পুতুল
গল্প,  শফিক নহোর (গল্প),  সাহিত্য

পুতুল

পুতুল

শফিক নহোর

একবার প্রিয় মুখখানি দেখার জন্য হাজারটা মিথ্যে অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হতাম; সময়ে-অসময়ে। তখন আমি সদ্যকৃত যৌবনপ্রাপ্ত উত্তাপিত তরুণ। অনেক কিছুই পাবার সাধ স্ফুরিত হতো মনের গহীনে, তবুও নিজেকে আড়াল করে রেখেছি; নিজের স্বত্বাকে বিশুদ্ধ রাখতে। সবাই ঘুমিয়ে পড়বার পর, বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে ভিসিআর দেখার জন্য। বাড়ির অদূরে পুতুলদের বাড়ি। মনের ভেতর সবসময় আনচান করত এই বুঝি পুতুল আসছে। নায়ক-নায়িকাদের জীবন সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ ছিল আমার; সেই কিশোর বয়স থেকেই।

 দুই বা দেড়খান সিনেমা দেখানোর পর, আর দেখতে দিত না। হাজারটা অজুহাতে ফিরেয়ে দিত সবাইকে। কোনো কোনো  দিন ঘাড় ত্যাড়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সমাজ সংসারের চোখের আড়ালে। মানুষের আড়ালে একটু কথা হতো পুতুলের সঙ্গে। পাহারাদার হিসাবে ওর চাচাতো বোন থাকত; দুঃখের বিষয় সে বিপরীত! পুতুল, তখন ফিরে যেত বাড়ি পলাতক শিশুর মতো। মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একদিনও রেহাই পায়নি সে। এরপর থেকে পরের বাড়িতে টেলিভিশন  দেখা বন্ধ হলো চিরতরে। আমার ভেতরটা কেঁদে ওঠে পুতুলের জন্য আজও। সেই সময়ের স্মৃতি আমাকে তাড়িত করে মনের গভীরে। তাকে নিয়ে হারিয়ে যাই একাকি; অজানা ভুবনে দুজন নিস্পলক চেয়ে থাকি মুখোমুখি।

আরও পড়ুন গল্প মাধবী নিশীথিনী

এখন বাড়ি ফিরে যাওয়া আগের মতো আর টানে না আমার। আমগাছগুলোর একটি করে নাম দিয়েছিলাম। প্রথম যে গাছটির নাম রেখেছিলাম ‘পুতুলের সঙ্গে প্রথম প্রণয়ের প্রহরে’। যেদিন প্রথম প্রেমের পত্র দিয়েছিলাম পুতুলকে; সেদিন যে আমগাছটির নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটির নাম ছিল ‘’পত্র-মিতালী’, তারপর ‘সাক্ষী’! অবশেষে একটি গাছের নাম দিয়েছিলাম ‘মধু-মিলন’। তখন আমি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র; পুতুলকে দেখতে এসেছে বরপক্ষ। যদিও সে তখন বিয়ের উপযুক্ত নয়। তবুও গ্রামের বিয়ের প্রচলন ছিল খুব। বেদনাদায়ক একটা বিষয় বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ তো দূরের কথা বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠত সবাই। এ যাত্রায় পুতুলের বিয়ে হলো না; তার বিশেষ কারণ হলো বরপক্ষ মোটরসাইকেল চেয়েছিল যৌতুক হিসবে। পুতুলদের সংসারের অভাব ছিল চোখে পড়বার মতো দৃশ্যমান। আমি দোয়া করতাম বিয়ে যেন  না হয়। মনে-মনে কতভাবে যে পুতুলকে আমি চাইতাম! সে কথা আমার ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানে না।

আমার বাবা কোনো মতো সংসারটা চালিয়ে নিত। তাই কখনো আবদার করে বলা হয়নি, বাবা আমাকে এটা দিতেই হবে, যেমনটি আমার সহপাঠী রানা চাইত ওর মা-বাবর কাছে। আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি আসবার পরের দিন। মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ল। মাকে দেখার জন্য সংসারে একজন মানুষ ভীষণ দরকার ছিল, অথচ দিন শেষে বাড়ির পোষা কুকুরকে অবশিষ্ট উৎশিষ্ট দেবার সক্ষমতা ছিল না আমার পরিবারের।

আরও পড়ুন গল্প কালো কঙ্কাল

আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল অজানার দেশে। মা চাইত পুতুলের মতো আমার ছেলের একটা বউ হোক। মাকে হারিয়ে অনেকটা একা হয়ে গেলাম। নিজের ভালো-মন্দ নিজেকে-ই দেখতে হতো। তাই নিজেকে শত আঘাতের পরেও দুর্বল ভাবিনি কখনো। সামনে এগিয়ে যাবার তীব্র বাসনা আমাকে পিছু হটাতে পারেনি। আমি ভর্তি হলাম কলেজে।

পুতুলের পরিবার অনেকবার আমার থেকে পুতুলকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলেও করতে পারেনি; তার বিশেষ অবদান ছিল পুতুলের। সে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী হিসাবে  মেনে নিবে না, তা  জানিয়ে দিয়েছে। পুতুলের জেদের কাছে হার মেনেছে ওর পরিবার। কিন্তু নাটকীয়ভাবে পুতুলও পরিবর্তন হয়ে গেল অল্প সময়ের মধ্যে। সময়ের কাছে আমিও পরাজিত হলাম কারণে-অকারণে। আমার কোনো কাজকর্ম ছিল না। বেকার একজন মানুষের সঙ্গে কোন পরিবার চাইবে মেয়েকে তুলে দিতে। পুতুলের বিয়ে হয়ে গেল, প্রবাসী বিত্তশালী ছেলের সঙ্গে। পুতুলের পরিবার চাইলে হয়তো অনেক কিছুই সম্ভব ছিল। ‘মানুষের চোখ একবার উপরে উঠে গেলে নিচে আর নামতে চায় না।’ মানুষই একমাত্র প্রাণী, মরে না যাওয়া পর্যন্ত তার লোভ মরে না।

