পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রিভিউ
পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রিভিউ
জাহিদুল ইসলাম
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা রত্নগর্ভা হাজারো নদীবেষ্টিত একটি বদ্বীপ বাংলাদেশ। পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই ক্ষুদ্র মানচিত্র এক সমুদ্র রক্ত দিয়ে কেনা। লাল-সবুজ পতাকা আর এ দেশের কাঁজল মাটি এদেশের সরল মানুষের বহিঃপ্রকাশ। এই বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস মোটেও সহজ নয়। নানা বন্ধুর পথ পেরিয়ে হাজারো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে আজকের বাংলাদেশ। পাকিস্তানের জাতির পিতা হওয়ার মোহে আচ্ছ্বন্ন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ দ্বি-জাতি তত্ত্ব যা শুধুমাত্র ধর্মকে কেন্দ্র করে প্রবর্তিত; ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলো। দ্বি-জাতি তত্ত্ব হাজার মাইল ব্যবধানের সুদূর দুটি প্রদেশকে একত্রিত করেছিলো। একটি পশ্চিমপাকিস্তান অন্যটি পূর্বপাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ ছিলো উর্দু ভাষাভাষি এবং একটু শক্তিশালী। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠি ছিলো বাংলা ভাষাভাষী এবং দুর্বল-পিছিয়ে পড়া। পাকিস্তানের এই দুটি প্রদেশের মধ্যে শুধুমাত্র ধর্ম ব্যতীত ভাষা-সংস্কৃতি কিংবা কোন সামঞ্জস্য ছিলো না।
দীর্ঘ ২৩ বছরের নানা সমস্যায় জর্জরিত এই জনপদের মানুষ চুড়ান্ত সংগ্রামে উপনীত হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খার প্রতীক। বাংলার আপামর জনতা দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। জন্ম হয় বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মত একটি সুপ্রশিক্ষিত-সুস্বজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আপামর জনতার এই তীব্র প্রতিরোধ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহিদ হন ৩০ লক্ষ মানুষ। দু’লক্ষ নারী হারান তাঁদের ইজ্জত। ১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ দিক ছিলো গণহত্যা, নারী-শিশু ধর্ষণ, হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ। এই অপরাধে পাকিস্তানি বাহিনীকে সরাসরি সহযোগিতা করেছিলো এই দেশের কিছু কুলাঙ্গার। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন গণহত্যা ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নিরীহ মানুষকে একত্রে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। সেসব গণহত্যা-নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনা শুনলে এখনো আঁতকে ওঠে সবাই।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাবনায় সংঘটিত ঘটনাগুলো সারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলের এ. কে খন্দকার (বীরউত্তম), অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, রফিকুল ইসলাম বকুল, জহুরুল ইসলাম বিশু’র মত হাজারো বাঘা বাঘা যোদ্ধার কৃতিত্বের কথা সারা বাংলাদেশে এক বাক্যে উচ্চারিত হয়। অন্যদিকে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা আব্দুস সুবহান, মাওলানা ইসহাক আলীর মত স্বাধীনতা বিরোধীদের কলংকও জড়িয়ে রেখেছে পাবনার ইতিহাসকে। উল্লেখ্য পাবনায়ই প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। এই পাবনাতেই প্রথম বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনা উপাধি ঘোষণা করেন। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধে পাবনা জেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। পাবনা জেলার বহু এলাকায় এখনো পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর অত্যাচার ও গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের নানা ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকদের লেখা একত্রিত করে ড. আশরাফ পিন্টু সম্পাদনা করেছেন ‘পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থটি।
‘পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থটি সমগ্র পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম সম্পাদিত গ্রন্থ। এর পূর্বে পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কয়েকজন লেখকের গ্রন্থ রচিত হয়েছে তবে তা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নয়।। পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থের প্রকাশক প্রকাশনা সংস্থা গতিধারা প্রকাশনীর সত্ত্বধিকারী সিকদার আবুল বাশার। তিনি একজন প্রথিতযশা প্রকাশক। বাংলাদেশের প্রকাশক-লেখক সমাজে তিনি বিশেষ পরিচিত। সবাই তাঁকে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ বলেই জানে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অ লের ইতিহাস-ঐতিহ্য-মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ গতিধারা প্রকাশনীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের এ সকল বিষয় নিয়ে গতিধারা প্রকাশনী প্রায় ২০০০ (দুই হাজার) গ্রন্থ প্রকাশ করেছে, যা বিস্ময়ের বিষয়। পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থটির সম্পাদক ড. আশরাফ পিন্টু পেশায় একজন শিক্ষক। পাবনা জেলার বিভিন্ন লোকজ ও ইতিহাস গবেষণায় তিনি বিশেষ সুনাম কুড়িয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৬টি।
