না। দফাদার আর কাজের মেয়েদের দিয়ে বাড়ি ভরা। তাদের অনেক কুকীর্তির কথা কানে আসে। এ মাসেও দুইজন কাজের মেয়ে হাসপাতালে গেছে। পাপও করবে, আবার মানুষও খুন করবে তার কোন বিচার নেই। পাপ কাজে সমাজটা নষ্ট হয়ে গেল। সন্ধ্যা লাগলে হিন্দু পাড়ায় জুয়ার আসর বসে, পরের ঘরে ঢিল ছুড়বে। সুন্দরী মেয়ে দেখলে জানালা দিয়ে উঁকি দিবে। সকালে আমার কাছে বিচার নিয়ে আসবে। চাচা আপনি মাতব্বর কিছু একটা করেন।

আরও পড়ুন গল্প রোদেলা দুপুর কাঁদে

──বলতো গফুর, আমি কী করতে পারি? আমি না চেয়ারম্যান, না মেম্বার। আজকাল নাকি মেম্বাররা টাকা খেয়ে সালিশ করছে। থানার দারোগা চেয়ারম্যানের বাড়িতে আসে ডাবের পানি খেতে। মাসে মাসে তার নতুন ডাব লাগে। চরিত্রহীন বদজাত কোথাকার। দারোগার চরিত্র এত নিচে নামলে, সমাজ চলবে কেমনে? আইন শৃঙ্খলা যাদের হাতে তারাই মূলা ধরে রাখে সাধারণ মানুষের চোখের সামনে।
── তা শুকুর, মাঝির মেয়ে গলায় ফাঁস দিতে গিয়েছিল কেন? মেয়েটি শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত, নম্র। কেউ কিছু বলছে নাকি?
── চল দেখি, শুকুর মাঝির বাড়ি হয়েই যাই।
ঘটনাটা আমাকে মানসিকভাবে খুব আঘাত করছে।
── শমশের ভাই, এভাবে ভেঙে পড়বেন না।
চারিদিকে যা দেখছি, এমন একটা দেশ তো আমরা চাইনি। এই জন্য তো আর দেশের জন্ন্যি যুদ্ধ করিনি। চারিদিকে রাঘব বোয়াল হা করে থাকে কখন কাকে খাবে। এখন সমাজে-সংসারে সব খাওয়ার মানুষ। যাকে তাকে যখন তখন গিলে খাবে।
── আসসালামু আলাইকুম, মাস্টার কাকা।
── এই তুমি কি শুকুর মাঝির মেয়ে?
── জি, কাকা।
── তোমার বাবা কি বাড়ি আছে?
── বাবা তো আজ ক’য়েক দিন হল নৌকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ গেছে, পোদ্দার বাড়ির পাটের নৌকা নিয়ে। দাঁড়িয়ে আছেন ক্যান, কাকা? ভিতরে আসেন।
── শুনলাম, তুমি নাকি গলায় ফাঁস দিতে চেয়েছিলে?
──কাকা, মিথ্যা বলবো না। আমি গলায় ফাঁস নিতে গেছিলাম। কিন্তু মানুষের জন্যই মরতে পারি নি।
── জীবনের প্রতি তোমার এত মায়া কম! আমার বয়স হয়েছে, তাও খুব বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীটা কত সুন্দর দেখ!
── আর তুমি ছোট মানুষ। এত অল্প বয়সে মরে যেতে চাও?
── আমি বিএ পাশ করছি কাকা, চাকরি টাকরি হচ্ছে না। যেখানে যাই, সেখানেই কুয়া কেটে ব্যাঙ আনার মত অবস্থা। পুলিশে লোক নিবে, চেয়ারম্যান সাহেবকে জানিয়েছিলাম। চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে বললেন,
── দারোগার সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক আছে। একদিন বাড়িতে আয়, দারোগার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। দারোগা বেটা শয়তানের একশের। এরচেয়ে বেশি কিছু আপনাকে বলা যাবেনা কাকা।
── ছিঃ ছিঃ। থাক, আর বলতে হবে না। আমি যাই রে মিনু, অন্য একদিন আসব।

আরও পড়ুন গল্প  স্বপ্ন জল

প্রকৃতির অপরূপ রূপের সাগরে ভেসে আসে আমার হারানো যৌবন। বটবৃক্ষের মতন দাঁড়িয়ে থাকে আমার অলস দুপুর। সাঁঝের বেলায় বাড়ি ফেরা যুবকের বুক পকেটে থাকে তিলে খাজা। যে অর্ধেক খেয়ে, বাকিটা আমাকে দেওয়ার জন্য ঘোষ বাড়ির শ্মশান ঘাট পাড় হয়ে পুরাতন বট গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো, সেই মানুষটা আমাকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারে! নাকি আমার কোথাও ভুল হচ্ছে। মিলন তো কখনো এমন ছিলনা। এই দেহের প্রতিটি রক্ত কণিকায় তার চিহ্ন আমাকে বিষের বেদনায় নীল করে দেয়।

