পরাজিত নাবিক
পরাজিত নাবিক
রাতুল হাসান জয়
বিকেলের রোদে কদম গাছের ছায়া পড়েছে পানিতে। বাতাসের ধাক্কায় মৃদ্যু ঢেউ খেলছে পুকুরের পানি। একটা বড় কাতল মাছ হা করে ভেসে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর। এরপর গপাগপ পানি গিলে ডুবে যাচ্ছে অতলে। যেভাবে ভাগ্য আমার জীবন গিলে ডুবে গেছে সময়ের পেটে। কদম গাছের ডালে বসা মাছরাঙাটা এরই মাঝে বেশ কয়েকবার হামলে পরেছে পানিতে। কি দেখে হামলে পরছে ঠাহর করতে পারছি না। একবারও তার ঠোঁটে মাছ চোখে পরেনি। আমারই মতো ব্যর্থ। পঁয়তাল্লিশ বছরেও সফলতার মুখ দেখলাম না। চাকরিতে ব্যর্থ। ব্যবসাতেও গাঁট জমাতে পারিনি। চেষ্টার কমতি রাখিনি। চেষ্টায় চেষ্টায় সন্তানদের জীবন এনে দাঁড় করিয়েছি খাঁদের কিনারে। দেনার ভারে মাটিতে গেঁথে গেছে পা। ছেলেটার পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে বছর চারেক। নাম সজল। ছোটখাটো চাকরি করে। ভেসে যাওয়া সংসার পাড়ে আনার চেষ্টায় রাতদিন এক করছে অভিযোগহীন। আমি তো টের পাই। কি ভীষণ অভিমান পুষে রাখে বুকের ভিতর।
বিকেল পড়ে আসছে। রক্তিম আকাশে যেন আমারই ভিতরের প্রতিচ্ছবি। বহুকাল আগে এমন বিকেল ছিলো ভালোবাসাময়। সেইসব কেবলই স্মৃতি।
স্ত্রী সরলতা তার নামের মতোই সহজ আর সরল। আমার ব্যর্থতা তার ভিতরের সরলতাকেও কঠিন করে তুলেছে। সবসময় সঙ্গ দিয়েছে। অনুপ্রাণিত করতো নতুন করে উঠে দাঁড়ানোর। তার অবশিষ্ট গহনা বলতে আছে কেবল নাক ফুল। শেষ কবে নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছি তাও মনে পড়ে না। ভেঙে পড়া এই মানুষটা সেদিন তার অভিমান অভিযোগের সুরে দেখালো। আমি দেখলাম ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঘষে অংক বুঝিয়ে দিচ্ছেন স্কুলের আলম স্যার। জানা অংকটা ভেঙে চুরে দেখিয়ে দিচ্ছেন নতুন করে। তার প্রতিটা কথা অগ্নিগিরি থেকে বেরিয়ে আসা লাভার মতো।
আরও পড়ুন গল্প বিপরীত
জীবনের প্রতি অভিমান আমারো আছে। হাঁফ ধরা বুকে হাত চেপে বুঝলাম, ফুরিয়ে আসছে বাতাস। বুকে ধড়ফড়ানি আর ব্যথা। গায়ে ফোয়ারার মতো ঘাম। সেবারই প্রথম হাসপাতালে। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখিয়ে আনলো স্ট্রোক। রোজ রোজ মরে যাওয়া মানুষটা মৃত্যু ছুঁয়ে বেঁচে ফিরলাম স্বশরীরে। কষ্ট পাবো তাই ছেলে মেয়ে কথায় হিসেবী হলো। কমে গেলো কথার পরিমাণ। সরলতা সকল কষ্ট বুকে পিঠে বিঁধিয়ে রাখতে লাগলো বিষাক্ত তীরের মতো। যেন আঁচটাও টের না পাই। কথাবার্তা এসে দাঁড়ালো কেবল শোবার বিছানায়।
পুকুরপাড় থেকে উঠে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। বাড়ির ওই বারান্দার চেয়ারটা আমায় টানে চম্বুকের মতো। কোলাহল ভালো লাগে না বহুকাল। অথবা ভালো লাগানোর মনটাই বেঁচে নেই। বিকেলে হাঁটতে বের হই। এসে বসি এই পুকুর পাড়ে। পুকুর পাড়ে বসেও দিব্যি দেখা যায় বাড়িটা। কিছুটা একাকীত্ব রেখে যাই পুকুরের টলটলে জলে। পাখির পালকের মতো রেখে যাই জলজ চোখের দু’ফোঁটা স্মৃতি।
এইসব বিস্মৃতি পরায়ণ বিকেলে
ঠোঁটে গুঁজে এঁটে দেই হাসি।
দায় কার! যে ক’বে?