পাবনা জেলার ইতিহাস গ্রন্থটি সুচিন্তিতভাবে কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। ৫৯২ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে সর্বমোট ৭৪ জন লেখকের লেখা ইতিহাস-গবেষণা ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যকর্ম স্থান পেয়েছে। পাবনা জেলার ৯ টি উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাস ধারাবাহিক উপস্থাপন করা হয়েছে যা বইটিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে। এই বইটির আরো ভালো লাগার বিষয় হলো এই গ্রন্থে যাঁদের লেখা স্থান পেয়েছে তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ লেখকই মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। কয়েকজন বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির উজ্জল নক্ষত্র। যাঁদের নাম বারবার উচ্চারিত তাঁদের কর্মগুণে। পাবনাবাসী আমরা তাঁদের নিয়ে গর্ব করি যে, তাঁরা পাবনায় জন্মগ্রহণ করেছেন। এ. কে খন্দকার (বীর উত্তম), ড. আবু সাইয়িদ, রফিকুল ইসলাম বকুল, রণৈশ মৈত্র, জহুরুল ইসলাম বিশু, রশিদ হায়দার, মাকিদ হায়দার, জিয়া হায়দার, দাউদ হায়দার, বন্দে আলী মিয়া, ওমর আলী, সরদার জয়েনউদ্দিন, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, মনোয়ার হোসেন জায়েদী, রবিউল ইসলাম রবির নাম উল্লেখ করার মত।
পাবনা জেলার পরিচিতি, পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধ (সার্বিক), পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধ (উপজেলা ভিত্তিক), মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা এবং বিবিধ শিরোনাম বা ৫ টি অনুচ্ছেদে গ্রন্থটিকে সাজানো হয়েছে। ১৯ থেকে ৪৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সূচিপত্রের সাথে পাবনা জেলার একটি ভৌগলিক মানচিত্র, পাবনা জেলার বিভিন্ন স্থান, বিভিন্ন এলাকার বধ্যভূমি ও গণকবর এর ছবি, বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধের ছবি এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন পত্রিকা যা পাবনার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর সর্বমোট ৭১ টি ছবি সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ৪১ পৃষ্ঠায় আটঘরিয়া উপজেলার বেরুয়ান গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা, সড়াবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম শহিদুল্লাহ্র মুক্তিযুদ্ধকালীন সমরক্ষেত্র থেকে তাঁর প্রিয়তম স্ত্রী ফাতেমা খাতুনকে লেখা একটি চিঠির ছবি যুক্ত করা হয়েছে।
৭৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থের সম্পাদক নিজেই লেখকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি ‘পাবনা জেলার পরিচিতি’ শিরোনোমে পাবনা জেলার প্রাচীন ইতিহাস থেকে শুরু করে ভূ-প্রকৃতি, পুরাকৃতি, আবহাওয়া-জলবায়ু, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-যোগাযোগ, শিল্প-সংস্কৃতি, নদ-নদী, জনজীবন, রাজনৈতিক ইতিহাস, জনপ্রতিনিধি, গ্রাম-মহল্লা, জনসংখ্যা ইত্যাদি বিষয় উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। লেখক-গবেষক-সম্পাদক ড. আশরাফ পিন্টুর পাবনা জেলার সার্বিক ইতিহাস পড়ে আমরা পাবনা জেলার আদিকাল থেকে এ পর্যন্ত ইতিহাসের একটি সারসংক্ষেপ অবগত হতে পারি খুব সহজেই।
পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক ইতিহাস সুক্ষ্মভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ড. আবু সাইয়িদ। ‘‘যমুনার জল ছুঁয়ে যাওয়া সেই জনপদ: মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট’’ শিরোনামে তিনি পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটসহ সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ১৪ পৃষ্ঠার এই রচনায় তিনি তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর সাহচার্যতার কথা বার বার উল্লেখ করেছেন। সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ছাত্ররাজনীতি, বঙ্গন্ধুর পাবনায় আগমন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি ও কর্মরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর স্মৃতি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সাঁথিয়া-বেড়া-সুজানগর তথা পাবনা অঞ্চলে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বিভিন্ন দিকে তুলে ধরেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর সাংগঠনিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিবরণ আমরা পাই তাঁর লেখায়।