বটবৃক্ষের ঝড়ে পড়া পাতার মত আমি পরে আছি, অভাবী শুকুর মাঝির সংসারে। কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার বিমূর্ষতাপূর্ণ চাহনিতে, পরাজিত হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে বিষ সাপের ছোবলের তীব্র বেদনা। আমার জন্য বাবা কিছুই করতে পারেনি। মা প্যারালাইসিস হয়ে ক’বছর ঘরে পরে আছে। ইচ্ছে থাকলেও আমাকে বিয়ে দিতে পারছে না। বাবা নিজেও আর একটা বিয়ে করছে না। মা আমাদের মাঝে বেঁচে থাকার চেয়ে এখন মরে যাওয়া অনেক ভাল। একজন মানুষ কতকাল অসুস্থ থাকে। অনন্ত দুটি মানুষের জীবন মুক্ত পাখির মত ডানা মিলে আকাশে উড়তে পারত।

আমার হাতে মিলনের দেওয়া চিরকুট, আজ রাতে আমরা পালিয়ে বিয়ে করবো। রাতে বট গাছের নিচে থাকতে বলেছে আমাকে। আমি মাকে ফেলে কেমন করে যাবো? এদিকে অনাগত অতিথী নতুন পৃথিবী দেখার অপেক্ষায় আছে। নয়-ছয় ভাবতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
দরজা খুলতেই দেখি মিলন।
── ফিসফিস করে বলছে, এত দেরি করছো কেন?
── তাড়াতাড়ি আসো, তোমার সঙ্গে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
── একটু দাঁড়াও। ব্যাগটা নিয়ে আসছি।
── ব্যাগ লাগবে না, এমনি আসো।
── মানে কী? ব্যাগ লাগবে না কেন?
দু’ঘরের মাঝখানে যেতেই পায়ে আঘাত পেলাম। মিলন আমার হাত ধরে টেনে ধরতে চাইল। আমি তার আগেই উঠে গেলাম। ঝিরঝির বাতাস, নদীতে নতুন জোয়ারের পানি এসেছে। শত বছরের বট গাছটির নিচে বসলাম দু’জন।

আরও পড়ুন গল্প লালু

আমাকে আলতো আলিঙ্গন করে মিলন বলল,
── একটা ভাল খবর আছে।
── কি গো সেই ভাল খবর?
── আমার চাকরি হয়েছে, পুলিশের। আগামীকাল সকালে ঢাকা যাবো।
── তোমার পেটে কার বাচ্চা? এসব ভেজালের ভেতরে আমি নেই।
আমার চোখ ভিজে উঠছে, অন্ধকার আরও গাঢ় হল। ঠিক নিজেকে দেখা যাচ্ছে না। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি মিলন নেই।
এই বটবৃক্ষ আমাদের প্রেমের সাক্ষী ছিল। নিশীথের আলিঙ্গনের সাক্ষী ছিল। শত বছরের পুরাতন বটবৃক্ষটি নদীর বুকে আত্মসমর্পণ করছে ধীরে-ধীরে, আমি থেকেই কি হবে। নিজের প্রতি এক ধরণের ঘৃণা তৈরি হয়।
শুকুর মাঝি, ঢাকা থেকে পাটের খালি নৌকা নিয়ে দৌলতদিয়া ঘাট পার হয়ে সামনে আসতেই দেখে, একটা মানুষ বাঁচার জন্য চেষ্টা করছে। দূর থেকে আলো আঁধারের জন্য মুখ ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। নৌকার গতি একটু কমিয়ে, একটা দড়ি ফেলে দিল। ব্যর্থ অসহায় হাত সে দড়ি ধরতে পারেনি। উপর হয়ে ভাসছে।
──শুকুর মাঝি, দেখছো এটা কিন্তু মেয়ে মানসীর লাশ! মেয়ে মানুষ পানিতে ডুবে মরলে উপর হয়ে লাশ ভাসে। জানটা মনে হয় এখনি বের হলো, দেখছো মাঝি?
──সামাদ ভাই, তুমি নৌকার হালটা ধরো আমি একটু পানিতে নেমে দেখি…
── দেখছিস ভাই, আমার চাঁদ নদীতে ভাইসা আসছে।
চিৎকার শুনে নিচে নামতেই সামাদ আর কিছু দেখতে পেল না পানির ভেতর। চারিদিকে শুধু অন্ধকার আর নদীর ঢেউ।
এ গ্রামে এত শিক্ষিত মানুষ, কত বড়-বড় অফিসার, কেউ একটা পুরাতন বটবৃক্ষকে বাঁচাতে পারেনি।
সকালে সবাই জানতে পারল বড়খাঁপুরের পুরাতন বটবৃক্ষ আর নেই। নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। ভেসে গেছে শুকুর মাঝির পরিবার, ছোট ছোট পাপ গ্রামে ঢুকলে কোন কোন মানুষের উপর তা পরে। শুধুমাত্র অবহেলার কারণে মায়ের মতো পুরাতন একটি বটবৃক্ষ বিলীন হয়ে গেল।

আরও পড়ুন শফিক নহোরের গল্প-
চোখে দেখা নীলকণ্ঠ
আড়ালের চোখ
নীরুর মা

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

পুরাতন বটবৃক্ষ

Facebook Comments Box

শফিক নহোর মূলত একজন গল্পকার। এছাড়া তিনি প্রতিনিয়ত অণুগল্প, ছোট গল্প ও কবিতা লিখে চলছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: মায়াকুসুম, বিষফুল, কসুর; কাব্যগ্রন্থ: মিনুফুল তিনি ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নওয়াগ্রামের শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!