আমি চোখের জল মুছি আর নিজেকে প্রশ্ন করি। তোমাকে ধরে রাখার যোগ্যতা আমার হয়নি।

আরও পড়ুন গল্প সে আমার কেউ না

বুকের পাঁজরে ব্যর্থতাকে পুঁজি করে বেঁচে থাকতে হবে। আর স্বার্থপর পৃথিবীতে মানুষের চরম অবহেলা ও তীব্র তিরস্কার আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমার পড়াশোনা করা হলো না। অভাবের তাড়নায় বাড়িতে কিছুদিন ছিলাম পালাতক আসামির মতো। এই বাড়িতেই আমি চাইলে কি-না হতো একদিন। আর আজ আমি সবার অপ্রকাশিত দুশমন, বসতবাড়ির জমি নিয়ে। অবশেষে অফিস সহকারী হিসাবে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছি। যদিও মামার সাহায্য ছাড়া সম্ভব ছিল না।

বিয়ের পর থেকে পুতুলের সঙ্গে তার স্বামীর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এ নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে, বাড়ির লোকজন খুব চেয়েছিল; এত সুন্দর একটা ছেলে, অঢেল টাকাপয়সা, তার মতো ছেলেকে হাত ছাড়া করা বোকামি। পুতুলকে বোঝাতে উঠেপরে লেগেছিল ওদের বাড়ির মানুষ। দশের চক্রে ভববান অস্থির সেখানে সহজ-সরল গ্রাম্য স্কুল পড়ুয়া একটি মেয়ে মানুষের কানকথায় ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে এটা খুব স্বাভাবিক।

 যদিও অনেক কিছুর পর স্বামীকে মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছিল পুতুল। স্বামী নেশায় আসক্ত; কোনোভাবেই নেশা থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। শেষমেশ কী আর করা, পুরোনো অধ্যায়ে ফিরে যেতে চায়। মানুষ চাইলেই কি সবকিছু পায়, না। অপূর্ণতা মানুষের থাকবেই। মানুষের জীবনের এই নাটকীয়তা সবাই সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। ঠিক তখনই জীবন অসুন্দর হয়ে উঠতে শুরু করে।

আরও পড়ুন গল্প রক্তে জ্বলে একাত্তর

আমার সঙ্গে  যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। আমি তখন মোবাইলফোন  ব্যবহার করতাম না। চিঠি পাঠানোর ঠিকানা জানা ছিল ওর। তবে তা এখন ভুল ঠিকানায় তাহিরা ন্তর হয়েছে। মনের দিক দিয়ে অনেক ভেঙ্গে পরেছিল পুতুল। ‘আঘাত করার সীমারেখা অতিক্রম করা বড্ড বেমামান। পুতুলের নিজের প্রতি সৃষ্টি হয়েছিল চরম ঘৃণা; বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না। মানসিক আঘাত সে সহ্য করতে পারেনি। মানসিক বিকৃত মস্তিষ্ক পরিণত হয় অবশেষে। পৃথিবীতে তোমরা শুধু টাকা চিনেছ, আমার হৃদয় চিনতে পারনি কখনো। মাঝে মাঝে আমার চোখ আবেগে ভিজে ওঠে; করুণা হয় পুতুলের জন্য। করুণা নয়, ঠিক ভেতরটা কেঁদে ওঠে নিদারুণ অপেক্ষায়।

অনেক বছর পরে হঠাৎ উদয়পুর পোস্ট অফিসে আমার নামে পুতুলের চিঠি। সে চিঠি আমাকে সাত-পাঁচ ভাবতে  শেখায় নতুন করে। সংবাদ পেলাম, পুতুল বাবার বাড়িতে চলে এসেছে। আমাকে আজ দেখা করবার জন্য সংবাদ পাঠিয়েছে গোপনে। এই দেখা করা অন্যায় না-কি বোকামি, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করছি, বিপদে মন যা সায় দেয় তাই করা মঙ্গলময়। আমিও আমার আত্মর ভেতরের যে মানুষ বসবাস করে তাকে প্রশ্ন করলাম; জবাব যা এল সেই নিয়মেই চললাম। ওদের বাড়ির পেছনে বড়ো একটা বকুলগাছ ছিল; শানবাধাঁনো। বকুলগাছের নিচে বসে দুজন কথা বলছি, কথা শেষ হয়েও মনে হচ্ছে তখনো শুরুই করিনি। দুজনের আবেগতারিত্ব কথা আমাদের যতটুকু দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলা উচিত, সেই দুরত্ব দুজনের কেউ মেনে চলিনি। আবেগ মাঝেমধ্যে মানুষের ভেতরে অনিয়ম তৈরি করে। সেই অনিয়মের ঢেউ কখনো কখনো সুখের দুয়ারে আঘাত হানে।

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

পুতুল

Facebook Comments Box

শফিক নহোর মূলত একজন গল্পকার। এছাড়া তিনি প্রতিনিয়ত অণুগল্প, ছোট গল্প ও কবিতা লিখে চলছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: মায়াকুসুম, বিষফুল, কসুর; কাব্যগ্রন্থ: মিনুফুল তিনি ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নওয়াগ্রামের শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!