মুক্তিযুদ্ধে পাবনা জেলা শিরোনামে পরবর্তী লেখাটি লিখেছেন পাবনাবাসীর আতি পরিচিত ও প্রিয় মুখ, একুশে পদকপ্রাপ্ত গবেষক-কলামিষ্ট, রাজনীবিদ রণেশ মৈত্র। আজীবন বাম রাজনীতির ধারক-বাহক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক রণেশমৈত্র পাবনায় মহান মুক্তিযুদ্ধে বাম রাজনীতিকদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি পাবনা জেলার প্রতিটি উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাদা আলাদা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। পাবনা জেলার তৎকালীন ডিসি নুরুল হকসহ অন্যান্যদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ২২ পৃষ্ঠার এই আলোচনা পাবনার মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত রুপ আমরা পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে পারি। ‘অঞ্চলভিত্তিক যুদ্ধ’ শিরোনামে পাবনা জেলার সার্বিক ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম রবি। তিনি কলামিষ্ট রণৈশ মৈত্রের মতই উপজেলাভিত্তিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন।
১৩৮ পৃষ্ঠা থেকে উপজেলাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। পাবনা সদর উপজেলা নিয়ে লিখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পাবনার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জহুরুল ইসলাম বিশু। তিনি পাবনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলতে গিয়ে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ভুট্টোবিরোধী আন্দোলনের মত পুরোনো কিছু আন্দোলন সংগ্রামের কথা টেনে এনেছেন। লেখকের নিজের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টি এখানে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ, অস্ত্রচালনা, সাংগঠনিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেছেন। অপারেশন সার্চলাইট কিংবা পুলিশ লাইনের যুদ্ধ, টেলিফোন এক্সচেঞ্জের যুদ্ধ, পাকবাহিনীর পাবনা দখল, স্বাধীনতা বিরোধীদের বিভিন্ন তৎপরতা নিয়ে তিনি বিশদ আলোচনা করেছেন। পাবনার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন কর্মসূচি, বিভিন্ন এলাকায় শাহাদত বরণকারী মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সাধারণ মানুষের কথা সুষ্পষ্টভাবে তুলে বীরমুক্তিযোদ্ধা ধরেছেন এই লেখক ।
আটঘরিয়া উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন যাহিদ সুবহান। তরুণ এই লেখক-সাংবাদিক আটঘরিয়ায় সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন যুদ্ধ ও ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও বিভিন্ন দলিলাদিতে উল্লিখিত তথ্য তার এই লেখা। পাবনার প্রতিরোধ যুদ্ধে আটঘরিয়াবাসী বিশেষ করে পাবনা জেলার প্রথম শহিদ মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন আটঘরিয়া থানার দারোগা আ. জলিলের কথা উঠে এসেছে তার লেখায়। এছাড়া আটঘরিয়ার টাইগার খ্যাত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেনসহ তাঁর সহযোদ্ধাদের কীর্তির কথা উঠে এসেছে তার লেখায়। উঠে এসেছে আটঘরিয়ার লক্ষ্মীপুরের হিন্দুপাড়ায় ২০ আগস্ট ১৯৭১ সালে সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার কথা। ২৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে এদিন হত্যা করা হয়েছিলো নির্মমভাবে। যাদের ২৬ জনই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। উঠে এসেছে শহিদ বুদ্ধিজীবী লোককবি এমএ গফুরর কথা। এছাড়া আটঘরিয়া সংঘটিত সবচেয়ে বড় সম্মুখযুদ্ধ যা এই এলাকার বংশীপাড়ায় সংঘটিত হয়েছিলো তাও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে শাহাদতবরণ করেছিলেন এবং ক্যাপ্টেন তাহের সহ ১৩ জন পাকসেনা এখানে নিহত হয়েছিলো। বেরুয়ান যুদ্ধ, বেলদহ যুদ্ধ, আটঘরিয়া থানা আক্রমন, আটঘরিয়া শত্রুমুক্ত করা, গোড়রী ও খিদিরপুরে আদীবাসী পল্লীতে নির্যাতন-অগ্নিসংযোগের কথা, গ্রামের পর গ্রাম অগ্নিসংযোগের কথাও এই লেখায় স্থান পেয়েছে। এছাড়া গণকবর, বধ্যভূমি, স্মৃতিসৌধ, বীরাঙ্গনা নারী, আটঘরিয়ার স্বাধীনতা বিরোধীদের কথা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন এই লেখক। কয়েকজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার সংক্ষিপ্ত জীবনীও এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ঈশ্বরদী উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন বীর মুক্তিযুদ্ধা আব্দুল খালেক বিশ্বাস। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ, মাধপুরের যুদ্ধ, দাশুড়িয়া, ঈশ্বরদী এলাকার যুদ্ধ, পাকশীর যুদ্ধ, মীরকামারীর যুদ্ধ, আইকে রোডের যুদ্ধ, পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ ইত্যাদি বিষয়ে সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় এই লেখকের লেখায়।
