পরাভূত
পরাভূত
জীবনে অনেক ছোটো খাটো ব্যথা থাকে যা ইচ্ছে করলেই কারো নিকট প্রকাশ করা হয় না। গত বছর মেজো আপার মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে গেলাম। মোবাইল ফোনের দাওয়াত। আগে মানুষ দাওয়াত দিতে আসত। বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে আসত। এখন আর এ সব নেই। ডিজিটাল যুগ বলে কথা। সেদিন রাতে দুলাভাই আমাকে যেভাবে জড়িয়ে ধরেছিল! তা ছিল ভারি অন্যায়। মান সম্মানের ভয়ে চেপে গেলাম। থাক, একটু দুষ্টুমি তো করতেই পারে, তাই নয় কি! এভাবেই আমার মতো কত মেয়ে প্রতিদিন প্রিয় কিছু মানুষের দ্বারা নিদারুণ নিপীড়ন সহ্য করে। আমার মতো সরল মেয়েদের কপালে এই থাকে। আমি ভয়ে কাউকে কিছুই বললাম না। কিছু বলতে গেলেও কে কীভাবে নিবে এ ভেবে মন সায় দিল না। আবার পরক্ষণেই ভাবলাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত।
আজকাল তো ভালো কথা বলা পাপ, এমন মনে হয়। সেদিন সকালে পত্রিকা পড়তে বসেছি। প্রথমেই চোখ চলে গেল ‘ভাইয়ের হাতে ভাই খুন।’ বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠল। টেলিভিশন দেখা বন্ধ করে দিয়েছি অনেক দিন হল। প্রয়োজন হলে ইন্টারনেট থেকে কিছু নিউজ দেখি। কী নেই এখানে! এমনকি ফেসবুক খুললে সারা দুনিয়া মনে হবে নিজ বাড়ির উঠোন। আমাদের স্বপ্ন থাকে কিন্তু তা পূরণের অভিপ্রায় থাকে না। গত বছর ছোটবোনটা গলায় ফাঁস নিয়ে মরে গেল। ‘অবিবাহিত একটা মেয়ে। মা না হয়েই মরে যেতে পারে!’ মেয়ে বলেই হয়তো মরে যায়। বেচারির জন্য বড্ড মায়া হয় আমার। চোখের জল শুকিয়ে যায় সহজে। স্মৃতিগুলো তখন আরো সজীব হয়ে ওঠে জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
আরও পড়ুন গল্প হলেও সত্য
বিবাহিত জীবনে আমি সুখী। স্বামীর কাছে যখন যা দাবি করেছি সে তার সাধ্যমতো তা দেবার চেষ্টা করেছে। প্রতিটি মেয়ের হয়তো স্বামীর প্রতি একটা অভিযোগ থাকেই। আমিও তাই দেখেছি। বাবা কত ভাল মানুষ কিন্তু মায়ের মুখে কোনোদিনও বাবার প্রশংসা শুনতে পারিনি। আমার দুটি সন্তান। মাঝে মধ্যেই ওর বাবার কাছে বিভিন্ন আবদার করে। ইদানীং বায়না ধরেছে হরলিক্স খাবে। প্রভা সহজে ঘুমাতে চায় না। প্রভা বলে “বাবা আসলে আমি ঘুমাব”। বড় মেয়েটি আমার সঙ্গে জেদ ধরে থাকে। বাবা না আসা পর্যন্ত সে কোনো কিছু খাবে না, ঘুমাবে না। মেয়েরা হয়তো বাবা ভক্ত হয়। পৃথিবীর সব মেয়েই হয়তো বাবা ভক্ত!
আজকাল দেশের যে অবস্থা তাতে ভয়ে থাকি। মেয়েটা কিছুক্ষণ পরপর আমাকে প্রশ্ন করে, মা বাবা এত দেরি করে বাসায় ফিরে কেন ? আমার হরলিক্সের জন্য কি বাবা অফিস থেকে দেরি করে ফেরে? আমি আর কখনো হরলিক্স খেতে চাইব না। সংসারের অভাব মেয়ে হয়তো অনুভব করতে পারে না। পারবে কীভাবে। এখন যে সময় আমরা পার করছি, সৎভাবে সংসার চালানো অনেক কঠিন। সুমনের বেতন আমি জানি। ও ইচ্ছে করে আমাকে অনেক কিছু কিনে দিতে চায়। মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, আমার সব কিছুই তো নতুন। আমার কিছুই লাগবে না। তবুও বেচারা কোনো কোনো দিন আমার জন্য, বাচ্চাদের জন্য চেষ্টা করত। বিশেষ দিনে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসতো। আমার জন্য কাঁচের চুড়ি! এখন কোনো মেয়ে কাঁচের চুড়ি তেমন একটা পরে না। এ তল্লাটে হয়তো আমি পরি। সুমন খুব সখ করে এনে দিয়েছিল আমাদের বিবাহবার্ষিকীতে।
আরও পড়ুন প্রতীক্ষিত বৃষ্টি
প্রতিদিনের মতো আজও বেশ রাত করে বাসায় ফেরে সুমন। চোখের দিকে তাকালে মায়া হয়। গা দিয়ে কেমন পাকা কলার মত ঘ্রাণ বের হয়। জামাটা খুলে আমার হাতে দিল। ফ্রেশ হবার কিছুক্ষণ পরেই রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
_প্রভা হরলিক্স খেতে চেয়েছিল? সুমনের মতিগতি বুঝে আস্তে করে বললাম।
_দেখে এসেছি, বেতন পাবার পর কিনে দেব।
_বাসা ভাড়া নিতে এসেছিল বাড়িওয়ালা। কথা বলতে না বলতেই প্রভার বাবা ঘুমিয়ে গেল।
সবকিছু ঠিকঠাক প্ল্যান করে রেখেছি। এবার সুমনের বেতন পাওয়ার পর, মেয়েদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাব। সারাদিন গৃহবন্দি জীবন ভালো লাগে না। টেলিভিশন দেখে দেখে মেয়ে এদিক ওদিক বেড়াতে যেতে চায়। কতদিন বাচ্চাদের সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে রাখা যায়? প্রভার বাবার সঙ্গে কথা বলে রেখেছি, সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বেতন পাওয়ার দু’দিন আগে ঊষার প্রচণ্ড খিচুনি উঠল। ডাক্তার দেখানো হল। হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হবে।
আরও পড়ুন শফিক নহোরের গল্প-
চোখে দেখা নীলকণ্ঠ
আড়ালের চোখ
নীরুর মা
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
পরাভূত