শান্ত নদীতে ডুবে ভাঙনের শব্দ শুনেছি!
যুবক বয়সে লেখার ঝোঁক ছিলো। তখন লিখেছিলাম। বাড়ি ফেরার পথে এখন ঠোঁটে গুঁজে এঁটে রাখি হাসি। তখন কারো দায় না থাকলেও এখন আছে। সরলতা সহজেই শুনে ফেলে বুকের ভিতরে ভাঙনের আওয়াজ। তখন বারান্দায় থাকা টুল টেনে এনে বসে পাশে। হাতের উপর হাত রাখে। আমাদের কোন কথা হয় না। অথচ অনেক কথা হয়। যা কেবল আমরাই বুঝি।
আরও পড়ুন গল্প মামৃত্যু
সরলতার কষ্ট আমার চেয়েও বেশি। আমাকে বিয়ে করার মতো কঠিন সিদ্ধান্তের কারণে খুঁয়েছে পরিবার। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বেশ ক’বার।
__বিয়ের এত বছরেও তোমায় কষ্ট ছাড়া সুখ দিতে পারিনি। তোমার আফসোস হয় না?
__আফসোস হবে কেন? ভালোবাসার মানুষের কষ্টে থাকতে পারাটাও সুখের। এই যে দিনশেষে তোমার হাত ধরতে পারি। অধিকার নিয়ে বুকে মাথা রাখতে পারি। এ কি কম আনন্দের?
সজলের নাম রেখেছিলো সরলতা। সজল পড়াশোনায় যেমন ভালো তেমন লেখালেখিতেও। স্কুলে পড়াকালীন সময়েই পত্রিকায় তার গল্প প্রকাশ হয়েছিলো বেশ কয়েকবার। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে চাপিয়ে ভুলেছে শখ আহ্লাদ। পড়াশোনা করার বয়সে করছে অক্লান্ত খাটুনি। ঘামেভেজা সজলের চেহারা চোখে পড়তেই আঁতকে ওঠে বুক। ধিক্কার দেই নিজেকে।
মহিমার সব আবদার এখন মায়ের কাছে। পড়াশোনায় এত ব্যস্ত যে কখনো কখনো সারাদিনে কথাই হয় না। একই ছাদের তলায় থেকেও যেন দূরুত্বে বসবাস। একসময় তার বন্ধুরা বাসায় আসতো। এখন আসে না। মা’র সাথে তার অভাবী চিল্লাচিল্লি দৈনিকের।
রাতে শোবার ঘরে এসে সরলতা ওষুধ এগিয়ে দিয়ে মশারী টাঙাতে গেলো প্রতিদিনের মতো। বললাম,
__ওষুধে আর কাজ হবে না, সরো। রেখে দাও।
__ওসব না বলে, খেয়ে নাও চুপচাপ।
__তুমি কি কোন গন্ধ পাচ্ছো না ঘরে?’
__কিসের গন্ধ?
__মৃত্যুর।
__কয়েল জ্বালিয়েছি তারই গন্ধ।
__দুটোর গন্ধই আমি চিনি, সরো। তুমি আসো তো। একটু মাথা রাখি কোলে।
সরলতা উঠে এসে তার কোলে আমার মাথাটা রাখলো। এরপর পরম মমতায় কাঁচাপাকা চুলে হাত বুলিয়ে দিল। তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একজোড়া জলজ চোখ। চোখে জল লুকানোর চেষ্টা। তারপরও দু’ফোঁটা অশ্রু এসে আমার কপালে পড়লো।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
পরাজিত নাবিক