চাটমোহর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এস. এম মোজাহারুল হক। চাটমোহর অ লের বিভিন্ন এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধীদের কর্মকা- ও বিভিন্ন যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেললাইন এবং চলনবিলের বিভিন্ন এলাকার যুদ্ধ এই লেখায় স্থান পেয়েছে।
‘মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর উপজেলা’ শিরোনামে ফরিদপুর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুজ্জামান মনি। ১৫ পৃষ্ঠার এই ইতিহাসে ডেমরার গণহত্যা, কালিয়ানি যুদ্ধ, মাজাট যুদ্ধ, ফরিদপুর থানা আক্রমন, হাদলের গণহত্যা ও যুদ্ধ, কালিকাপুর গণহত্যা, গোপালনগর গণহত্যা ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এই লেখায় স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
বেড়া উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন বেড়া কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক জনাব আব্দুস সাত্তার মিয়া। মুক্তিযুদ্ধে বেড়া অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, নগরবাড়ি প্রতিরোধ যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস এই লেখায় স্থান পেয়েছে।
সাঁথিয়া উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. নিজামউদ্দিন। উল্লেখ্য ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাথিয়ার বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধ ও গণহত্যার ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ এই সাঁথিয়ার ডাববাগান বা শহিদনগর দিয়ে দ্বিতয়ি দফায় পাকবাহিনী পাবনায় প্রবেশ করে পাবনা শহর দখল করে। এই ডাববাগানে প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই এলাকার ধুলাউড়ি, বাউশগাড়িতে, করমজায় ব্যাপক গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী। ইসলামী ছাত্রসংঘের তৎকালীন সভাপতি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর জন্মস্থান এই সাঁথিয়া।
সুজানগর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম বিশু। পাবনা সদর উপজেলার মতই সুজানগর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ আমরা সহজেই নিতে পারি এই অমিতবিক্রমী যোদ্ধার লেখা থেকে। সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকসেনাদের বহনকারী একটি ফেরি আক্রমণ ও ডুবিয়ে দেওয়ার মত লোমহর্ষক ঘটনার অবতরণ করা হয়েছে এই লেখায়। বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের অমর কীর্তিগাঁথার কথা প্রকাশ পেয়েছে এই লেখায়। পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জহুরুল ইসলাম বিশু সুজানগরের রণক্ষেত্রে তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিকথারও উল্লেখ করেছেন।
চতুর্থ অধ্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শিরোনামে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন স্মৃতিচারণা ও সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রথম স্মৃতিচারণা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী যোদ্ধা, পাবনার কৃতি সন্তান এ কে খন্দকার (বীর উত্তম)। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জেনারেল নিয়াজীর বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং সেখানে তাঁর উপস্থিতিসহ বিভিন্ন স্মৃতিচারনার অবতরণ করেছেন তিনি।
পাবনার আরেক কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা-সংগঠক রফিকুল ইসলাম বকুলের একটি লেখা ছাপা হয়েছে এরপরই। তিনি পাবনার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এডওয়ার্ড কলেজের মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর সাংগঠনিক কার্যক্রম তুলে ধরেছেন ‘এডওয়ার্ড কলেজ: সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধার ¯্রষ্ট্রা’ শিরোনামের লেখায়। ‘আমার একাত্তর’ শিরোনামের আরেকটি লেখায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইসমত তাঁর যুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করেছেন। ‘আমি প্রাণ দিয়েছি তোমরা শান্তি দাও’ শিরোনামে স্মৃতিচারণামূলক লিখেছেন আব্বাস আলি। কয়েকজন নারী মুক্তিযোদ্ধার কথাও উঠে এসেছে গ্রন্থটিতে যা গ্রন্থের বিশেষ দিক বলে মনে করি। ভানু নেছা লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথা। এছাড়া গাজী সৈয়দ শুকুর মাহমুদ, মো. মতিউর রহমান, মো. হাবিবুর রহমান তাঁদের যুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণা করেছেন।
পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অবিস্মরনীয় নাম ডিসি নুরুল কাদের। তৎকালীন পাবনার এই জেলাপ্রশাসকের কাছে পাবনাবাসীর চিরজীবনের ঋণ। তিনিই প্রথম পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছেন। পাবনার প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব তিনিই দেন। তাঁর এই অমর কীর্তির কথা লিখেছেন আটঘরিয়ার কৃতি সন্তান, দেবোত্তর কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা আমিরুল ইসলাম রাঙা। মো. আরিফ ইকবাল টিংকু, ড. মনজুর কাদির, ওমর সরকার, মোল্লা আলি আছগার, মানিক মজুমদার, কানিজ ফাতেমা মিনা, লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ।।
৪১১ পৃষ্ঠা থেকে চতুর্থ অধ্যায়ের খ অনুচ্ছেদে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সরাসরি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। আটঘরিয়া উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক, আলী আশরাফ, সুলতান মাহমুদ, মোতালেব হোসেনসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আটঘরিয়া প্রজন্ম ’৭১-এর সভাপতি মো. শফিউল্লাহ। এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন (বেড়া), বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আ. লতিফ (বেড়া), বীর মুক্তিযোদ্ধা মো.. মকবুল হোসেন (বেড়া), মো. আজিজুর রহমান টিংকু (পাবনা সদর), মো. মোসলেম উদ্দিন মালিথা (ঈশ্বরদী), রইচ উদ্দন (ভাঙ্গুড়া), আনছার আলি শেখ (সাঁথিয়া)- এঁর সাক্ষাৎকার সন্নিবেশিত হয়েছে।
পঞ্চম অধ্যায়ে বিবিধে পাবনার বিভিন্ন লেখকের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প, কবিতা, গান ইত্যাদি সন্নিবেশিত হয়েছে। এই অধ্যায়ের কয়েকজন লেখকের কথা না বললেই নয়। কবি বন্দে আলী মিয়া, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার , কবি ও গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কবি ওমর আলী, রশিদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, দাউদ হায়দার, মাকিদ হায়দার, গোবিন্দলাল হালদার, মনোয়ার হোসেন জাহেদী, মজিদ মাহমুদ এর নাম উল্লেখ করার মত। বইটির একদম শেষে পাবনা জেলার সকল শহীদের নামের তালিকা এবং বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রকাশনার উল্লেখ করা হয়েছে।
পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থটি চাররঙা নান্দনিক প্রচ্ছদ সম্বলিত যার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছেন প্রকাশক নিজে। এই প্রচ্ছদে পাবনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে নির্মিত দুর্জয় পাবনার ছবি দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ইতিহাস গ্রন্থ এবং মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য দলিল। কোনো ইতিহাসই শতভাগ ত্রুটিমুক্ত নয়। তেমনি পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থটিও পরিপূর্ণ কিংবা শতভাগ সমৃদ্ধ নয় বলে মনে করি। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক গ্রন্থ তাই মুক্তিযুদ্ধের কিছু বিষয় অতিসংক্ষিপ্ত হয়েছে বলে মনে করি। যেমন পাবনা জেলার শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে খুব বিশদ তথ্য গ্রন্থটিতে নেই বলে মনে করি। উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংযুক্ত করা যেতে পারতো বলে মনে করি। পাঠান্তে প্রতীয়মান হয় যে, বানান কিছুটা দৃষ্টির সাথে প্রতারণা করেছে বলে বোঝা যায়। অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় স্থান পায় নি আবার অনেক অপাঙক্তেয় ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধার মত সম্মান ভোগ করছে এই বিষয়টির কোন আলোচনা উঠে আসে নি। পাবনার স্বাধীনতা বিরোধীদের কথা খুব বেশি আলোচিত হয় বলে মনে হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এই গ্রন্থটির সাার্থকতার ভাগ বেশি বলে বিশ্বাস করি। বোদ্ধা পাঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসুদের কাছে বইটি ব্যাপক সমাদৃত হবে এবং পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থটি অনবদ্য দলিল হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিবেচিত হবে এই আশা রাখি।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস